জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

এক বছরের বেশি সময় ধরে চলছে সিসিইউ সংস্কার!

অস্থায়ী সিসিইউতে অপ্রতুল সেবা

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

হৃদরোগ চিকিৎসায় দেশের একমাত্র বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইসিভিডি)। সংস্কারকাজের কারণে ১ হাজার ২৫০ শয্যার এ হাসপাতালের মূল করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) বন্ধ রয়েছে এক বছরের বেশি সময় ধরে। এ অবস্থায় জরুরি সেবা দেয়া হচ্ছে অস্থায়ী সিসিইউতে। 

স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎসা নিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রচুর রোগী এ হাসপাতালে আসে। তাদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের রোগীও অনেক, যাদের তাৎক্ষণিক সেবা খুবই জরুরি। এ ধরনের রোগীকে অনেক সময় জরুরি ভিত্তিতে সিসিইউতে চিকিৎসা দিতে হয়। কিন্তু এনআইসিভিডির অস্থায়ী সিসিইউতে প্রয়োজনীয় ও জরুরি অনেক সেবা পাওয়া যাচ্ছে না বলে বিভিন্ন সময় অভিযোগ তুলেছেন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা। যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, প্রয়োজনীয় সব সেবাই অস্থায়ী সিসিইউতে রয়েছে। এখানে রোগী ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসাসেবায় কোনো ঘাটতি নেই।

প্রতিষ্ঠানটির মূল ভবনের দ্বিতীয় তলায় সামনের দিকে সিসিইউর অবস্থান। শয্যা সংখ্যা ছিল ৩৮। ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ দিকে এর সংস্কার শুরু করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। ওই সময় দক্ষিণ ভবনের দ্বিতীয় তলায় স্থানান্তর করা হয় সিসিইউ। কিন্তু এর মধ্যে আরেকটি অর্থবছর চলে গেলেও সংস্কার সম্পন্ন হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, কাজ শেষ হতে আরো চার মাস লাগতে পারে। 

সরজমিনে দেখা যায়, সিসিইউর মেঝে ও দেয়ালের কিছু অংশের কাজ চলছে। মেঝে ঢালাইয়ের কাজ চলছে। বাকি রয়েছে দেয়াল ও ছাদের পলেস্তারার কাজ। সব মিলিয়ে এখনো সংস্কারের প্রায় অর্ধেক কাজ বাকি। 

অস্থায়ী সিসিইউতে গিয়ে দেখা গেছে, এখানে ৩৮ শয্যার সুবিধা থাকলেও ব্যবস্থাপনার ঘাটতি রয়েছে। পর্যাপ্ত শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র না থাকায় চলছে বৈদ্যুতিক পাখা। মেঝেতেও রোগীদের চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে। জনাকীর্ণ ইউনিটটিতে রোগীর তুলনায় স্বজন ও অন্যান্য লোকজনের উপস্থিতি বেশি।

জনাকীর্ণ সিসিইউকে সংকটাপন্ন রোগীদের যথাযথ  চিকিৎসাসেবার বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কার্ডিওভাসকুলার অ্যান্ড থোরাসিক অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের (বিএসিটিএ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. এটিএম খলিলুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সিসিইউতে একজন রোগী যেন অন্য রোগীর পরিস্থিতি দেখতে না পারে, তার ব্যবস্থা থাকতে হবে। কেননা রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন থাকে, কাউকে সিপিআর দেয়া হয়, কেউ দেখা যাচ্ছে হঠাৎ মারা যাচ্ছে। পাশের রোগী বিষয়টি দেখলে ঘাবড়ে যাবে এবং আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। সিসিইউতে যেমন হৃদরোগীদের জরুরি চিকিৎসা দেয়া হয়, তেমনি তাদের কারো কারো জন্য কাউন্সেলিংয়েরও প্রয়োজন হতে পারে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘সিসিইউ মানে শুধু অবকাঠামো নয়। এখানে যেমন দক্ষ চিকিৎসক ও নার্সের দল থাকবে, তেমনি জরুরি চিকিৎসাযন্ত্রের সুবিধা ও ওষুধ থাকতে হবে। হাসপাতালে আনার পর হার্টের রোগীকে দেখেই চিকিৎসকরা কিছু বিষয় বুঝতে পারেন। অনেক বিষয় পরীক্ষা না করে বোঝা যায় না। ফলে তাদের অবস্থা তাৎক্ষণিক বোঝার জন্য এবং রোগীকে পুনরুদ্ধার করার জন্য সিসিইউতে নেয়া হয়। সেখানে ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাফি (ইসিজি), অক্সিজেন স্যাচুরেশনের পোর্ট ও কার্ডিয়াক মনিটর থাকতে হবে। প্রয়োজনীয় ওষুধও থাকতে হয়। অক্সিজেন, এয়ারওয়ে দেয়া, হার্টে বেলুন দেয়া, এমনকি ক্যাথল্যাবের সুবিধাও জরুরি।’

জানা গেছে, মূল সিসিইউর অবকাঠামো সংস্কারের পর এখানে গণপূর্ত অধিদপ্তরের ইলেকট্রনিকস ও ইলেট্রিক্যাল বিভাগ কাজ করবে। ওই কাজের জন্য সোয়া ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও বৈদ্যুতিক অন্যান্য কাজ করা হবে। তবে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে অর্থছাড় ও দরপত্র আহ্বানের নির্দেশনা দেয়া হয় গত মে মাসে। স্বল্প সময়ের মধ্যে দরপত্র আহ্বান করে বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রসমগ্রী এনে তার সংযোগ দেয়া সম্ভব না হওয়ায় গণপূর্ত অধিদপ্তর বিষয়টি জানায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে। 

ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অবকাঠামোর সংস্কার শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ইলেট্রিক্যাল কিছু কিছু কাজ করতে হবে অবকাঠামোর সংস্কার শেষের আগেই। কিছু কাজ করতে হবে পরে। এ কাজের জন্য বরাদ্দ যে সময়ে এসেছে তা গত অর্থবছরে শেষ করা সম্ভব হয়নি। ফলে ওই বরাদ্দ নতুন অর্থবছরে সমন্বয় করা হবে। বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে এরই মধ্যে অবহিত করা হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে পরিদর্শনও করা হতে পারে।

হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব রোগী জরুরি বিভাগে আসে তাদের মধ্যে সংকটাপন্ন রোগীদের নেয়া হয় সিসিইউতে। অবস্থার উন্নতি হলে সেখান থেকে নেয়া হয় হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ)। অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন না হলে রোগীকে প্রি-সিসিইউতে রাখা হয়। অন্যদিকে অস্ত্রোপচারের পর রোগীকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়। এরপর অবস্থা অনুযায়ী নেয়া হয় এইচডিইউতে, পরে পাঠানো হয় ওয়ার্ডে। ভর্তি রোগীদের মধ্যেও কারো অবস্থা সংকটাপন্ন হলে তাকে সিসিইউতে নেয়া হয়। 

সরকারের তথ্য বলছে, এ হাসপাতালে গত বছর দুই লাখের বেশি মানুষ বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে। ভর্তি ছিল ৯৬ হাজারের বেশি রোগী। বছরজুড়ে হাসপাতালে বড় ধরনের অস্ত্রোপচার হয়েছে ৩ হাজার ৬০০ জনের। ছোট পরিসরে অস্ত্রোপচার হয়েছে পৌনে ১৭ হাজার। 

জানতে চাইলে এনআইসিভিডির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা সিসিইউর সেবা চলমান রাখতে অস্থায়ী ভিত্তিতে একটি ইউনিট চালিয়ে নিচ্ছি। একটি আদর্শ সিসিইউতে যা যা থাকার কথা, তার সবকিছুই সেখানে রয়েছে। আমরা সেবার কোনো অভাব বোধ করছি না। মূল সিসিইউর সংস্কার কার্যক্রম যে পর্যায়ে রয়েছে, তা তিন-চার মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে বলে আশা করি। মূল সিসিইউ চালু করার পরও বিদ্যমান ইউনিটটি চালু রাখা হতে পারে। কেননা বিদ্যমান ইউনিটও আমরা যথাযথভাবে সাজিয়েছি।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন