বসবাসের অনুপযোগী দেশের রাজধানী

ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে চাই টেকসই সমাধান

ছবি : বণিক বার্তা

একদিকে পরিবেশ দূষণ, অন্যদিকে অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণ—দুইয়ে মিলে ঢাকা নগরীকে করে তুলেছে বসবাসের অযোগ্য। পাশাপাশি অধিক জনসংখ্যার ঘনত্ব, তীব্র যানজট, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, মানহীন শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) প্রকাশিত দ্য গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্স-২০২৪ অনুযায়ী, ১৭৩টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৬৮তম। গত বছর এই ইনডেক্সে ঢাকার অবস্থান ছিল ১৬৬তম। অর্থাৎ চলতি বছর ঢাকার অবস্থান দুই ধাপ পিছিয়েছে। বাসযোগ্যতার এ তালিকা তৈরি করা হয়েছে স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামো বিবেচনায়। এসব বিচারে চলতি বছরে তালিকার প্রথম স্থানে রয়েছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা।

একসময় ঢাকা নগরীকে সবুজ নগরী (গ্রিন সিটি) বলা হতো। বিদেশীরা ঢাকায় এসে সবুজের সমারোহ দেখে বিমোহিত হতেন। ক্রমান্বয়ে সবুজ হারিয়ে ঢাকা হয়েছে ধূসর এক নগরী। গাছপালা কেটে নতুন নতুন দালানকোঠা নির্মাণ হয়েছে। ফলে নগরীতে এখন আগের মতো ঋতুবৈচিত্র্য লক্ষ করা যায় না। একটি আদর্শ শহরের মোট আয়তনের অন্তত ২০ শতাংশ সবুজ স্থান থাকতে হয়। এ সবুজ শহরের ব্যস্ত নাগরিকদের স্বাস্থ্য ও মানসিক প্রশান্তি রক্ষায় যেমন ভূমিকা রাখে, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্যও বজায় থাকে। রাজধানী ঢাকায় সেই সবুজ রয়েছে ৮ দশমিক ৫ শতাংশেরও কম স্থানে। ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ঢাকার সবুজ এলাকা সবচেয়ে বেশি কমেছে বলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২৩ সালের এক গবেষণায় উঠে আসে। এতে দেখা যায়, ২০১৫ সালে ঢাকা শহরে (নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলো ছাড়া ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন) সবুজ এলাকা ও ফাঁকা জায়গা ছিল ৫৩ দশমিক ১১ বর্গকিলোমিটার। ২০২৩ সালে তা কমে ২৯ দশমিক ৮৫ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। আবার যেটুকু রয়েছে সেখানেও নেই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও যথাযথ তদারকি। সবুজ পরিসর হ্রাসের প্রভাব পড়েছে তাপমাত্রায়। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) তথ্যমতে, ঢাকার উষ্ণতম স্থান এবং শহরের বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশসমৃদ্ধ এলাকার মধ্যে দিন ও রাতে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার পার্থক্য যথাক্রমে ৭ ও ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা বাড়ার দ্বিতীয় অন্যতম কারণ হলো জলাধার কমে যাওয়া। 

যেকোনো বাসযোগ্য শহরের জন্য ১২-১৫ ভাগ জলাধার ও ২০-২৫ ভাগ উন্মুক্ত জায়গা থাকা দরকার বলেও মনে করেন নগরবিদ ও পরিবেশবিদরা। তারা বলছেন, বর্তমানে শহরের ১২-১৫ শতাংশ জলাধার থাকার কথা। কিন্তু আছে মাত্র ২ শতাংশ। এসব জলাধারের বেশির ভাগই অবৈধভাবে দখল ও ভরাট করা হয়েছে, যা দিয়ে পানি নিষ্কাশন কাজ খুবই দুরূহ। সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। জলাধার যেমন কমেছে তেমনি বর্জ্য অব্যবস্থাপনায় বেড়েছে মাটি দূষণ। পানির স্তরও দিনদিন নিচে নেমে যাচ্ছে। ঢাকায় বিশুদ্ধ পানির চাহিদা আর ওয়াসার পানি সরবরাহ সক্ষমতা নিয়ে আশঙ্কা ক্রমে গাঢ় হচ্ছে। উপরন্তু ঢাকায় আছে বায়ুদূষণ, শব্দ দূষণের মতো প্রকট সমস্যাও। 

অপরিকল্পিত নগরায়ণ বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ রাজধানী ঢাকা। ঢাকার আশপাশের প্রায় ১ হাজার ২০০টি ইটভাটা রয়েছে। আর কলকারখানা তো জালের মতো ছড়িয়ে আছে ঢাকা শহরে। ফলে দূষণ বেড়েই চলছে। আইকিউএয়ারের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে দূষিত রাজধানীর তালিকায় ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। ফলে বায়ুদূষণজনিত অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বেড়েছে। এছাড়া অতিরিক্ত শব্দদূষণের ফলেও বাড়ছে মাথাব্যথা, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগের জটিলতা। ঢাকায় শব্দদূষণের প্রধান কারণ হলো যানবাহন। সড়কে যানজট এবং দ্রুতগতির যানবাহন থেকে নির্গত শব্দের মাত্রা মান ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এছাড়া নির্মাণকাজ, শিল্প-কারখানা, বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি থেকেও শব্দদূষণ হয়। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২ সালে ঢাকা বিশ্বের শব্দদূষণে শীর্ষে ছিল। এসব দূষণে রোগ ও রোগীর সংখ্যা বাড়ার অনুপাতে বাড়েনি ঢাকায় চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার আকার। উল্টো গ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকায় মানুষের ঢল নামে চিকিৎসা গ্রহণে। চিকিৎসার মতো শিক্ষার অবস্থাও নাজেহাল। শিক্ষার ভিত প্রাথমিকের দিকে লক্ষ করলেই সেটি বোঝা যায়। বণিক বার্তার এক প্রতিবেদনে উঠে আসে ঢাকার অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ই জরাজীর্ণ ভবনে কার্যক্রম চালাচ্ছে। নেই কোনো খেলার মাঠ। এমনকি অনেক বিদ্যালয়ের জমিও বেদখল হয়ে গেছে। এসব বিদ্যালয়ে যারা পড়াশোনা করছে, তাদের প্রায় সবাই নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এসব শিক্ষার্থীর ৩০-৪০ শতাংশই প্রায় নিয়মিত ক্লাসে অনুপস্থিত থাকে।

মূলত জনস্যংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপে বিপর্যস্ত ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে অনেক আগেই। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) তথ্যমতে, রাজধানী ঢাকায় প্রতি একরে ৭০০ থেকে ৮০০ মানুষ বাস করে। অথচ জাতিসংঘের মতে, প্রতি একরে সর্বোচ্চ ১২০ জন বসবাস করলে সেই শহরকে বসবাসের উপযোগী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এত বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে বিভিন্ন সেবা হয়েছে ঢাকাকেন্দ্রিক। কিন্তু জনসংখ্যার অনুপাতে বাড়েনি সেবার মান। ঢাকায় মানুষের জীবনযাপনের মানও তলানিতে ঠেকেছে।

তবুও ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল শহর। মার্সার কস্ট অব লিভিং সার্ভে ২০২৪-এর তথ্যানুসারে, ব্যয়বহুল শহরের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান ১৪০তম, যা ২০২৩ সালের তালিকায় ছিল ১৫৪। অর্থাৎ ১৪ ধাপ এগিয়েছে ঢাকা।

এ পরিস্থিতিতে ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে হলে ব্যাপক উদ্যোগ প্রয়োজন। স্থিতিশীলতা, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অবকাঠামো সবকিছুতেই ঢাকার অবস্থা শোচনীয়। এসব সমস্যা সমাধানে চাই টেকসই সমাধান। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম থেকে শহরে যেন আসতে না হয়, তাই শহুরে সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দেয়া। ঢাকার প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে সেজন্য বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে ঢাকায় কিংবা ঢাকার আশপাশে যেন আর কোনো কারখানা নির্মাণ না হয়। ঢাকার অবশিষ্ট সবুজ ও জলাধার সংরক্ষণের পাশাপাশি সবুজায়ন ও বনায়নে মনোনিবেশ করতে হবে। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করাটাও এক্ষেত্রে অতীব জরুরি। মোটাদাগে বললে, পরিবেশ সংরক্ষণ করে উন্নয়নকাজ পরিচালনা করতে হবে। তবেই হয়তো ঢাকাকে পুনরায় বাসযোগ্য করা সম্ভব হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন