আলোকপাত

সিন্ডিকেট শুধুই কি বিধিসংস্থা ও সরকারের ব্যর্থতা ঢাকার আবরণ

ড. সাজ্জাদ জহির

ছবি : বণিক বার্তা

দেশে পেঁয়াজের দাম হঠাৎ করে ২০০ টাকা ছাড়াল, দোষ কার—সিন্ডিকেটের। অতি মূল্যবান পশুর চামড়া দাম পাচ্ছে না, দোষ সিন্ডিকেটের। চাল-ডাল-আলু-পটোল-তেল-নুনের দাম কমানো যাচ্ছে না, দায়ী সিন্ডিকেট। যত দোষ নন্দ ঘোষকে দিয়েই যেন সরকার তার দায় সারছে। কয়েক বছর ধরে প্রতিটি ক্ষেত্রেই অঘটন দেখলে দোষ দেয়া হয় সিন্ডিকেটকে। অথচ বাজারের নেপথ্যের অপরাধীদের চিহ্নিত না করে ‘সিন্ডিকেটমুক্ত’ বাজার প্রতিষ্ঠার আওয়াজ তুলে অনেক সময়ই বাজার সচল রাখতে সচেষ্ট ক্রীড়কদের ওপর আঘাত হানা হয়। সে কারণেই এটা জরুরি যে সিন্ডিকেটকে ঢালাওভাবে খারাপ চিহ্নিত না করে তার ইতিবাচক ভূমিকা ধর্তব্যে এনে সরকারি কর্মপন্থা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। 

সিন্ডিকেটের নানারূপ: সাধারণত, ব্যবসাজগতে সিন্ডিকেট বলতে কিছু ব্যবসায়ীগোষ্ঠীর মধ্যকার জোট বাঁধাকে বোঝায়। কোনো বৃহৎ আকারের কাজ সম্পাদনের উদ্দেশ্যে, ভিন্নধর্মী পারদর্শিতার সমন্বয় ঘটানোর জন্য, একাধিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সাময়িককালের জন্য ‘সিন্ডিকেট’ গঠন করতে পারে, যা কার্য সম্পাদনের পর বিলুপ্ত হয়। এর ব্যতিক্রম দেখা যায় ব্যাংক খাতে, যেখানে ‘সিন্ডিকেশন’-এর মাধ্যমে কয়েকটি ব্যাংক একত্র হয়ে বৃহৎ অংকের প্রকল্প ঋণ দেয়। এ ব্যবস্থার ফলে ঋণ দেয়ার ঝুঁকির দায়ে অনেকের অংশীদারত্ব থাকে এবং একক পর্যায়ে ঝুঁকি কম হয়। এসব দৃষ্টান্তে সিন্ডিকেট নামক জোট গঠনকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে এবং সুষ্ঠু সরবরাহ নিশ্চিত করতে সিন্ডিকেটের ভূমিকার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। একইভাবে যেকোনো বাজারে সীমিতসংখ্যক উৎপাদক বা সরবরাহকারীর আন্তঃসমন্বয়কারী সংস্থা, বিধিসম্মত লেনদেন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। অর্থাৎ বাজারের ক্রীড়কদের আচরণ বিধিসম্মত কিনা তা নিশ্চিত করায় নিযুক্ত সংস্থার (অর্থাৎ রেগুলেটরের) কাজকে সহজ করতে সিন্ডিকেট ও সিন্ডিকেটসম ব্যবসায়ী সংগঠনের সম্ভাব্য ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। ইংরেজি শব্দ ‘রেগুলেটর’-এর বাংলা রূপান্তর হিসেবে নিয়ন্ত্রক (অর্থাৎ কন্ট্রোলার) শব্দটি ধারণাগতভাবে বেমানান। বিধি-পালন নিশ্চিতকারী সংস্থা অতি দীর্ঘ হওয়ার কারণে রেগুলেটরি সংস্থাকে ‘বিধিসংস্থা’ নামে আখ্যায়িত করব। উল্লেখ্য যে, ক্রেতাদের নিয়েও সিন্ডিকেট গঠন হতে পারে। তবে এ নিবন্ধে কেবল সরবরাহের দিকের সিন্ডিকেট আলোচনা করা হয়েছে।

সিন্ডিকেট গঠনের পেছনে অনেক ক্ষেত্রে ভালো উদ্দেশ্য থাকলেও এটা অনস্বীকার্য যে সিন্ডিকেট গঠনের ফলে সৃষ্ট গোষ্ঠীক্ষমতা অনেক সময় বাজার ব্যবস্থার কল্যাণমুখী অবদানকে খর্ব করে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কোনো বাজারে ক্ষুদ্র স্বার্থের পক্ষে আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে গুটিকতক সংস্থা সিন্ডিকেটে জোটবদ্ধ হতে পারে অথবা স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠা জোটকে (সিন্ডিকেট) কোনো বহিঃশক্তি নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। সম্ভবত সে কারণেই সিন্ডিকেট গঠনকে অনেকে প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থার পরিপন্থী গণ্য করে। অস্থিতিশীল বাজারে, বিশেষত বাজারদাম বৃদ্ধিকালে, কোনো কোনো বিধিসংস্থার অত্যুৎসাহের ফলে ‘সিন্ডিকেট’কে দানবরূপে দেখানোর মাত্রা বৃদ্ধি পায়। দুঃখজনক যে এ হুজুগের সঙ্গে সায় দেয় আমাদের দেশের কিছুসংখ্যক প্রচারমাধ্যম এবং (বুদ্ধি বিক্রয়কারী) অনেক ব্যক্তি ও সংস্থা, যারা সিন্ডিকেটের দ্বৈত চরিত্র ধর্তব্যে আনতে ভুলে যায়। বুঝে হোক বা না বুঝে হোক, অনেকেই তাই গোষ্ঠী বা একচেটিয়া সিন্ডিকেট স্বার্থের প্রসার প্রতিহত করার নামে নির্বিচারে ‘প্রতিযোগিতা আইন’ প্রয়োগের ‘ডাণ্ডাবাজি’ সংস্করণের পক্ষ নেয়! ভ্রান্ত ধ্যানধারণা খণ্ডন করা হলেও ‘দানবরূপী’ সিন্ডিকেটের বারবার পুনর্জাগরণ ঘটে, যা অনেক ক্ষেত্রে সর্বনাশার ইঙ্গিত দেয়। একদিকে বিধিসংস্থাগুলোকে ‘সিন্ডিকেট’-এর ওপর দোষ চাপিয়ে নিজেদের দায় এড়াতে সচেষ্ট হতে দেখা যায়। অন্যদিকে স্থানীয় ‘সিন্ডিকেট’দের বাধা হিসেবে গণ্য করে, সেই বাজারে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে বাইরের স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সিন্ডিকেটবিরোধী উগ্র মনোভাবে ইন্ধন জোগায়।

ওই ব্যাখ্যায়, একটি দেশের রাজনৈতিক দল বা সরকারও একটি সিন্ডিকেট, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে জোট বেঁধে সমাজ ও অর্থনীতির বিবিধ অঙ্গনে, প্রণীত বা চাপিয়ে দেয়া আইনের আশ্রয়ে, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই অন্য পাঁচটি সিন্ডিকেটের মতো একটি দেশের সরকার সুশাসন ও প্রজ্ঞাবলে জনগণের যেমন মঙ্গল আনতে পারে, একইভাবে অপকর্মের মাধ্যমে অথবা প্রজ্ঞার অভাবে তারা জনজীবনকে অতিষ্ঠ করতে পারে। একই সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে রাজনীতির অঙ্গনে সিন্ডিকেট প্রতিদ্বন্দ্বিতা (যুদ্ধ ও সহাবস্থান) চলতে পারে। তাই স্বাধীন সত্তা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্থানীয় একটি (সিন্ডিকেটরূপী) সরকার বিদেশী শক্তির সম্প্রসারণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে সক্ষম।

সাধারণ বৈশিষ্ট্যের বাইরে সিন্ডিকেট গঠন ও বিন্যাসের অতিরিক্ত তিনটি দিক উল্লেখ করব, যা উভয় ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজনীতির অঙ্গনে সিন্ডিকেট গঠন প্রক্রিয়া বোঝার জন্য প্রাসঙ্গিক। প্রথমত, সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনে সিন্ডিকেটের মতো সংগঠন গড়ে উঠলে তাদের সমন্বয় করার জন্য একক কোনো সংস্থা বা ব্যক্তির উদ্ভব ঘটা স্বাভাবিক, যা বৃহত্তর সিন্ডিকেটের জন্ম দেয়। দ্বিতীয়ত, সুষ্ঠুভাবে কার্য পরিচালনার জন্য একটি প্রতিষ্ঠিত সিন্ডিকেট, খাতভিত্তিক দায়িত্ব বণ্টনের উদ্দেশ্যে অনেকগুলো অধীনস্থ সিন্ডিকেটের জন্ম দিতে পারে। রাজ্যকার্য পরিচালনার ইতিহাসে এ দুই ধারারই দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। স্থানীয় সামন্তরা একত্র হয়ে শশাঙ্ককে রাজা বানিয়ে নেয়ার কাহিনী যেমন রয়েছে, তেমনি দূরবর্তী মসনদ থেকে সুবেদারনিয়োগের প্রথা বারবার দেখা গেছে। তৃতীয় লক্ষণীয় দিক হলো, সিন্ডিকেটের সঙ্গে তাদের কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বরত বিধিসংস্থার মধ্যকার সম্পর্ক সবসময় একমুখী নয়। কোনো কোনো খাতের ‘সিন্ডিকেট’ এতই ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে যে তারাই বিধিসংস্থার কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে। এক্ষেত্রে কেউ কেউ বলতে পারেন যে নির্দিষ্ট কোনো খাতে উন্নতি আনতে চাইলে সেখানকার সুবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তাদের স্বতঃপ্রণোদিত আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য সেই ধরনের প্রভাব প্রয়োজন। বাজার ব্যবস্থার ঊর্ধ্বে থেকে সরকারি প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং রাজনীতিবিদরা যে নৈর্ব্যক্তিক ভূমিকায় রাখবেন, এ ব্যাপারে শঙ্কা থাকার কারণেই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটদের মধ্যে এজাতীয় ভাবনা জাগে। তবে দুর্বল দেশে সরকারি নিয়ন্ত্রণে স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ অধিক থাকায় ক্ষুদ্র গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করতে এ জাতীয় অংশগ্রহণ অধিক লক্ষণীয়। যে উদ্দেশ্যেই হোক না কেন, রাজনীতির মাধ্যম ব্যতিরেকে বিধিসংস্থার ওপর সিন্ডিকেটের আধিপত্য নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই সমাজ ও অর্থনীতির স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য উপযোগী ও আবশ্যিক জোটগুলোকে (বা সিন্ডিকেটকে) ধ্বংস করতে সচেষ্ট অশুভ সিন্ডিকেট থেকে মুক্তি পেতে হলে রাজনীতির অঙ্গনে পরিবর্তন জরুরি। 

নিত্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেট: নাগরিক ভাবনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে খুচরা বাজারকে নিয়ে, যেখানে দাম নিয়ন্ত্রণের কারসাজি থাকতে পারে বলে অনেকেরই ধারণা। সাধারণত সনাতনী প্রথায় ভোগ্যপণ্যের খুচরা বাজারে একজন বিক্রেতা স্বনিয়োজিত এবং দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ সীমিত হওয়ায় সংসারের ভরণপোষণ মেটাতে তারা মার্জিনের মাত্রা অধিক রাখে। এটা অবশ্য সিন্ডিকেটের উপস্থিতি প্রমাণ করে না। বরং সম্মিলিতভাবে ন্যূনতম দাম ধার্য জোট গঠনের বা নেপথ্য নিয়ন্ত্রণের ইঙ্গিত দেয়। খোঁজ নিলে জানা যাবে যে, একটি বাজার বা একটি এলাকার কয়েকটি খুচরা বাজারে কোনো একটি পণ্য (যেমন মুরগি বা ডিম) ধারেকাছে অবস্থিত একটি আড়ত থেকে সরবরাহ করা হয়। এসব এলাকাভিত্তিক আড়তদারদের পেছনে অনুমেয় যে বড় ব্যবসায়ী বা আড়তদার রয়েছে। এটা অবাক হওয়ার নয় যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক একচেটিয়া ব্যবসায়ীর উদ্ভব ঘটতে পারে, যে বা যারা ক্রয়ক্ষমতা বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন বাজারে ভিন্ন ভিন্ন দাম ধার্য করতে পারে। কিন্তু যারা দীর্ঘকালীন ব্যবসায়ী, তারা কি বাজারের (ক্রেতাদের) ক্রয়ক্ষমতা উপেক্ষা করে এবং দাম ওঠানামার সাধারণ রীতি অগ্রাহ্য করে অতিমাত্রায় মজুদ বা অতিরিক্ত দাম ধার্য করতে চাইবে? এ কাজ তাদের দিয়েই সম্ভব যারা স্বল্পমেয়াদে পটে অবতীর্ণ হয় এবং অতিদ্রুত অর্থ আত্মসাৎ করে বেরোতে চায়, যেমনটি স্বল্পমেয়াদি শেয়ার কেনাবেচার বাজারের খেলুড়েরা করে। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের মাঝে এ আচরণ দেখা গেলে বলতে হয়, তারা ব্যবসা পরিবর্তন বা দেশান্তরে আগ্রহী। অন্যথায় বাজারের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের ব্যাখ্যা দিতে তৃতীয় কোনো ব্যবসা-বহির্ভূত শক্তির উপস্থিতি ও বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। 

চাঁদাবাজ নামক তথাকথিত রক্ষকদের বাইরে এই তৃতীয় শক্তি দেখা যায় আমদানির ক্ষেত্রে, যেখানে সিন্ডিকেট গঠনে সরকারের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে আমদানি লাইসেন্স দেয়া অথবা বৈদেশিক মুদ্রা পেতে সহায়তার মাধ্যমে। দেশে পণ্য আমদানির পর সেই সিন্ডিকেটকে অভ্যন্তরীণ পরিবহন ও বিপণন ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে হয়। বিভিন্ন স্তরে মজুদের পরিমাণ নির্ধারণ সাধারণত প্রত্যাশিত বাজারদামের ওপর নির্ভরশীল। তবে সিন্ডিকেট কর্তৃক আমদানিদামের ঊর্ধ্বে বাজারদাম নির্ধারণ কেবল শীর্ষে (আমদানিকালে) অবস্থিত স্বল্পসংখ্যক ব্যবসায়ীর পক্ষে সম্ভব। বহুসংখ্যক আমদানিকারক থাকলেও অধিক আমদানিতে পরিবহন খরচ সাশ্রয়ের ফলে সিন্ডিকেট বা একচেটিয়া বাজার উদ্ভবের সম্ভাবনা রয়েই যায়। ১৯৯০-এর দশকে বেসরকারিভাবে গম আমদানিকালে যে গ্রেইন মার্চেন্ট নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক বাজার কাঠামো ছিল, তার কাঠামোগত পরিবর্তন না হলেও এখনকার আমদানি লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বাইরের গ্রুপগুলোর সঙ্গে অধিকতর সম্পৃক্ত। লক্ষণীয় যে, আঞ্চলিক পর্যায়ে সম্পদশালী ব্যবসাগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছে, যারা নিজ দেশের সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পায় এবং পার্শ্ববর্তী ছোট ছোট দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে নিজেদের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করতে সচেষ্ট। বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়ে দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ্য যে মিয়ানমার থেকে ডাল বা অন্য শস্যবীজ সংগ্রহ করে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা অন্য দেশে বিক্রয় করতেন। ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশকে পার্শ্ববর্তী দেশের বাণিজ্য সংস্থার ওপর নির্ভর করতে হয়, যে আমদানি সিন্ডিকেটে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ীরাও সক্রিয়ভাবে জড়িত। এ সমগ্র প্রক্রিয়াকে আমরা ঠগবাজি সিন্ডিকেট আখ্যা দেব, নাকি বিশেষ বাজার ও পরিবহন ব্যবস্থার স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে গণ্য করব তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। হয়তো দুটোই সত্য!

পরিশেষে বলব, বাংলাদেশ সমাজে সিন্ডিকেটকে একটি অদৃশ্য অশুভশক্তি হিসেবে দেখানো হয়। আজকাল যেমন অজানা ভাইরাসকে রোগবিদ্যায় করোনা আখ্যা দেয়ার প্রবণতা রয়েছে, তেমনি বাজার ব্যবস্থায় অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ফল দেখলেই তার জন্য অদৃশ্য সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয়! অথচ সমাজ ও বাজার ব্যবস্থা সংগঠিত হতে ‘সিন্ডিকেট’ বা ‘সিন্ডিকেটধর্মী’ সংগঠনের প্রয়োজন। বিশেষত বাজারের সব ক্রীড়ক যেন বিধিসম্মতভাবে কার্য পরিচালনা করে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্দিষ্ট বিধিসংস্থার এবং সেসব বাজারে ব্যবসায়ী জোট থাকলে তারা সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে। অবশ্য সেটা নিশ্চিত করার মুখ্য দায়িত্ব ওই সব বিধিসংস্থার। তাদের ব্যর্থতার ফলে ব্যবসায়ী জোট অসাধু কর্মকাণ্ড চালাতে পারে। এ ব্যর্থতা ঢাকার জন্য অসাধু ব্যক্তি ব্যবসায়ী বা সংস্থাকে চিহ্নিত করে উপযুক্ত (শাস্তিমূলক) পদক্ষেপ না নিয়ে ‘সিন্ডিকেট’-এর ধুয়ো তোলা আজ নিত্যকার ঘটনা। এ একপেশে অবস্থানের ফলে যেসব অঙ্গনে ভালো ‘সিন্ডিকেট’ রয়েছে এবং যারা (রাষ্ট্রীয় বিধি লঙ্ঘন না করে) বিদেশী শক্তিকে রুখে দেশীয় সত্তার বিকাশ সাধন করার সম্ভাবনা রাখে সেসব শুভশক্তির অস্তিত্ব আজ বিপন্ন।

দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কর্তৃপক্ষ, ভোক্তা অধিকার দপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা, সংবাদকর্মী এবং আমার মতো বুদ্ধি বিক্রেতাদের প্রতি আহ্বান জানাব, তারা যেন সিন্ডিকেট নামক বায়বীয় জুজুর ভয় দেখিয়ে ব্যবসা ও সমাজ অঙ্গনের স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠা এবং বাজার ব্যবস্থা সচল রাখার জন্য আবশ্যকীয় জোট/সিন্ডিকেট ধ্বংস করতে মদদ না জোগান। অবশ্যই বাজারে ও সমাজ-রাজনীতিতে দুষ্ট চক্র রয়েছে, যারা নাগরিকের কষ্টার্জিত আয় ও সঞ্চয় নিংড়ে নিতে সদা উন্মুখ। বাজারের সহজাত সংস্থার ধ্বংসযজ্ঞে না নেমে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে, অর্থবাজারে এবং রাজনীতির অঙ্গনের সেসব দুষ্ট চক্রকে চিহ্নিত করে তাদের অপকর্ম দমনের উদ্যোগ নেয়া জরুরি।

ড. সাজ্জাদ জহির: নির্বাহী পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ (ইআরজি)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন