বিপুল লাভ হলেও লোকসানের হিসাব কষতে মরিয়া বিপিসি

ইয়াহইয়া নকিব

ছবি : বণিক বার্তা

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) চলতি অর্থবছরে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি লোকসান করতে পারে, বাজেট প্রণয়নের সময় সে প্রক্ষেপণই করা হয়েছিল। অথচ জ্বালানি তেল বিক্রি করে অর্থবছর শেষে সংস্থাটির ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার বেশি নিট মুনাফা হবে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বিগত কয়েক বছর ধরেই লোকসানের প্রাক্কলন করে উল্টো এভাবেই বিপুল অংকের লাভ করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানটি। স্থিতিশীল বাজার ও স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি চালু থাকা সত্ত্বেও একই হিসাব কষতে মরিয়া বিপিসি আগামী অর্থবছরও সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসানের প্রাক্কলন করেছে। সংশ্লিষ্টরা যদিও বলছেন, আগের ধারাবাহিকতায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরও সংস্থাটি লাভে থাকবে। 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপিসির জ্বালানি তেল বিক্রি করে লোকসানের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ তারা বিশ্ববাজারের সঙ্গে দাম সমন্বয় করছে। পাশাপাশি আগের বছরগুলোয় বিশ্ববাজারে তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী হলে দেশের বাজারেও তারা অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিপিসি ভোক্তার কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেল সরবরাহ না করে বরং মুনাফার চিন্তাই বেশি করছে। তাদের যে লাভ-লোকসানের প্রাক্কলন, সেটি স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হচ্ছে না। তাই বিপিসির আর্থিক হিসাব নিরীক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে অডিট করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত যতগুলো প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে অস্বচ্ছ বিপিসি। বেশ কয়েক বছর আগে বিপিসিকে একটা ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা তাদের আর্থিক বিষয়টি স্বচ্ছভাবে খতিয়ে দেখার জন্য বিদেশী অডিট ফার্ম দিয়ে নিরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছিল, কিন্তু সেটি হয়নি। জ্বালানি তেল বিক্রিতে তারা লোকসানের প্রাক্কলন করছে, এখন তো লোকসানের প্রশ্নই ওঠে না। কেননা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে যে দামে কিনবে সে দামেই বিক্রি করবে। অথচ সমন্বয় তো হচ্ছেই না, বরং এখানে তারা অনেক বেশি মুনাফা করছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান তো এভাবে মুনাফা করতে পারে না।’

বিপিসির আর্থিক প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে অনুমোদিত বাজেটে ৩ হাজার ৩৬৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা লোকসানের প্রাক্কলন করেছিল বিপিসি। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা আরো বাড়িয়ে ৭ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা দেখানো হয়। অথচ জ্বালানি তেল বিক্রি করে ওই অর্থবছর শেষে সংস্থাটির কর-পূর্ববর্তী মোট মুনাফা হয়েছিল ৬ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। আর কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয় ৪ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এ সময় সরকারি কোষাগারে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট, লভ্যাংশ, আয়করসহ বিভিন্ন খাতে মোট ১৫ হাজার ৪৯২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জমা দিয়েছে বিপিসি। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে জ্বালানি তেল বিক্রি করে বিপিসির লোকসানের প্রাক্কলন ছিল ১০ হাজার ১৯ কোটি টাকা। অথচ সংশোধিত বাজেটে অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ৩ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা মুনাফা হবে সংস্থাটির। হিসাব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চলতি ও বিগত দুই অর্থবছরে বিপিসি মোট ৮ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা নিট মুনাফা করবে। তাছাড়া চলতি অর্থবছর বিপিসি তার বিক্রীত পণ্যের মোট (পরিচালন) ব্যয়ের প্রাক্কলন করেছিল ১ লাখ ১২ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। যদিও অর্থবছর শেষে সেই ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৭৯ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা।  

বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারে জ্বালানি পণ্য—ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের দাম সমন্বয় করছে জ্বালানি বিভাগ। সে হিসাব বিবেচনায় নিলে বিপিসির জ্বালানি তেল বিক্রিতে লোকসান হওয়ার কথা নয়। তার পরও আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জ্বালানি তেল বিক্রি করে ৫ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা লোকসানের প্রক্ষেপণ করেছে সংস্থাটি। এর যুক্তি হিসেবে জ্বালানি বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ও জ্বালানি তেলের বাজার অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে ধরে নিয়েই এ প্রাক্কলন করা হয়েছে।

জ্বালানি তেল বিক্রিতে লাভ ও লোকসানের প্রাক্কলনের বিষয়ে জ্বালানি বিভাগ ও বিপিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হলেও এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে জ্বালানি বিভাগের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম কেমন হতে পারে—বাজেট প্রণয়নের কয়েক মাস আগেই বিপিসির কাছ থেকে সে হিসাব নিয়ে বরাদ্দ দেয়া হয়ে থাকে। সে সময় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেশি থাকলে বিপিসির লোকসান হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়। তবে অর্থবছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে গেলে সে ক্ষেত্রে প্রাক্কলিত পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে।’

বিশ্ববাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের অংশ হিসেবে চলতি বছরের ৭ মার্চ স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি চালু করেছে সরকার। এ পর্যন্ত চার দফা মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। এতে দেশের বাজারে ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের দাম দুই দফা কমেছে। বেড়েছেও দুই দফায়। তবে বিপিসির দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়া, বিভিন্ন ধাপে জ্বালানি পণ্যের ব্যয় নিয়ে অস্বচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলোর।     

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিপিসি কীভাবে জ্বালানি তেলের দাম হিসাব করে তার প্রক্রিয়া কখনো প্রকাশ করে না। অথচ জ্বালানির দাম নির্ধারণের আন্তর্জাতিক পদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু এসবের তোয়াক্কা না করে বিপিসি জোরপূর্বক দাম নির্ধারণ করে ভোক্তাদের থেকে বাড়তি মূল্য নিচ্ছে। এটা এক ধরনের অন্যায়। তাদের বিরুদ্ধে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থার পক্ষ থেকেও অস্বচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।’  

জ্বালানি তেল বিক্রিতে এক সময় বিপিসিকে ভর্তুকি দিত সরকার। কিন্তু ২০১৪-১৫ অর্থবছরের পর থেকে সংস্থাটি মুনাফা শুরু করে। এরপর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ৪৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে বিপিসি। এর মধ্যে কেবল ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা লোকসান দেয় বিপিসি।

জ্বালানি তেলের লাভ-লোকসানের প্রাক্কলন ও মুনাফার বিষয়ে জানতে বিপিসির চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসানের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন