বাজেট বিশ্লেষণ

ব্যাংক থেকে বেসরকারি খাত ঋণ না পেলে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও কর্মসংস্থান বাড়বে না

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

ছবি : বণিক বার্তা

২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। এ বাজেট নিয়ে মোটাদাগে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিভিন্ন সংকট চলছে ও সামনে অর্থনীতির অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কিন্তু এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাজেটে কোনো নতুনত্ব লক্ষ করা যাচ্ছে না। বিগত বছরের বাজেটগুলোর মতোই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বলে মনে হয়েছে। আমি চার বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেছি। দেখেছি বাজেট প্রণয়নের সময় আগে সরকারের ব্যয় কত হবে তা ঠিক করা হয়ে থাকে। এরপর রাজস্ব করের পরিমাণ ও প্রবৃদ্ধির হার ঠিক করা হয়। এবারের বাজেটটি ছোট করেছে, বড় করেনি। তবে বাজেট ছোট হলেও ব্যয়সাশ্রয়ী বলে মনে হয় না। বাজেটের ঘাটতি দেখলেই বোঝা যায়। 

প্রস্তাবিত সামগ্রিক বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এ ঘাটতি পূরণ করা হবে দেশীয় ব্যাংক খাত ও বিদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ধারদেনা করে। প্রস্তাবিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১ হাজার ২০০টি প্রকল্প রয়েছে। এতে অপ্রয়োজনীয় অনেক প্রকল্প রয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা তো আছেই; পাঁচ বছরের প্রকল্প শেষ হতে চলে গেছে ১০ বছর। আবার কিছু কিছু প্রকল্প আছে যা উৎপাদন বা মানুষের জীবনযাত্রায় তেমন কোনো লাভ হবে না। তবে আমি মনে করি, এডিপি ১ লাখ কোটি বা দেড় লাখ কোটিতে নিয়ে আসা। তাহলে ঘাটতি অনেক কমে যাবে। আর ঘাটতি কমে গেলে সবচেয়ে বড় সুবিধা হবে সরকারকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে না। আর বৈদেশিক ঋণের বোঝা কমবে। মানুষের ওপর যে করের চাপ রয়েছে সেটাও কমবে। এ বাজেটের পেছনে নীতি, কৌশল বা কোনো দর্শন নেই। অথচ দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে হিসাব করে বাজেট করা দরকার। 

বর্তমানে অর্থনীতিতে তিনটি চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান—মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া ও জ্বালানি সংকট। এ তিনটি ছাড়াও আরো কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। অন্যান্য পারিপার্শ্বিক অবস্থা—ব্যাংক খাতের দুরবস্থা, পুঁজিবাজার, অর্থ পাচার ও হুন্ডি। এ বছর এসব বিষয়ে সরকারের উচিত ছিল কয়েকটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়া। তবে এক বছরের বাজেটে তো সবকিছু করা সম্ভব নয়। আমরা অনেকেই অনেক কিছু বলছি, বাস্তবে লাভ হবে না। নতুন সরকারের প্রথম বছরের বাজেটটি যেমন হওয়া দরকার, বলিষ্ঠ কিছু পদক্ষেপ নেয়া এবং এর মাধ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়া। আর পরের বছর আরো কিছু শক্ত পদক্ষেপ নেয়া। সে রকমটা এবারের বাজেটে দেখছি না। 

ব্যাংক খাতে নানা অনিয়ম হচ্ছে এবং কিছুদিন আগেও দেখা গেল খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। কিন্তু এই বাজেটে এসব বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেই। ব্যাংকের তো এমনিতেই খারাপ অবস্থা। ব্যাংকে তারল্য সংকট রয়েছে। তার মধ্যে সরকার ঘাটতি পূরণ করতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। তাহলে ক্ষুদ্র শিল্প কীভাবে ঋণ পাবে? ব্যবসা-বাণিজ্য কীভাবে সম্প্রসারণ হবে? বিদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু ঋণের সুদ কীভাবে পরিশোধ হবে? দেশের অর্থনীতির যে অবস্থা তাতে ঋণ দিয়ে ঋণ পরিশোধ করার পরিস্থিতি চলে এসেছে। তাই বৈদেশিক ঋণ ভেবেচিন্তে ব্যয় করা উচিত। বাজেট ঘাটতি নিয়ে আমি মোটেই সন্তুষ্ট নই। বর্তমান সরকার বাজেট কতটুকু বাস্তবায়ন করবে তা আমরা জানা নেই। আমরা সবসময়ই বাজেট বাস্তবায়নের দিক থেকে খুবই দুর্বল। দেশে কোনো জবাবদিহিতা ও তদারকি নেই। যারা সরকারি কর্মকর্তা তারা রুটিন চাকরি করেন। ইনক্রিমেন্টাল বাজেটের সুবিধা হলো, কাজ করি আর না করি বেতন পাওয়া যাবে। সরকারি কর্মকর্তা সকালে অফিসে যায়, পুঁজিবাজারে ঘুরাঘুরি করে। কাজ না করলেও তাদের বেতন ঠিকই বাড়ছে। এ ধরনের বাজেটের দরকার নেই। পারফরম্যান্সভিত্তিক বাজেট করা দরকার। দেশে কিছু কিছু সংস্থা রয়েছে সেগুলোর এখন দরকার নেই। সেগুলো বন্ধ করে দেয়া দরকার। কঠিন পদক্ষেপ না নিলে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব না। পারফরম্যান্সভিত্তিক বাজেট করা না হলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়বে। 

দিনের পর দিন একই ধরনের বাজেট দেয়া হচ্ছে। বাজেটে মানুষকে আশ্বস্ত করা হচ্ছে। সবসময় বড় করে ইতিবাচক কথা বলা হয়ে থাকে, ভোগ্যপণ্যের ওপর শুল্ক কর কমিয়ে দেয়ার ঘোষণা থাকে বাজেটে। কিন্তু কাস্টমস বা শুল্ক বিভাগ খুব সহজে কর আদায় করে থাকে। রুটি, জুতা থেকে শুরু করে মসলাসহ সবকিছু থেকেই ভ্যাট আদায় করা হয়। মানুষও দিতে বাধ্য হয়। 

এবারের বাজেটে দুয়েকটি ভালো জিনিসের মধ্যে রয়েছে কৃষিতে ও জ্বালানিতে ভুর্তকি। এটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রেসক্রিপশনের বাইরে গিয়েও সরকার করতে পেরেছে। আইএমএফ বিভিন্ন দেশে তিনটি প্রেসক্রিপশন নিয়ে যায়। সুদের হার বাড়ানো, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার নির্ধারণ ও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি। আইএমএফ আর্জেন্টিনা ও পাকিস্তান এবং অন্যান্য অনুরূপ দেশগুলোয় বছরের পর বছর ধরে ঋণ প্যাকেজ দেয়া সত্ত্বেও তাদের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। কিন্তু এবার সরকার সাহস করে কৃষিতে ভর্তুকির বিষয়ে আইএমএফ প্রেসক্রিপশনের বাইরে এসেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু নেই। কর্মসংস্থানের জন্য কিছু বলা হয়নি। বেসরকারি খাত যদি ব্যাংক থেকে ঋণ না পায় তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে না এবং কর্মসংস্থান বাড়বে না। তাহলে কী করে মানুষের কষ্ট লাঘব হবে? ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের ঋণ দিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়ে শক্ত পদক্ষেপ নেয়া দরকার ছিল। বিশেষ আইটি হাব খোলার ক্ষেত্রে প্রণোদনা দেয়ার দরকার ছিল। 

বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট বার্তা দেখছি না। খাদ্য মূল্যস্ফীতি তো মনে হচ্ছে ৪৫-৫০ শতাংশ ছুঁয়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমানো হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো পরিকল্পনা আছে? বর্তমানে যে উৎপাদন রয়েছে তার চেয়ে বাড়বে না। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে চাহিদা কমানো যাবে কি? গরিবের চাহিদা কি কমানো যাবে? সরবরাহ কীভাবে বাড়ানো যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাজার তদারকি করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আছে কিন্তু বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। এসব বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নেয়া দরকার। 

একটা উদাহরণ দিই। কিছু কিছু সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জরুরি যন্ত্রপাতি যেমন এমআরআই, সিটি স্ক্যান, আল্ট্রাসনোগ্রাফি ও কেমোথেরাপির মেশিন নেই। আবার যেসব মেশিন রয়েছে তা বেশির ভাগই অকেজো বা চালানোর দক্ষ লোক নেই। হাসপাতালকে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে, ‘‌আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখেছি’। ওদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, ‘আমরা চিঠি পেয়েছি’। এদিকে মানুষ মারা যাচ্ছে আর সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো চিঠি চালাচালি নিয়ে ব্যস্ত। দেখা গেছে, টাকার অভাব না থাকলেও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে না। দেশের বেশির ভাগ সরকারি প্রতিষ্ঠানেরই এ রকমই দশা। এভাবে চললে কীভাবে হবে? যেখানে জবাবদিহিতা ও তদারকি নেই, সেখানে বাজেট দিয়ে কী হবে? বাজার থেকে মানুষ কোরবানির গরু কেনে, লেজ ধরে কি গরু নিয়ন্ত্রণ করা যায়? যেকোনো সমস্যার লেজ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হওয়ার চেয়ে ভালো করে তার মাথায় ধরা গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের তো এটি প্রথম বছর মাত্র। সামনে আরো চার বছর বাকি আছে। প্রথম বছরে সরকার আরো সাহসী ভূমিকা নিতে পারত। 

আমাদের অনেক সংকটের শুরু কিন্তু পলিসিগত ভুল থেকে সৃষ্ট। ২০২১ সাল থেকে আমাদের বিনিময় হারে পতন হয়েছে ও রিজার্ভ কমছে। যখন ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়াসহ আমাদের মতো অনেক দেশ স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছিল তখন কেন আমরা ৮২-৮৩ টাকায় ধরে রেখেছিলাম? তখন দেশের ভাবমূর্তির কথা বলা হয়েছিল—আমরা কি তা রক্ষা করতে পেরেছি? ধীরে ধীরে বিনিময় হার অবমূল্যায়ন না করে একদিনে ১০৯ টাকায় নিয়ে আসা হলো। বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার জন্য ১২ বিলিয়ন ডলার বাজারে বিক্রি করেছিল। কিন্তু এতে কোনো লাভ হয়নি। এখন আবার বাজারভিত্তিক ক্রলিং পেগ করা হয়েছে। আমার কাছে মনে হয় না, ক্রলিং পেগ দিয়ে এখনকার সংকট কাটবে। 

ব্যাংক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও পলিসিগত ভুল রয়েছে। আমার সময়ে কোনো ব্যাংকে একই পরিবারের দুজন পরিচালক থাকতে পারত। পরে একই পরিবার থেকে চারজন পরিচালকের সুযোগ করে দেয়া হলো। আবার তাদের মেয়াদ রাখা হয়েছে নয় বছর। সবশেষে তিনজনে নিয়ে আসা হলো এবং মেয়াদ করা হলো ছয় বছর। বলা হলো, কোনো গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হলেও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের জন্য বিবেচিত হবে। এ ধরনের কাজ মোটেও যুক্তিসংগত নয়। 

খেলাপি ঋণ কমাতে পুনঃতফসিলের বারবার সুযোগ দেয়া হয়েছে কিন্তু আদায় তো বাড়েনি বরং খেলাপি ঋণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এখন তো খেলাপি ঋণ একটি বিজনেস মডেল হয়ে গেছে। ঋণ নেবেন খেলাপি হবেন, ব্যস! মানুষের জীবনযাত্রা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মানোন্নয়ন ঘটাতে হলে এ ধরনের পলিসিতে সম্ভব নয়। একই ঘটনা বারবার ঘটতে দেয়া যাবে না। এসব বিষয়ে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে ভালো কিছু করার জন্য দীর্ঘস্থায়ী পলিসি দরকার। 

সরকার প্রত্যেক বছরই আয়কর নির্ধারণ করে। এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীরা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে। দীর্ঘমেয়াদি ও মধ্যমমেয়াদি আয়কর কোড কেন করা হয় না? দেশে আয়কর কোড করা দরকার। দীর্ঘমেয়াদি বলছি না, আয়কর কোড অন্তত দু-তিন বছরের জন্য হতে পারে। পৃথিবীর সব দেশেই আয়কর কোড আছে। পৃথিবীর কোনো দেশেই প্রত্যেক বছর আয়কর বাড়ানো বা কমানোর সুযোগ নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কখনই তা দেখা যায় না।

আমরা যে পলিসি নিয়ে এগোচ্ছি তা দিয়ে হবে না। আর বাজেট বাস্তবায়নের কথা কি বলব! বাজেট বাস্তবায়নের দিক দিয়ে আমরা সবসময়ই দুর্বল। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন দেখলেই তা সহজে বোঝা যাবে। আমরা এতদিন অন্ধকারে (ব্ল্যাক বক্স) ছিলাম। কালো অধ্যায় থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাই সবক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। বাজেট যে আকারের হোক না কেন তখন বাজেট বাস্তবায়ন সহজ হবে। 

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক 

[নিউজপেপার ওনারস’ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) ও সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত অর্থনীতির চালচিত্র ও প্রস্তাবিত বাজেট ২০২৪-২৫ শীর্ষক অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তৃতায়]

শ্রুতলিখন: দিদারুল হক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন