কক্সবাজারে বৃষ্টিতে ফের পাহাড় ধসের শঙ্কা

ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ে বসবাস করছে লাখো মানুষ

ছৈয়দ আলম, কক্সবাজার

কক্সবাজারের পাহাড়ে ঝুঁকি বসবাস করে অনেক পরিবার ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার শহরে প্রবেশ করলে প্রথমে চোখে পড়ে কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল। সেখান থেকে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে গেছে কলাতলী পর্যটন জোনের চার লেন সড়ক। সড়কের দুই পাশে ঘন জঙ্গলবেষ্টিত সারি সারি পাহাড়। সেসব পাহাড় পাকা-আধাপাকা দালান ও ঝুপড়িঘরে ঠাসা। কলাতলী থেকে মেরিন ড্রাইভ ধরে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত এ পাহাড়ের পাদদেশে দীর্ঘদিন ধরে চলছে এই ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস।

সারা দেশে আগামী চারদিন মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এছাড়া চার সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সতর্কতায় এলাকায় করা হয়েছে মাইকিং।

প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে কক্সবাজার শহর, মহেশখালী, চকরিয়া, উখিয়া, টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরসহ বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে। এ বছর বর্ষার শুরুতে কক্সবাজারের আট উপজেলায় পাহাড়ে ফাটল ও ধস দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি পৃথক পাহাড় ধসে ১২ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯ জুন রাতে উখিয়া উপজেলার পালংখালীতে পাঁচটি স্থানে পাহাড়ধসে স্থানীয় দুই ব্যক্তি ও আট রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে কক্সবাজার শহরের বাদশাঘোনায় পাহাড়ধসে নিহত হয়েছে এক দম্পতি।

পরিবেশকর্মীরা জানান, জেলা সদর, উখিয়া, টেকনাফ, রামু, ঈদগাঁও, চকরিয়া, পেকুয়া ও মহেশখালীতে অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে। বর্ষা এলে স্থানীয় প্রশাসন ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে সরে যেতে মাইকিং করে। এছাড়া কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। তবে জেলায় পাহাড়ে অবৈধ বসতি ও ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীর সঠিক পরিসংখ্যান নেই সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তরে।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের নয় উপজেলার মধ্যে কুতুবদিয়া ছাড়া বাকি আট উপজেলার এক-তৃতীয়াংশ বনভূমি। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর পাহাড়ের বিস্তীর্ণ বনভূমির একটি বড় অংশ গত দুই দশক ধরে দখল হয়ে গেছে।

কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের তথ্য মতে, গত ১০ বছরে এ বিভাগের অধীন ১৩ হাজার ৩৪৭ একর বনভূমি সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ বিভাগের ৭৬ হাজার ৪৫৭ একর বনভূমির মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে দখলে গেছে ১২ হাজার ৬০৫ একর।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের ১ লাখ ২০ হাজার ৫৮৩ একর বনভূমির মধ্যে বড় অংশ হাতছাড়া হয়েছে। এর মধ্যে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা শিবির রয়েছে প্রায় ১৫ হাজার একর বনভূমিজুড়ে। রোহিঙ্গা শিবিরের আশপাশের পাহাড়েও গড়ে উঠছে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি।

কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘‌পাহাড়ে অবৈধ দখলদারের বিরুদ্ধে বন বিভাগের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে। বেদখল হওয়া বনভূমি উদ্ধারে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন কক্সবাজার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ কলিম বলেন, ‘‌কক্সবাজারে পাহাড় নিধনের ভয়ানক পরিস্থিতি সম্পর্কে সবাই অবগত। কিন্তু কোনো সংস্থা কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছে না। এক্ষেত্রে পাহাড় রক্ষায় সংশ্লিষ্ট দপ্তর, প্রতিষ্ঠান ও বাহিনীর সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা খুবই প্রয়োজন।’

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, ‘‌পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সতর্ক করে নিয়মিত প্রচার চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বসতির তালিকা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’

এদিকে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি শিবিরে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত অন্তত ১২ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এসব ক্যাম্পের মধ্যে উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নে ৭ থেকে ১১ নম্বর ক্যাম্পে ৫ হাজার ৫০০টি বসতঘর পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে।

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ক্যাম্পে পাহাড়ধসে ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। বেশির ভাগ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে গত তিন বছরে।

এ নিয়ে কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঝুঁকিতে থাকা পরিবারগুলোকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু হয়েছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন