প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সাত প্রকল্পের জন্য দেয়া হতে পারে ১ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের মোট সাত প্রকল্পের জন্য ১ বিলিয়ন ডলার প্রস্তাব দেয়া হতে পারে। এর মধ্যে মহেশখালীতে এলএনজি সরবরাহের জন্য সমান্তরাল একটি পাইপলাইন। অন্যগুলো বিদ্যুৎ বিভাগের ছয়টি প্রকল্প, যার বেশির ভাগই সঞ্চালন লাইন। সচিবালয়ে গতকাল বাজেট-উত্তর এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এ তথ্য জানান। 

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর এ বেইজিং সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ইতিহাসে আরেকটি মাইলফলক হবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। জাতীয় প্রেস ক্লাবে গতকাল ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিসিএবি) ফ্ল্যাগশিপ ইভেন্ট ডিক্যাব টক অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চীন আরো বেশি কাজ করতে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং।

সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে নসরুল হামিদ বলেন, ‘মহেশখালী থেকে সমান্তরাল পাইপলাইন জিটুজি ভিত্তিতে করার জন্য চীনের কাছে সহায়তা চেয়েছি। আমাদের দুটি এফএসআরইউ (এলএনজি টার্মিনাল) রয়েছে, আরো দুটি এফএসআরইউ করছি, যাতে ২০২৭ সালের পর আর কোনো রকম গ্যাসের সমস্যা না হয়। তখন দৈনিক ছয় হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দরকার হবে। এজন্য গ্যাস সঞ্চালনের জন্য জ্বালানি বিভাগের পক্ষ থেকে এ-সংক্রান্ত একটি সমন্তারাল পাইপলাইন প্রকল্প নেয়া হয়েছে।’

বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকেও ছয়টি প্রকল্প নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, যেগুলোর বেশির ভাগ সঞ্চালন প্রকল্প ও আন্ডারগ্রাউন্ডিং লাইন। এসব প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য চীনকে প্রস্তাব দেয়া হতে পারে বলেও জানান তিনি। সব মিলিয়ে প্রকল্পগুলোয় ঠিক কী পরিমাণ অর্থের প্রস্তাব দেয়া হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।’ 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় সফরে ৮-১০ জুলাই চীন যাবেন। এ সফর নিয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং গতকাল নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বিস্তারিত তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী লি খ্যছিয়াংয়ের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সফর করবেন বলে জানান তিনি। মাও নিং বলেন, ‘নতুন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এটি হবে প্রথম চীন সফর। সর্বশেষ পাঁচ বছর আগে তিনি চীন সফর করেছিলেন। সফরকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। তার আগে প্রধানমন্ত্রী লি খ্যছিয়াং একটি অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন এবং তারা আলোচনায় করবেন।’ দুই নেতা পারস্পরিক সহায়তাবিষয়ক নথিতে সই অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন বলেও চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে জানানো হয়। 

আলোচনার বিষয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী বন্ধুত্ব কীভাবে আরো গভীর এবং পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সহযোগিতা প্রসারিত করা যায়, দুই দেশের নেতারা তা নিয়ে আলোচনা করবেন। পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতেও তারা মতবিনিময় করবেন।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য, ব্যবসা ও বিনিয়োগের সুযোগবিষয়ক শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দেবেন বলে জানিয়ে মাও নিং বলেন, ‘উন্নয়ন ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন কৌশল নিয়ে আমাদের অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কূটনৈতিক সম্পর্কের ৪৯ বছর ধরেই বাংলাদেশ ও চীন পাশাপাশি চলছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দুই দেশ কৌশলগত অংশীদারত্বকে গুরুত্ব দিয়ে সম্পর্কোন্নয়ন করছে। নিজ নিজ মূল স্বার্থ সম্পর্কিত ইস্যুতে একে অন্যকে সমর্থন করেছে এবং যৌথভাবে আধুনিকীকরণ করেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার একটি সুন্দর উদাহরণ স্থাপন করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দুই দেশের নেতাদের কৌশলগত দিকনির্দেশনা ও অঙ্গীকারের মাধ্যমে কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্ব গভীর করেছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ ও বাস্তব সহযোগিতায় এসেছে দুই দেশ।’ 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফরের মাধ্যমে পাঁচটি মূলনীতিকে সামনে রেখে বাংলাদেশের সঙ্গে চীন কাজ করতে প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান মাও নিং। তিনি জানান, মূলনীতিগুলো হলো শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান; পারস্পরিক রাজনৈতিক বিশ্বাসকে আরো গভীর করা; উন্নয়ন কৌশলগুলোকে আরো সমন্বিত করা; উচ্চমানের বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতার অগ্রগতি এবং বৈশ্বিক উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও সিভিলাইজেশন উদ্যোগ বাস্তবায়নের গতি বাড়ানো।

জাতীয় প্রেস ক্লাবে ডিক্যাব টক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে গতকাল কথা বলেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনও। তিনি বলেন, ‘এ সফর বিভিন্ন ক্ষেত্রে “বাস্তব সহযোগিতার নতুন রূপরেখা” তৈরি করবে এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে তাদের অবস্থান সমন্বয়ের সুযোগ করে দেবে। বেশ কয়েকটি সহযোগিতার নথি সই এবং যৌথভাবে বড় ধরনের সহযোগিতার অগ্রগতির ঘোষণা আসবে।’

রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফরের মাধ্যমে উভয় পক্ষ বাস্তবসম্মত সহযোগিতায় নতুন অগ্রগতি অর্জন করবে, যা উভয় দেশের জনগণের জন্য আরো সুবিধা বয়ে আনবে। সফরটি আগামী পাঁচ বছর বা তারও বেশি সময়ে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ককে আরো জোরদার করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।’ 

এ সময় বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার মহাপরিকল্পনা প্রকল্প সম্পর্কে সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে ইয়াও ওয়েন বলেন, ‘তিস্তা নদী বাংলাদেশের ভূখণ্ডে। তাই এটি আপনার নদী। তিস্তা প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশের অনুরোধে চীন আগ্রহ দেখিয়েছে। তিস্তা প্রকল্প যেহেতু বাংলাদেশের এবং তিস্তা বাংলাদেশের নদী তাই এ প্রকল্পে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার বাংলাদেশের। ফলে বাংলাদেশ যে সিদ্ধান্ত নেবে আমরা সেটিকেই সম্মান করব। তিস্তা প্রকল্পের বিষয়ে আমরা বাংলাদেশের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছি।’ তিস্তা প্রকল্পে ভারতের যুক্ত হওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ প্রকল্প নিয়ে চীনের সঙ্গে কারো বিরোধ নেই। বাংলাদেশের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাবে চীন।’

তিনি আরো বলেন, ‘রিজার্ভ সংকট মোকাবেলায় প্রথমবারের মতো সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে একটি সাফল্য আসতে পারে প্রধানমন্ত্রীর সফরে। তবে এখনই সে বিষয়ে কিছু বলতে চাই না।’ 

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন জরুরি। এ বিষয়ে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর পাশাপাশি আসিয়ানকেও ভূমিকা রাখতে হবে। আমরা চাই রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন হোক। প্রত্যাবাসনের জন্য প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত রাখাইনে অস্ত্রবিরতি।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন