ছড়িয়ে পড়েছে রাসেলস ভাইপার, আতঙ্কে মাঠে যাচ্ছেন না অনেক কৃষক

ফয়সাল আহমেদ ও মেহেদী হাসান

ছবি : সংগৃহীত

বিষধর সাপ রাসেলস ভাইপার। বাংলায় ডাকা হয় চন্দ্রবোড়া নামে। বৈজ্ঞানিক নাম ডাবোয়া রাসেলসই। ২০০৯ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষে এটিকে দেশে মহাবিপন্ন গোত্রভুক্ত করা হয়। ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। তবে এক দশকের বেশি সময়ের ব্যবধানে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব। এ সাপের কামড়ে বেড়েছে মৃত্যুও। পরিস্থিতি এতটা জটিল আকার ধারণ করেছে যে কোথাও কোথাও আতঙ্কে জমিতে কাজ করতে যাচ্ছেন না কৃষক।

রাজশাহীতে সাপ নিয়ে গবেষণা করে স্নেক রেসকিউ অ্যান্ড কনজারভেশন সেন্টার। এ সেন্টারের গবেষকরা জানান, ‌আশির দশকে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধিদপ্তর সাপটিকে বিলুপ্ত প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করে। তবে ২০০৯ সালে বাংলাদেশে সাপটির প্রথম দেখা মেলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার একটি কৃষি খেতে। সেখানে এর দংশনে মারা যান এক কৃষক। একই বছরের শেষের দিকে রাজশাহীর তানোর উপজেলাতেও এ সাপের দংশনে মৃত্যু হয় এক কৃষকের। দুই স্থানেই পিটিয়ে মারা হয় সাপগুলোকে। ২০১১ ও ২০১২ সালে শুধু রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় চন্দ্রবোড়ার দেখা মিললেও ২০১৩ সালে নাটোরের লালপুর, ২০১৪ সালে পাবনার রূপপুর এবং একই বছরের শেষদিকে ফরিদপুর ও রাজবাড়ী জেলায় এ সাপের সন্ধান মেলে। মূলত ২০১৬ সালের দিকে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে মৃত্যুর খবর বেশি মিলতে থাকে। এর পর থেকে প্রায় প্রতি বছর এ সংখ্যা বাড়তে থাকে। এখন তা আরো বেড়েছে।

বিভিন্ন স্থানে রাসেলস ভাইপার ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে গবেষকরা জানান, বাংলাদেশে আগে থেকে রাসেলস ভাইপারের অস্তিত্ব ছিল। তবে ২০১০ সালের দিকে বন্যার পানিতে গঙ্গা-পদ্মা হয়ে ভেসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহারসহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে এ বিষধর সাপ বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পদ্মার মধ্যবর্তী চরাঞ্চল ও তীরবর্তী লোকালয়ের প্রায় দেড়-দুই কিলোমিটারের মধ্যে এদের বিচরণ। তবে বন্যার সময় সাপটি মূল পদ্মা নদী, উপনদী, ছোট ছোট শাখানদী, খাল-বিল ও বড় বড় ড্রেনের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে এরা কৃষি খেত ও বিভিন্ন জঙ্গলে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে আস্তানা তৈরি করে। বর্তমানে দেশের ২৮টি জেলায় এর বিচরণ ও উপদ্রব পাওয়া গেছে। জেলাগুলো হলো রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, পাবনা, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম। ভবিষ্যতে এর সংখ্যা ও বিস্তৃতি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সাপ যেহেতু বেশির ভাগ সময় মাটির নিচে ও জঙ্গলের ভেতরে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পচ্ছন্দ করে, তাই এর সঠিক সংখ্যা বলা সম্ভব না।

চন্দ্রবোড়া খুবই অলস প্রজাতির সাপ। সাধারণত এরা কৃষি খেতে থাকতে বেশি পছন্দ করে। এরা আক্রমণাত্মক না। তবে কেউ যদি এদের কাছাকাছি চলে আসে তখন এরা ভয় পেয়ে নিজেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে হিস হিস শব্দ করতে থাকে। আয়ত্তের মধ্যে এলে ১ সেকেন্ডের মধ্যে কামড় বসিয়ে দেয়। সাপাটির প্রিয় খাবার ইঁদুর। তবে টিকটিকি, ব্যাঙ ও ছোটখাটো পাখিও খায়। এ সাপের বসবাসের পরিবেশ যদি বিরূপ হয়, তবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে এরা বংশ বিস্তার করতে পারে। এর দেহ সাধারণত মোটা, মাথা ত্রিকোণাকৃতির, লেজ ছোট ও সরু। এর শরীরে অর্ধচন্দ্রাকৃতির ছোপ থাকে। দেখতে অনেকটা অজগরের বাচ্চার মতো। এরা হেমোটক্সিন বিষযুক্ত সাপ। প্রাপ্তবয়স্ক রাসেলস ভাইপারের দেহের দৈর্ঘ্য সাধারণত এক-দেড় মিটার হয়। চন্দ্রবোড়া ডিম পাড়ে না, সরাসরি বাচ্চা দেয়। এরা অক্টোবর-নভেম্বরে ‘মেটিং’ করে এবং ফেব্রুয়ারি-মার্চের দিকে বাচ্চা প্রসব করে। একটি স্ত্রী সাপ ২০ থেকে ৬০টি বাচ্চা দেয়। তবে কোনো কোনো সাপের ৮০টি পর্যন্ত বাচ্চা দেয়ার রেকর্ড রয়েছে।

রাসেলস ভাইপার নিয়ে একটি গবেষণার বরাত দিয়ে এর উপদ্রব ও কামড়ে মানুষের মৃত্যুর বিষয়ে স্নেক রেসকিউ অ্যান্ড কনজারভেশন সেন্টারের গবেষক বোরহান বিশ্বাস রোমন জানান, সারা দেশে গত সাত বছরে এক হাজারের অধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহী বিভাগে ৮০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গত ২০ দিনে সারা দেশে ৭২ জন চন্দ্রবোড়ার কামড়ে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২৯ জনের, যার মধ্যে রাজশাহী বিভাগে মারা গেছে চারজন। বর্তমানে রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী, তানোর, চারঘাট, বাঘা, নাটোরের গোপালপুর ও লালপুর এবং পাবনার ঈশ্বরদীতে এর উপদ্রব রয়েছে। এছাড়া ফরিদপুরের চরভদ্রাসন, শরীয়তপুরের সখিপুর ও নড়িয়া, মাদারীপুরের শিবচর, ঢাকার দোহার, মুন্সিগঞ্জের লৌহজং, চাঁদপুরের মতলব ও পদ্মাতীরবর্তী অঞ্চলগুলোয় চন্দ্রবোড়ার উপদ্রব দেখা গেছে। তবে বর্তমানে শরীয়তপুরের সখিপুর ও ফরিদপুরের চরভদ্রাসনে এর সবচেয়ে বেশি উপদ্রবের খবর পাওয়া গেছে।

সাপের কামড়ে করণীয়র ব্যাপারে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আবু শাহীন বলেন, ‘‌রাসেলস ভাইপারের কামড় থেকে কৃষকদের বাঁচতে হলে গামবুট ব্যবহার করতে হবে। সাপ কামড়ালে ওঝার শরণাপন্ন না হয়ে নিকটস্থ হাসপাতালে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে। কারণ বর্তমানে দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম আছে।’

অন্যদিকে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার চরাঞ্চলে গত দেড় মাসে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে প্রাণ গেছে তিন কৃষকের। রাসেলস ভাইপারের ভয়ে মাঠ থেকে পাকা ধান ও ভুট্টা তুলতে ভয় পাচ্ছেন কৃষক।

গোয়ালন্দ উপজেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, সর্বশেষ গত সোমবার দুপুরে গোয়ালন্দ উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের মজলিশপুর গ্রামের কৃষক শামীম শেখ পদ্মা নদী থেকে একটি নৌকা সরাচ্ছিলেন। এ সময় তার পায়ে কামড় দেয় রাসেলস ভাইপার। স্থানীয়দের সহযোগিতায় তাকে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে পরদিন মারা যান তিনি। এর আগে গত ৮ এপ্রিল মাঠে কাজ করতে গিয়ে সাপের কামড়ে মারা যান কৃষক সাইদুল এবং ২৯ মার্চ মারা যান কৃষাণী ময়না বেগম। পরপর সাপের কামরে তিনজনের মৃত্যুতে আতঙ্ক বিরাজ করছে মজলিশপুর চরে। শুধু মজলিশপুর নয়, সাপের উপদ্রব বেরেছে উজানচর ইউনিয়নের মহিদাপুর, দেবীপুর, দৌলতদিয়া ইউনিয়নের চর করনেশনা, আঙ্কের শেখের পাড়াসহ কয়েকটি এলাকায়।

সোমবার সকালে উজানচর ইউনিয়নের মজলিশপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের পর মাঠ শুধু ফসল আর ফসল। পাকা ধান ও ভুট্টা খেত পড়ে আছে। পাশে থাকা পাট খেতেও পাটের চেয়ে ঘাস জন্মেছে বেশি।

এ সময় ওই এলাকার কৃষক মহন শেখ বলেন, ‘আমার ছোট ভাই শামীমকে কামড় দিয়ে মেরে ফেলেছে রাসেলস ভাইপার সাপ। সাপের ভয়ে এখন আর আমরা কেউ মাঠে নামি না।’

কৃষক আনোয়ার শেখ জানান, মাঠ ভরা পাকা ফসল থাকলেও সাপের ভয়ে মাঠে যেতে ভয় পাচ্ছেন তারা।

এ বিষয়ে গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌গোয়ালন্দ উপজেলার নতুন আপদের নাম সাপ। শুধু রাসেলস ভাইপার নয়, উপদ্রব বেড়েছে অন্যান্য সাপেরও। চরাঞ্চলে গত দেড় মাসে তিনজন রাসেলস ভাইপারের কামড়ে মারা গেছে। ভয়ে কৃষকরা মাঠে যাচ্ছেন না। কৃষিকাজ যাতে স্বাভাবিক থাকে সেজন্য ১০০ কৃষককে গামবুট দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দ্রুতই তা বাস্তবায়ন করা হবে।’

রাজশাহীর গবেষক বোরহান বিশ্বাস রোমন জানান, এ সাপের বিস্তৃতি রোধে এখনই গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। যেমন উপদ্রুত অঞ্চলের মানুষজনকে সচেতন করা, দংশন প্রতিরোধক যন্ত্রাংশ দেয়া এবং উপদ্রুত অঞ্চলের জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। উপদ্রুত অঞ্চলে বেজি, বনবেড়াল, শেয়াল, কুকুরসহ অন্যান্য সাপখেকো প্রাণীর বিস্তারের মাধ্যমে এর নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। এছাড়া উপদ্রুত অঞ্চল থেকে এ সাপগুলোকে উদ্ধার করে অভয়ারণ্য গড়ে তোলা যেতে পারে।

সচেতনতার বিষয়ে রাজশাহী বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর কবীর বলেন, ‘এ পর্যন্ত রাজশাহী অঞ্চলে প্রায় ৬০ হাজার মানুষকে সাপের কামড় থেকে বাঁচতে সচেতনতামূলক পরামর্শ দিয়েছি।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন