খাদ্য ব্যবসা নিবন্ধন

নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের উদ্যোগ যেন হয়রানির হাতিয়ার না হয়

ছবি : বণিক বার্তা

নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। এটি নিশ্চিতের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তবে নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তির পাশাপাশি খাদ্য ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরানোও প্রয়োজন। কিন্তু কোনো নিবন্ধনের সুযোগ না থাকায় যত্রতত্র মানহীন হোটেল, খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান গড়ে উঠছে। ফলে মানুষ নিম্নমানের খাবার গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। নিরাপদ খাদ্য সরবরাহে সরকারের সদিচ্ছা ও প্রচেষ্টার কমতি নেই। তবু উৎপাদন, সরবরাহ শৃঙ্খলের নানা ধাপ থেকে শুরু করে হোটেল-রেস্তোরাঁ ও ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকানের সব পর্যায়ে ভেজাল, মানহীন ও অনিরাপদ খাদ্য এখনো রোধ করা সম্ভব হয়নি। খাদ্য ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরাতে খাদ্য ব্যবসায় সম্পৃক্ত সবার জন্য বাধ্যতামূলক নিবন্ধন ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ)। এরই মধ্যে তারা এ বিষয়ে একটি খসড়া প্রবিধানমালা খাদ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খাদ্য ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরাতে ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে এটি একটি ভালো উদ্যোগ হতে পারে। তবে প্রবিধানের সঠিক প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তবে এর অপপ্রয়োগ হলে নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত কঠিন হবে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের উদ্যোগ যেন হয়রানির হাতিয়ার না হয়। তাই এক্ষেত্রে সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। 

বেড়ে চলা শিল্পদূষণ ও কৃষি উৎপাদনে রাসায়নিক নির্ভরতার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের বিষয়টি অনেকদিন ধরে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় এজেন্ডায় পরিণত হয়েছে। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক সংস্থার তৎপরতা বাড়িয়েছে সরকার। সময়োপযোগী নতুন আইন প্রণয়ন ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ নামে আলাদা সংস্থা করা হয়েছে। আলোচ্য সংস্থা মানসম্মত পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি নিয়মিত তদারকও করছে। এর পরও থেমে নেই মানহীন খাদ্যপণ্য উৎপাদন। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পরীক্ষায় এখনো নিম্নমানের খাদ্যপণ্য ধরা পড়ছে। সরকারি অভিযানে বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্টে অনিরাপদ, মানহীন খাবারের সন্ধান মিলছে; যা জনস্বাস্থ্যের জন্য রীতিমতো আশঙ্কাজনক বৈকি। তবে প্রতিষ্ঠানটির দাবি, খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, মজুদ, সরবরাহ, বিপণন, আমদানি, রফতানি ও বিক্রির সঙ্গে সম্পৃক্ত কাউকে বিএফএসএ থেকে নিবন্ধন নিতে হয় না। এ কারণে এ ব্যবসায় শৃঙ্খলা ফিরছে না। তবে খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে বিএফএসএ থেকে নিবন্ধন নিলে খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শৃঙ্খলা ফিরতে পারে বলে আশা করা যায়। নিবন্ধনের প্রক্রিয়াটি হতে হবে স্বচ্ছ। এক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়মকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। সঠিক যাচাই-বাছাই না করে মানহীন খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে মানসম্মত খাদ্য উৎপাদনের নিবন্ধন দেয়া হলে সেটা হবে আরো ভয়ানক। তাই সবদিক বিবেচনায় নিয়ে আইনটি কার্যকর করা উচিত। 

নিরাপদ খাদ্যের ইস্যুটি বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই। এটি পুরো খাদ্য ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত। নাগরিকের চাহিদামতো নিরাপদ খাদ্যের লভ্যতা নিশ্চিত করতে হলে খাদ্য ব্যবস্থার প্রতিটি ধাপ যেকোনো মূল্যে নিরাপদ করতে হবে। এজন্য দরকার খাদ্য ব্যবস্থায় অংশীজনদের সচেতনতা ও দায়িত্বশীল আচরণ। সরকার খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। রফতানি বাড়ানো গেলে এটি প্রবৃদ্ধির অন্যতম নতুন চালক হতে পারে। তবে রফতানি করতে হলে খাদ্যের মান বাড়ানো ও খাদ্য পরীক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। কাজটি করতে হলে কেন্দ্রীয়ভাবে মান পরীক্ষার পাশাপাশি প্রত্যেক বিভাগীয় শহর থেকে শুরু করে ইউনিয়ন বা গ্রাম পর্যায়েও ফুড টেস্টিং ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। ধীরে ধীরে এক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। 

উৎপাদনশীলতার সঙ্গেও নিরাপদ খাদ্যের একটা যোগসূত্র আছে। নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ সরকার। কিন্তু মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবান ও কর্মক্ষম জনশক্তির বিকল্প নেই। আর তার জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। অথচ বাস্তবতা হলো, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় যেখানে পুষ্টিসমৃদ্ধ এবং গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্য গ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশের মানুষ উপায়হীন হয়ে নিম্নমানের খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত হচ্ছে। ফলে তারা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উৎপাদনশীলতা দেখাতে পারছে না। 

দেখা যাচ্ছে, কিছুদিন পরপরই কর্তৃপক্ষ ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিস্বরূপ আর্থিক জরিমানা করছে। জরিমানা দিয়ে আবার একই ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে তারা। কাজেই অনিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রি বন্ধে শুধু জরিমানামূলক শাস্তি নয়; সরকারকে কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সময় এসেছে। প্রয়োজনে ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করতে হবে। বর্তমানে অনলাইনে খাবারের অর্ডার একটি নতুন প্রপঞ্চ। সময় সাশ্রয় ও ঝামেলা এড়াতে অনেকেই এদিকে ঝুঁকছে। কিন্তু এক্ষেত্রে যথাযথ মান ও বাঞ্ছনীয় পণ্য না পাওয়া নিয়ে ভোক্তার অভিযোগ এন্তার। এরও একটা বিহিত জরুরি। পাশাপাশি ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধিতেও প্রচার-প্রচারণা বাড়ানো দরকার।

নিরাপদ খাদ্যের কার্যক্রমটি বর্তমানে একাধিক মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হওয়ায় সমন্বয়ের অভাব প্রকট। এক্ষেত্রে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকেই আরো শক্তিশালী করা প্রয়োজন। পাশাপাশি মান নিয়ন্ত্রক হিসেবে বিএসটিআইয়ের গবেষণা ও তদারকি আরো বাড়াতে হবে। এশিয়ার মধ্যে সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় শক্তিশালী খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রক ও তদারকি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বে মানহীন ও ভেজাল খাদ্য রোধে যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ সুবিদিত। দেশে খাদ্যপণ্যের বাজার সম্প্রসারণের বিপরীতে নজরদারির প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এখনো অপ্রতুল। এ বাস্তবতায় উল্লিখিত দেশের সংস্থাগুলোর নীতি ও কার্যক্রম পর্যালোচনা করে এখানে কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা আরো বাড়ানো যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। নইলে সর্বস্তরে জনগণের জন্য নিরাপদ খাদ্য জোগানো কঠিন হবে বৈকি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন