ভর্তুকির বিপরীতে বন্ড ইস্যু বন্ধের পরামর্শ আইএমএফের

সামষ্টিক অর্থনীতির সংকট বিবেচনায় বিশেষ বন্ড ইস্যু থেকে সরে আসা উচিত

ছবি : বণিক বার্তা

অর্থ সংকটের কারণে বিদ্যুৎ ও সার খাতে ভর্তুকি বাবদ সরকারের বকেয়া হয়ে পড়েছে বড় অংকের অর্থ। এতে অর্থ সংকট প্রকট হয়েছে ভর্তুকির সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানগুলোয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভর্তুকির দায় পরিশোধের জন্য বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যু শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার; এরই মধ্যে কয়েক দফায় ইস্যুও হয়েছে। এর আগে ২০১২-১৩ অর্থবছরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৯৮৭ মিলিয়ন ডলার ঋণের শর্তের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের বকেয়া ভর্তুকি নিষ্পত্তি করতে সরকার এ পদক্ষেপ নিয়েছিল। যদিও সম্প্রতি আইএমএফ ভর্তুকির বিপরীতে বিশেষ বন্ড ইস্যু না করার পরামর্শ দিয়েছে সরকারকে। সংস্থাটির তথ্যানুসারে, গত জানুয়ারি থেকে সরকার ২৬ হাজার ২০০ কোটি টাকার বিশেষ বন্ড ইস্যু করেছে। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সংকট বিবেচনায় সরকারের উচিত এ পরামর্শ মেনে নেয়া। 

উল্লেখ্য, গত বছরের ৩০ জানুয়ারি আইএমএফের নির্বাহী বোর্ডের সভায় বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে এ ঋণ পাবে বাংলাদেশ। ২০২৬ সাল পর্যন্ত এ ঋণ কর্মসূচি চলাকালীন বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরনের শর্ত পরিপালন ও সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। চলতি মাসে ঋণের তৃতীয় কিস্তি অনুমোদনের পর সংস্থাটির প্রকাশিত প্রতিবেদনে বন্ড ইস্যু বন্ধের কথা বলা হয়েছে। 

দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্যে নিপতিত। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয় রোধ। পাশাপাশি রয়েছে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট ও খেলাপি ঋণের আধিক্য, অর্থ পাচার, সরকারের ঋণ পরিশোধের দায় ইত্যাদি। এসব সমস্যা মোকাবেলায়, বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ২০২২ সালে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হয়েছে। গত মে মাসের শুরুর দিকে সুদহার বাজারভিত্তিক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক; চালু হয়েছে ক্রলিং পেগ নীতি। 

সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো বাজারে নগদ অর্থ সরবরাহ সীমিত রাখা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার এটিই মৌলিক নীতি। কিন্তু ভর্তুকির বিপরীতে বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করার মাধ্যমে সরকারি তহবিল থেকে নগদ অর্থ সরবরাহ করা না হলেও এটি রাজস্ব ঘাটতি তৈরি করে। আবার মানি মাল্টিপ্লায়ারের প্রভাবে ইস্যুকৃত বিশেষ বন্ড থেকে বাজারে অর্থের সরবরাহ বাড়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়, যা সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির লক্ষ্যবিরোধী। সুতরাং বলা যায়, বন্ড ইস্যু উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমানোর পথে অন্যতম একটি বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কঠোর মুদ্রানীতির কার্যকর ফল পেতে হলে সরকারকে বিশেষ বন্ড ইস্যু করা বন্ধ করতে হবে।

কেবল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাধা নয়, ব্যাংক খাতের সংকটও প্রকট হবে বন্ড ইস্যুর ফলে। একদিকে সরকারের রাজস্ব আয় কম, অন্যদিকে সরকারের ব্যয় বাড়ছেই। ব্যয় মেটাতে বেড়েছে ঋণের পরিমাণ। রাজস্বের একটি বড় অংশই ব্যয় হচ্ছে কেবল ঋণের সুদ পরিশোধে। আশঙ্কা আছে, নতুন করে এ বন্ড ইস্যুর ফলে ভবিষ্যতে সরকারের সুদজনিত ব্যয় আরো বেড়ে যাবে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটে। এরই মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের নেয়া ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বরাদ্দ মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ২৪ শতাংশ। নতুন বন্ড ইস্যু এ পরিস্থিতির আরো অবনমন ঘটাবে। 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, চলতি অর্থবছরে সার ও বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি বাবদ প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা বকেয়া হয়ে পড়েছিল। এর মধ্যে ২৬ হাজার ২০০ কোটি টাকার বিশেষ বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে ভর্তুকি সমন্বয় করা হয়েছে। এ বন্ডের মাধ্যমে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কাছে বেসরকারি উৎপাদনকারীদের (আইপিপি) পাওনা অর্থ শোধ করা হয়। বন্ডের মেয়াদ আট থেকে দশ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে কোনো একক অর্থবছরে সরকারের ওপর একসঙ্গে খুব বেশি পরিমাণে অর্থ পরিশোধের চাপ তৈরি না হয়। তবে বন্ড ইস্যুর ফলে সরকারের ঋণ ও দায় আরো বাড়বে বৈ কমবে না। এছাড়া বাড়বে ব্যাংক খাতের সমস্যাও।

ব্যাংক বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের মতে, ভর্তুকির বন্ডের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর সুবিধার তুলনায় অসুবিধাই বেশি। বিশেষ বন্ড ইস্যুর ফলে শুধু বিদ্যুৎ খাতের মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ খেলাপি হয়ে পড়লে এর বিপরীতে যে পরিমাণ সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হতো সেটি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। কিন্তু যে পরিমাণ অর্থ বন্ড হিসেবে ইস্যু করা হবে সেটি অন্য খাতে বিনিয়োগ করা হলে আরো বেশি হারে সুদ পাওয়া যেত। এমনকি সরকারের সাধারণ ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করলেও বিশেষ বন্ডের চেয়ে বেশি হারে সুদ পাওয়া যেত। অন্যদিকে বিশেষ বন্ডের বিপরীতে ৮ শতাংশ সুদ পাওয়া যাবে এবং রেপোর মাধ্যমে তারল্য সুবিধা নিলেও একই পরিমাণ সুদ দিতে হবে। তাছাড়া ভবিষ্যতে নীতি সুদহার কমে গেলে বিশেষ বন্ডের সুদহারও কমে যাবে। কিন্তু অন্য যেকোনো মেয়াদি বন্ডে বিনিয়োগ করা হলে নির্ধারিত হারে এর চেয়ে বেশি সুদ পাওয়া যায়। অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদে এ বিশেষ বন্ড ব্যাংক খাতে আরো গভীর ক্ষত তৈরি করবে। তাই সরকারের উচিত বিকল্প পরিকল্পনা নেয়া। অবশ্য আইএমএফের ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এরই মধ্যে সরকার আইএমএফের কাছে নতুন করে বকেয়া পুঞ্জীভূত হওয়া এড়ানোর পাশাপাশি জমে থাকা বকেয়া পাঁচ বছরের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে বাজেট থেকে পরিশোধ করবে বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন