১০০ কূপের ৬৮টি একাই খনন করতে চায় বাপেক্স

কূপ খননে বাপেক্সের সক্ষমতা বৃদ্ধি দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় সহায়ক হবে

ছবি : বণিক বার্তা

দেশে প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের চাহিদা যেমন সবচেয়ে বেশি, তেমনি সরবরাহ ঘাটতিও বেশি। পেট্রোবাংলার হিসাবেই দেশে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু আমদানীকৃত ৬৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসসহ দৈনিক গড় সরবরাহ মাত্র ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ প্রায় ১ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের দৈনিক ঘাটতি রয়েছে দেশে।

গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে এবং ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরতা হ্রাসে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পেট্রোবাংলা স্থানীয় উৎস থেকে গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে ২০২৬-২৮ সালের মধ্যে স্থলভাগে ১০০ কূপ খননের পরিকল্পনা পেট্রোবাংলার। বণিক বার্তার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গ্যাস উত্তোলনে নিয়োজিত তিনটি বিতরণ কোম্পানির আওতায় এসব গ্যাসকূপ খনন করা হবে। এর মধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) একাই ৬৮টি কূপের দায়িত্ব নিতে চায়।

আশঙ্কা করা হচ্ছে, তিন বছরের মধ্যে বিপুলসংখ্যক এ কূপ খনন বাপেক্সের একার পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা বাপেক্সের সেই সক্ষমতা নেই। এছাড়া এ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থানেও রয়েছে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা। যদিও বাপেক্স সূত্রে জানা গেছে এ পরিকল্পনা অনেক আগে থেকে করা হয়েছে এবং এর অর্থায়ন করবে সরকার নিজেই। 

দেশে দীর্ঘদিন থেকে গ্যাস সংকট। এর সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ খাতে। একসময় বাংলাদেশের বিদ্যুতের ৮০ শতাংশ উৎপাদন হতো প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে, বর্তমানে তা ৪৬ শতাংশে নেমেছে। এ অবনমনের জন্য দায়ী দেশীয় গ্যাস উত্তোলন বাড়ানো এবং নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে পর্যাপ্ত উদ্যোগের অভাব। গত ১০ বছরে বড় কোনো মজুদ আবিষ্কার করা যায়নি। উল্টো নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার না করে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে আমদানিনির্ভর। আবার ডলার সংকটে এলএনজি আমদানিও এখন সম্ভব হচ্ছে না। ফলে গ্যাস সংকট তীব্র হয়েছে; বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এক ধরনের মুখ থুবড়ে পড়েছে বলা যায়। অথচ বিশেষজ্ঞরা বহু আগে থেকে বলে আসছেন, আমদানিনির্ভর জ্বালানি খাত গড়ে তোলা হলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। টেকসই ও নিরাপদ জ্বালানি খাত গড়ে তুলতে হলে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। দেরিতে হলেও পেট্রোবাংলার এ পরিকল্পনাকে সাধুবাদ জানানো যায়। তবে গ্যাস উত্তোলনে কূপ খননের গুরুদায়িত্ব সক্ষমতা বিচারে বণ্টন করা ‍উচিত। নয়তো কার্যকর ফলাফল পাওয়া যাবে না। আর স্থানীয়ভাবে গ্যাস উত্তোলন না বাড়লে গ্যাসের ঘাটতিও কমবে না। 

এরই মধ্যে পেট্রোবাংলা বর্তমানে দৈনিক অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ৪৮টি অনুসন্ধানমূলক, উন্নয়ন ও সংস্কারপূর্ণ কূপ খননের জন্য একটি প্রকল্প চলমান রেখেছে। এর মধ্যে বাপেক্স ২২টি কূপ খননের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে, যার মাধ্যমে সংস্থাটি দৈনিক ২৮১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত করতে চায়। যদিও চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১২৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের নিশ্চয়তা পাওয়া গেছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, এ পরিস্থিতিতে পেট্রোবাংলাকে নতুন করে ৬৮টিসহ তিন বছরে ১০০ কূপ খনন করতে দেয়াটা উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা। তাদের মতে, এর চেয়ে কম লক্ষ্য নিয়ে এগোলে বরং প্রাপ্তিটা আরো বেশি হতে পারে। তাছাড়া বাপেক্সের একার পক্ষে এত স্বল্প সময়ে কূপ খননেরও অভিজ্ঞতা নেই।

পেট্রোবাংলার প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২৯-৩০ সালের মধ্যে দেশের গ্যাসের চাহিদা হবে দৈনিক ৬ হাজার ৬৫৫ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে ৪ হাজার ৩৫২ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করা যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পেট্রোবাংলার একটি নথির বিবরণ অনুযায়ী, এ ব্যবধান পূরণ করতেই সরকার স্থানীয় গ্যাস উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, অনশোর এবং অফশোর প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে; পেট্রোবাংলা স্থানীয় কোম্পানি ও বিভিন্ন দেশী-বিদেশী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করছে।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে যে ১০০টি কূপ খনন করা হবে তার মধ্যে ৬৯টি অনুসন্ধান কূপ। বাকি ৩১টি বিদ্যমান কূপের ওয়ার্কওভার করা হবে। এর মধ্যে একাই ৬৮টি কূপ খননের মাধ্যমে বাপেক্স জাতীয় গ্রিডে ২০২৮ সাল নাগাদ দৈনিক আরো ১৩৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস ‍যুক্ত করতে চায়। এ হিসাব বিবেচনায় নিলে বছরে ২২টিরও বেশি কূপ খনন করতে হবে গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে কাজ করা রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাকে। বাকি ৩২টি কূপ খনন করবে গ্যাস উত্তোলন কোম্পানি বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (বিজিএফসিএল) ও সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল)। ১০০ কূপ খননে মোট ১৯ হাজার ৫০ কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করেছে পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ১৩ হাজার ৩২৮ কোটি এবং গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) ও কোম্পানির নিজস্ব অর্থায়ন প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ হাজার ৭২২ কোটি টাকা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদদের মতে, বাপেক্সের যে সক্ষমতা রয়েছে তা দিয়ে বছরে দুটির বেশি কূপ খনন সম্ভব নয়। কূপ খননের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে তাদের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হায়ার করতে হবে। তাছাড়া বিপুলসংখ্যক এ কূপ খননে প্রয়োজনীয় রিগ ও লোকবল প্রয়োজন রয়েছে।

বাপেক্সের তথ্য অনুযায়ী, সংস্থাটির কূপ খননের জন্য চারটি রিগ রয়েছে। আর একটি রিগের পুনর্বাসনের কাজ চলমান। বর্তমান সক্ষমতা অনুযায়ী দেশের স্থলভাগে প্রতিটি কূপ খননে বাপেক্সের তিন-চার মাস সময় প্রয়োজন। অর্থাৎ সে হিসাবে নতুন পরিকল্পনায় তিন বছরে সংস্থাটির ১২টির বেশি কূপ খনন করা সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতিতে পেট্রোবাংলা যদি আসলেই তার পরিকল্পনার বাস্তবায়নে সিংহভাগ কূপ খননের দায়িত্ব বাপেক্সে দিতে চায় তবে বাপেক্সের সক্ষমতা সবার আগে বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

দেশীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাপেক্সের সক্ষমতা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, এর সক্ষমতা বাড়ানোর প্রচেষ্টাও তেমন একটা করা হয়নাই। সেই তুলনায় প্রতিষ্ঠানটির সাফল্যের নজির একেবারেই কম নয়। গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য বাপেক্সের সক্ষমতা (প্রয়োজনীয় রিগ ও জনবল) বাড়ানো এখন সময়ের দাবি; কূপ খননে বিদেশী কোম্পানির ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানো হলে এবং এটি নতুন কূপ খননে সফল হলে দেশে গ্যাস উত্তোলন বাড়বে, পক্ষান্তরে জ্বালানি নিরাপত্তায় সহায়ক হবে।  

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন