আলোকপাত

নাগরিক জীবনের হাজার বছর ও ঢাকার পর্যটন সম্ভাবনা

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ

ছবি : বণিক বার্তা

কয়েক বছর আগের কথা। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে চলেছিল পর্যটন মেলা। এ সূত্রে মেলার সমাপনী দিন বিকালে ‘ঢাকার ১০০০ বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ নিয়ে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারের মুখ্য প্রবন্ধ উপস্থাপক ছিলাম আমি। ঢাকা-অভিজ্ঞ এবং নগরপরিকল্পনাবিদসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। একটি পরিপাটি অডিটোরিয়ামে চমৎকার আয়োজন ছিল। 

মেয়র মহোদয়, নগরপরিকল্পনাবিদসহ অনেকেই ঢাকা নিয়ে চমৎকার ভাবনার কথা জানালেন। ঢাকাকে আকর্ষণীয় শহর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য চিত্তাকর্ষক পরিকল্পনার কথা বললেন। আয়োজকরা আমাকে প্রশ্রয় দিলেন বলে আমি আমার দীর্ঘদিনের গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসা ভিন্ন সম্ভাবনার কথা জানাতে পারলাম। ভালো লাগল অনেকেই এখন ৪০০ বছরের ঢাকা নগরীর ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রস্তুত। ইতিহাসকে তো আর ব্যক্তি গবেষক নিয়ন্ত্রণ করেন না। আকর তথ্যসূত্রই ইতিহাসের পুরনো সিদ্ধান্তকে সংস্কার করে নতুন বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে। এ কারণে ইতিহাসের সিদ্ধান্তে এখন বলা যাচ্ছে এ ঐতিহাসিক নগরীর নাগরিক জীবন চরিত্র হাজার বছরের পুরনো। কে জানে পরবর্তী গবেষণায় নানা তথ্য-উপাত্ত চলে এলে ঢাকা নগরীর প্রাচীনত্ব আরো পিছিয়ে যায় কিনা!

কিন্তু আমাদের ভাবনা, এসব ঐতিহ্যের উপস্থাপনে কতটা লাভবান হবে এ নগরী, নাগরিক জীবন আর সব শেষে দেশ? প্রাসঙ্গিকভাবেই সেমিনারে উঠে এসেছিল এ ঐতিহাসিক নগরী ঘিরে আমাদের পর্যটন সুবিধা কতটা বাড়তে পারে। কোটি কোটি মানুষে ভারাক্রান্ত একটি অপরিকল্পিত নগরী নিয়ে যখন আমাদের নাভিশ্বাস তখন ট্যুর অপারেটররা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে বললেন বিদেশী পর্যটকরা এ দেশে আসেন এসব বিচিত্র মানুষের ঢল আর এদের বিচিত্র পেশা দেখতে। তাদের অধিকাংশের পছন্দ পুরনো ঢাকা। সদরঘাটে তারা লাখ লাখ বিচিত্র পেশার মানুষের নিরন্তর ছুটে চলা দেখে বিস্মিত হন। অপ্রশস্ত রাস্তা আর সরু অলিগলিতে যানজটে স্থবির বিরক্তিকর দশা বিদেশী পর্যটকদের ক্যামেরার বিষয়বস্তু হয়ে যায়। কিন্তু এ পর্যটন সাফল্যে আমরা কি আনন্দিত হতে পারি!

এটি অনেকটা দুরন্ত বাচ্চাদের ডোবায় ঢিল ছুড়ে ব্যাঙকে আহত করে আনন্দ পাওয়ার মতো। আমরা তো মনে করি ঢাকা শহরের অতীত ঐতিহ্যের খোঁজ করে, দৃশ্যমান ঐতিহ্যিক উপাদান যথাযথ সংরক্ষণ করে এবং অদৃশ্যমান ঐতিহ্যের ইতিহাস উন্মোচন করে তা ডিজিটাল নানা উপায়ে উপস্থাপন করার মাধ্যমে ঢাকাকে একটি আদর্শ ঐতিহ্যিক নগরী হিসেবে উন্মোচন করা যেতে পারে। এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে আধুনিক নানা সুবিধা।

এ প্রসঙ্গে আমি পর্তুগালের পর্যটন নগরী এভোরার কথা মনে করতে পারি। কী চমৎকার পরিকল্পনায় একটি ঐতিহাসিক নগরীকে সংরক্ষণ করা যায়! মধ্যযুগের দুর্গঘেরা এক বর্গকিলোমিটারের কিছুটা বেশি জায়গাজুড়ে প্রাচীন শহর। এর বাইরে আধুনিক শহরের বিস্তার ঘটেছে। এভোরাতে যুগ যুগ ধরে বিদেশী আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একসময় এখানে রোমান আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, মধ্যযুগে এভোরা অধিকৃত হয়েছিল মুসলমানদের দ্বারা, কেল্টিক আধিপত্য বিরাট প্রভাব ফেলে পর্তুগালের এ অঞ্চলে। দুর্গ নগরীটিকে ইউনেসকো বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। সামারে অসংখ্য পর্যটক আসে এভোরা দুর্গনগরী দেখতে। ভেতরে রয়েছে নানা দর্শনীয় স্থাপত্য। রোমান মন্দির, চোখ ধাঁধানো ও তাৎপর্যময় বেশ কয়েকটি গির্জা, মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব, প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে এখনো জীবন্ত এভোরা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাচীন পাথুরে রাস্তা সবই যেন জীবন্ত। ব্যবস্থাপনাটিই এত মনোরম যে নগরীর ভেতরে ঢুকলেই মনে হবে টাইম মেশিনে মধ্যযুগে ফিরে এসেছি। সব দালানকোঠা অফিস, মার্কেট, স্কুল—নানা প্রয়োজনে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের দেশের মতো পরিত্যক্ত করে সংরক্ষিত নয়। কিন্তু কঠোর নিয়ম, সামান্য সংস্কার বা রূপান্তর করতে পারবে না ব্যবহারকারীরা। সংস্কারের প্রয়োজন হলে মিউনিসিপ্যালিটি বিশেষজ্ঞ দিয়ে তা সংস্কার করাবে। ভেতরে একটিই ছোট্ট হোটেল বা গেস্ট হাউজ ‘এভোরা ইন’। একবার এভোরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণে একটি একাডেমিক দায়িত্ব পলনের জন্য পর্তুগাল গিয়েছিলাম। তখন ওরা এখানে আমার থাকার ব্যবস্থা করেছিল। তাই আমি গভীরভাবে ওদের ঐতিহ্য সংরক্ষণ পদ্ধতি অনুভব করতে পেরেছিলাম। সামারে প্রচুরসংখ্যক পর্যটক আসে এ দুর্গনগরী দেখার জন্য। কিন্তু নগরীর বাইরেও তেমন বেশি হোটেল চোখে পড়েনি। পরে বুঝতে পেরেছি এটি নগর-পরিকল্পনার অংশ। পরিকল্পকরা চাননি জনভারে নষ্ট হোক এভোরার মধ্যযুগের আবহ। তাই পর্যটন বাসের সুব্যবস্থা করা হয়েছে। লিসবন থেকে ১ ঘণ্টা সোয়া ঘণ্টার পথ পেরিয়ে ভোরে পর্যটকরা ঢোকেন এভোরায়। সারা দিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে যান লিসবনে। তখন ভেবেছিলাম পুরনো ঢাকার কোনো এক ঐতিহ্যিক অংশ কি সংরক্ষিত অঞ্চল করা যায় না!

সিন্ধু সভ্যতার অবসানের পর ভারতের অনেক স্থানে আবার নতুন করে নগরায়ণ হয়েছিল। এটি দ্বিতীয় নগরায়ণের যুগ বলে পরিচিত। আমাদের ঢাকার ইতিহাস মোগল অধিকারের মধ্যে আটকে যাওয়ায় ঐতিহ্য গড়া অনেক স্বর্ণালী দিন আমরা হারিয়ে ফেলেছি। তাই প্রাচীনকাল থেকে মোগল যুগ-পূর্ব ঢাকা নগরীর বিকাশ আমরা ইতিহাসের পাদপীঠে আনতে পারিনি অনেক দিন। এভাবে এককালের বিশাল বিস্তারী ঢাকা নগর ও শহরতলি আমাদের ইতিহাস আলোচনায় অনুপস্থিত থাকে। আজকের সভার প্রাচীন সম্ভার রাজ্য, আজকের সোনারগাঁও প্রাচীন সুবর্ণগ্রাম আর বিক্রমপুরের অনেকটা অংশ ঢাকা থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন ছিল না। প্রাচীন বিক্রমপুরের শাঁখারিরা ব্যবসা সম্প্রসারণ করে পুরনো ঢাকায় নতুন বাণিজ্য নগরী গড়ে তোলেন। প্রাচীন বিক্রমপুরে লক্ষ টাকা পুঁজি খাটাতে পারে অমন বড় ব্যবসায়ীরা একসময় পুরান ঢাকায় বাণিজ্য বিস্তার করেন। তাদের বাজার লক্ষবাজার নামে পরিচিত হয়। পরে মানুষের মুখে মুখে তা লক্ষ্মীবাজারে পরিণত হয়।

ডেমরার কাছে বালু নদ শীতলক্ষ্যায় পড়ার আগে এর একটি শাখা এঁকেবেঁকে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ে। মোগল ইতিহাসের আকর গ্রন্থ ফার্সি ভাষায় লেখা মির্জা নাথানের ‘বাহারিস্তান ই গায়েবি’তে এ নদীর নাম বলা হয়েছে দোলাই। নদীর পূর্ব অংশটি শুকিয়ে যাওয়ায় একসময় মানুষ মনে করতে থাকে খাল। আর তা থেকে জনপ্রিয় হয়ে যায় ধোলাইখাল নামে।

সুলতানি যুগে পনেরো শতকের মাঝপর্বে অর্থাৎ মোগল আধিপত্য প্রতিষ্ঠার একশ বছর আগে পুরান ঢাকার নারিন্দা, চকবাজার ও উত্তর-পশ্চিমে মিরপুর অঞ্চলে যে মুসলিম বসতির বিস্তার ঘটেছিল তা এখন শিলালিপি প্রমাণে স্পষ্ট। মোগল ও ঔপনিবেশিক যুগের অনেক কম আলোচিত গৌরবময় ইতিহাসও ঢাকার গৌরবকে অনেক বাড়িয়ে দিতে পারে। 

উল্লিখিত সেমিনারে এসব ঐতিহ্য ও আধুনিক পরিকল্পনা এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঐতিহ্যের শহর ঢাকাকে নতুনভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে বলে বক্তারা অভিমত প্রকাশ করেন। একটি আকর্ষণীয় পর্যটন শহর হিসেবে উপস্থাপন করার সব সম্ভাবনা থাকার পরও ইতিহাস ও ঐতিহ্য চর্চার দুর্বলতা এবং দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাবে লক্ষ্য স্থির করা যাচ্ছে না। কখনো কখনো সরকারি উদ্যোগ থাকলেও ইতিহাসচর্চার দুর্বলতার কারণে নানা বিকৃতি মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। যেমন সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উদ্যোগে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করা হয়েছিল লালবাগ দুর্গে। এখনো এটি চালু আছে কিনা জানি না। গুরুত্বপূর্ণ শোর স্ক্রিপ্টের একাধিক অংশে রয়েছে ইতিহাস বিকৃতি। এ শো দেখে সাধারণ দর্শক এবং পর্যটককে ভুল ইতিহাস নিয়ে ফিরতে হবে।

আমরা মনে করি ঢাকা নগরীকে যদি পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে চাই তবে সব ক্ষেত্রে যোগ্য মানুষদের ভূমিকা রাখার প্রয়োজন রয়েছে। 

সেমিনারে অনেক প্রস্তাবের কথা উঠে এসেছিল। এর মধ্যে বেশ অভিনব প্রস্তাবও ছিল। ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের একজন নেতার প্রস্তাব আমার বেশ মন কেড়েছে। তিনি আমাদের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় জেলখানায় পর্যটকদের জন্য একটি জেল হোটেল করার প্রস্তাব রাখেন। এখানে জেলের পরিবেশ ঠিক রেখে হোটেল তৈরির কথা বলেন তিনি। যাতে সানন্দে দেশী-বিদেশী পর্যটক এক-দুই রাত কাটিয়ে যেতে পারেন। 

আমি ২০১৮ সালে উত্তর আয়ারল্যান্ডের রাজধানী বেলফাস্টে টিকিট কেটে একটি সংরক্ষিত জেল দেখতে গিয়েছিলাম। যেখানে আইরিশ বিদ্রোহীদের বন্দি করা হতো। পরিকল্পিতভাবে সাজানো হয়েছে সেলগুলো। মডেল কয়েদি ভেতরে রেখে পরিবেশ জীবন্ত করা হয়। ফাঁসির মঞ্চ থেকে শুরু করে জেলবাসীর দৈনন্দিন জীবন উন্মোচন করা হয়েছে। অসংখ্য দর্শকের আকর্ষণ রয়েছে এ জেলখানা দেখতে। এ অর্থে ট্যুর অপারেটরদের নেতার প্রস্তাব বেশ অর্থবহ।

এমনভাবে ঐতিহ্যঘনিষ্ঠ করে আমরা সুনির্দিষ্ট ও দূরদর্শী পরিকল্পনায় ঢাকাকে সাজাতে পারি। মেয়র মহোদয় ঢাকার নদীগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে চক্রাকার নদীপথ তৈরির কথা জানালেন। তবে সব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে হাঁটার আগে প্রয়োজন অধিক জনসংখ্যার চাপ থেকে ঢাকা নগরীকে মুক্ত করা। বিকেন্দ্রীকরণের বহু প্রস্তাব আমরা অনেকবার দিয়েছি। এ পথে ক্ষমতাবানরা হাঁটবেন না তা বেশ বোঝা যায়। তবে ঢাকা শহরের বিস্তার ঘটিয়ে জনসংখ্যাকে ছড়িয়ে দেয়া যায়। শুনেছি তেমন ভাবনাও সরকারের রয়েছে। খুব কঠিনও নয় এর বাস্তবায়ন। উত্তর-পশ্চিমে সাভার হয়ে ধামরাই পর্যন্ত শহরের বিস্তৃতি হতে পারে। উত্তরে একদিকে কালিয়াকৈর অন্যদিকে গাজীপুরের শালনা-শ্রীপুর পর্যন্ত বিস্তার ঘটানো সম্ভব। পূর্ব দিকে পূর্বাচল হয়ে শীতলক্ষ্যা নদী পর্যন্ত টেনে নেয়া যায়। এভাবে পরিকল্পিত নগর বিন্যাসে অর্ধেক মানুষকে মূল ঢাকা থেকে সরিয়ে নেয়া সম্ভব।

আমরা বিশ্বাস করি দায়িত্বশীল জায়গা থেকে পরিকল্পনা গৃহীত হলে এবং যোগ্য বিশেষজ্ঞদের সংশ্লিষ্ট করতে পারলে আর কেউ এ ঐতিহাসিক নগরীতে বসবাসের অযোগ্য নগরীর কলঙ্কতিলক পরাতে পারবে না। প্রজন্ম গর্ব করবে এ নগরীকে নিয়ে।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন