বন্যায় সিলেটাঞ্চলে ১৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি, আশ্রয় কেন্দ্রে ৩০ হাজার

বণিক বার্তা ডেস্ক

ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

ভারি বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ১৫ লাখের বেশি মানুষ। এর মধ্যে ৩০ হাজারের বেশি আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে। এছাড়া উজানি ঢলে তিস্তার পানি বেড়ে প্লাবিত হয়েছে উত্তরাঞ্চলের নিম্নাঞ্চল। ভারি বর্ষণে প্লাবিত হয়েছে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার অন্তত ৫০টি গ্রাম।

দ্বিতীয় দফা বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সিলেট। সুরমা-কুশিয়ারাসহ এ অঞ্চলের সবক’টি নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার ১৩টি উপজেলাসহ সিলেট সিটি করপোরেশনের ২৩টি ওয়ার্ডের ৮ লাখ ২৫ হাজার মানুষ এখন পানিবন্দি। তিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বন্যার পানি ওঠায় ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে জেলার সব পর্যটন কেন্দ্র। বিদ্যুৎ স্বাভাবিক রাখতে মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী। 

সিলেটে রোববার রাতে অতিবর্ষণ শুরু হয়। নগরীতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। পানি বাড়তে থাকে নদ-নদীতে। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে থাকে। বন্যার পানি একে একে সব উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ে। অনেক এলাকায় ঈদের জামাত নির্ধারিত সময়ে হয়নি। কোথাও কোথাও মসজিদের নিচতলায় পানি উঠে যায়। অনেকে পশু কোরবানিও করতে পারেননি বাড়িঘরে পানি উঠে যাওয়ায়। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে মঙ্গলবার। সর্বশেষ গতকাল বিকাল পর্যন্ত সুরমা-কুশিয়ারাসহ জেলার প্রধান সব নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। নিম্নাঞ্চলে পানি কিছুটা কমলেও নগরীতে বাড়তে থাকে। 

সিভিল সার্জন কার্যালয় জানিয়েছে, বন্যাকবলিত মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সিলেট জেলাজুড়ে ১২৬টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এসব দলে চিকিৎসক ছাড়াও নার্সসহ স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট অনেকেই আছেন। 

সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন জন্মেঞ্জয় দত্ত জানান, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভেতরে হাঁটু সমান পানি উঠে যায়। ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চত্বরেও হাঁটু সমান পানি উঠেছে। এতে রোগী ও তাদের স্বজনরা চিকিৎসাসেবা নিতে এসে ভোগান্তিতে পড়ে। এছাড়া পানি ওঠায় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে সব ভ্যাকসিন সরিয়ে জেলায় নিয়ে আসা হয়েছে।

এদিকে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে মঙ্গলবার মাঠে নামে সেনাবাহিনী। সিলেট সিটি করপোরেশনের অনুরোধে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদের নির্দেশনায় ‘ইন এইড টু দ্য সিভিল পাওয়ার’-এর আওতায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণ সুরমা বরইকান্দি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র রক্ষায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পক্ষ থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এ উপকেন্দ্র থেকে সিলেট রেলওয়ে স্টেশন, সিলেট শহরের পার্শ্ববর্তী বরইকান্দি, কামালবাজার, মাসুকগঞ্জ, বিসিক, লালাবাজার, শিববাড়ী ও কদমতলীর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালসহ সংলগ্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতির কারণে সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে তা কার্যকরও হয়েছে।’

সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। আগামী ৭২ ঘণ্টা ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দিপক রঞ্জন দাশ জানান, ভারতে এখনো প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। আবার সিলেটেও বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ফলে নদীর পানি দ্রুত বাড়ছে। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। সুরমা, কুশিয়ারা ও গোয়াইন নদীর ছয়টি পয়েন্টে বর্তমানে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। 

সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘সিলেট নগরীতে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রিত পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় সেবা তারা পাবে। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। পুরো বিষয়টি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গভীরভাবে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।’ 

আতঙ্কে দিন পার করছে সুনামগঞ্জের বানভাসী মানুষ: টানা পাঁচদিনের অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি দিন দিন মারাত্মক রূপ নিচ্ছে। জেলার সীমান্ত নদীসহ সব নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জেলা সদর, দোয়ারাবাজার, ছাতক, বিশ্বম্ভরপুরসহ অধিকাংশ উপজেলার রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। ফলে জেলা সদরের সঙ্গে ওইসব উপজেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ঢলের পানি শহরের কাজির পয়েন্ট, উকিলপাড়া, ষোলঘর, মধ্যবাজার, সাহেববাড়িঘাটসহ অধিকাংশ আবাসিক এলাকার বাসাবাড়িতে প্রবেশ করেছে। তলিয়ে যাচ্ছে একতলা বাড়িঘর। বন্যার ভয়াবহ রূপ দেখে আতঙ্কে দিন পার করছে বানভাসী মানুষ। ভোগান্তিতে পড়েছে গ্রামগঞ্জের পানিবন্দি মানুষ। এ জেলায় ৫ লাখ ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছে ১২ হাজার ৫০০ জন।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, ‘উজানে কম বৃষ্টি হওয়ায় সুরমা নদীর পানি কিছুটা কমেছে। শহরের বেশির ভাগ অংশ প্লাবিত ছিল, এখন কিছুটা পানি নেমেছে। তবে যেহেতু বৃষ্টিপাত অব্যাহত আছে, তাই আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।’

বাঁধ ভেঙে মৌলভীবাজারে গ্রাম প্লাবিত: কয়েক দিনের প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার চৈত্রঘাট এলাকায় ধলাই নদীর বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তীব্র স্রোতে গতকাল বেলা দেড়টার দিকে বাঁধের প্রায় ২০০ ফুট এলাকা ভেঙে যায়। এছাড়া পাহাড়ি ঢলে নদ-নদীর পানি বাড়ায় মৌলভীবাজার সদরসহ কয়েকটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছে মানুষজন। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় দুই লাখ মানুষ। 

জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম বলেন, ‘মৌলভীবাজার সদরসহ রাজনগরের কয়েকটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলায় পানিবন্দি অনেক মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে। ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস থাকায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নিয়ে কমিটি করা হয়েছে। সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হচ্ছে। খোলা হয়েছে ৯৮টি আশ্রয় কেন্দ্র।’

টেকনাফে অর্ধশত গ্রাম প্লাবিত, তলিয়েছে কোটি টাকার লবণ: কক্সবাজারের টেকনাফে ভারি বর্ষণে এ পর্যন্ত অন্তত ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে অন্তত ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি রয়েছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। এদিকে কেবল হ্নীলা ইউনিয়নেই ৩-৪ কোটি টাকার লবণ পানিতে তলিয়ে গেছে।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, ‘ভারি বর্ষণের কারণে কিছু গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। আমরা তাদের খোঁজখবর নিচ্ছি। পাশাপাশি অতিভারি বৃষ্টির কারণে পাহাড়ধসের আশঙ্কা রয়েছে। তাই ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারীদের অন্যত্র সরে যেতে বলা হচ্ছে। এজন্য আশ্রয় কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে।’

তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপরে: তিস্তাসহ রংপুরের প্রধান নদ-নদীর পানি বেড়ে নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রংপুরের নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

এদিকে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় গত ১০ দিনে কাউনিয়া উপজেলার তিস্তা তীরবর্তী কয়েকটি এলাকার অন্তত ১৫-২০টি বসতঘর ও স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়েছে। পাশাপাশি হুমকিতে রয়েছে গদাইসহ আশপাশের তিন গ্রামের কয়েকশ বসতভিটা, স্কুল ও মসজিদ।

রংপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান বলেন, ‘বন্যা মোকাবেলায় মাঠ পর্যায়ে উপজেলা প্রশাসনকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সম্ভাব্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন তারা। সেই সঙ্গে নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও চরে থাকা মানুষজনকে নিরাপদে থাকার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে।’

তীব্র হয়ে উঠেছে ভাঙন: তিস্তার পানি বেড়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করায় কুড়িগ্রামে তীব্র হয়ে উঠেছে ভাঙন। ঘরবাড়ি, ফসলের মাঠের পাশাপাশি হুমকিতে পড়েছে নদীর তীর রক্ষা বাঁধসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাটবাজার।

রাজারহাটের কালিরমেলা এলাকার তিস্তাপাড়ের সিদ্দিকুল জানান, মঙ্গলবার রাত থেকে তিস্তার তীব্র ভাঙনে তার একটি ঘর নদীতে বিলীন হয়েছে। বাকি ঘরগুলো সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তিস্তার ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাশাপাশি তিস্তার স্থায়ী ভাঙন রোধে চলমান সমীক্ষা শেষ করে কাজ শুরু করা হবে।

যমুনায় বাড়ছে পানি, বন্যার শঙ্কা: উজানে টানা ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সিরাজগঞ্জে যমুনাসহ নদ-নদীর পানি দ্রুত বেড়েছে। এতে জেলা সদর, কাজিপুর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান জানান, উজানে টানা ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে পানি বেড়েছে। এছাড়া আগামী ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মাঝারি ও ভারি বৃষ্টি হতে পারে। এ সময় জেলার নদ-নদীর পানি আরো বাড়তে পারে। তবে যমুনায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বাঁধসহ ভাঙন এলাকা সার্বক্ষণিক তদারক করা হচ্ছে। ভাঙন রোধে জিও ব্যাগসহ জনবল প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন