বিশ্ব সমুদ্র দিবস

সাগর ও মহাসাগরগুলো বাঁচানোর সুযোগ এখনো শেষ হয়নি

ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন

ছবি : বণিক বার্তা

সমুদ্র মানেই বিশাল এক জলরাশি, সীমাহীন অন্য রকম অনুভূতি! নামটি উচ্চারণ করলেই চোখে ভাসে নীল রঙের মায়ামাখা স্বপ্নিল এক প্রকাণ্ড পানির উৎসের ছবি। যেখানে ক্রমাগত ঢেউ ছুটে এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে স্থলভূমির কোল, মায়াবতী সমুদ্রসৈকত। সেই সব ঢেউয়ের মাথায় নাচছে সাদা ফেনার উচ্ছ্বাস। বালুচরের পাড়ে দিগন্তজোড়া সেই সব সমুদ্র যেন অনাদিকাল থেকে এমন স্রোত বিলিয়ে চলছে। ছন্দ, কবিতা, গল্পের অগণিত উপকরণের মহোৎসব এ সমুদ্র।

দেশে যারা একটু ভ্রমণবিলাসী, তাদের চোখে ভেসে ওঠে কক্সবাজার, পতেঙ্গা, কুয়াকাটা কিংবা টেকনাফের সমুদ্রসৈকতগুলোর কাল্পনিক সৌন্দর্য আর অনুভূতি। এখন অবশ্য স্যাটেলাইট মিডিয়ার কল্যাণে সমুদ্রের উপরিভাগ আর তলদেশ আমাদের কাছে বেশ পরিচিত। টিভির পর্দায় চোখ রাখলেই দেখা যাবে নানা চ্যানেলের বিশাল আয়োজন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, ডিসকভারি কিংবা অ্যানিমেল প্লানেট চ্যানেলে সমুদ্র ঘিরে দুর্দান্ত সব অভিযান আর বিচিত্র সব প্রাণী নিয়ে অসংখ্য প্রামাণ্যচিত্র আকর্ষণীয় মোড়কে দেখানো হয় নিয়মিত।

কিন্তু আমরা খালি চোখে আর কল্পনা ও অনুভবের চোখে যেটুকু দেখি, সমুদ্রের অবদান আর আবেদন তার চেয়েও ঢের বিশাল ও বৈচিত্র্য। সাগর-মহাসাগরকে বলা হয় পৃথিবীর ফুসফুস। কেননা আমাদের অক্সিজেন উৎপাদনের সবচেয়ে বড় জৈবরাসায়নিক প্রাকৃতিক যন্ত্র হলো এসব সাগর আর মহাসাগর। বলা হয়ে থাকে Oceans are the life blood of planet Earth and humankind। বিশাল এ খাদ্যভাণ্ডার জোগান দেয় জীবন রক্ষাকারী অগণিত ওষুধের কাঁচামাল ও পুষ্টি উপাদান। পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষার অন্যতম প্রধান নিয়ামক এ সাগর-মহাসাগরই আমাদের গ্রহের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ দখল করে আছে এবং গ্রহের পানি ৯৭ শতাংশ এখানে প্রবাহিত হয় যা বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের অর্ধেকের বেশি উৎপাদন এবং তা থেকে পৃথিবীর জ্বালাময়ী জীবনবিধ্বংসী কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নিতে পারে সবচেয়ে বেশি। সমুদ্রতীর বা পৃষ্ঠ থেকে যত দূরত্বে থাকুন না কেন, সাগর আর মহাসাগর আপনার, আপনার পরিবার, বন্ধু, সহপাঠী, সহকর্মীদের জীবন প্রভাবিত করবেই। আপনার শ্বাস ফেলা বায়ু, পান করা কিংবা ব্যবহারের পানি, খাবার, আরামদায়ক উষ্ণতা কিংবা শীতলতা, আপনাকে আনন্দে রাখা যে পণ্য হয় সমুদ্র থেকে অথবা সমুদ্রের দ্বারা পরিবাহিত হয়ে আসে। বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের মধ্যে বসবাস করে এবং সমুদ্রভিত্তিক ব্যবসায় বিশ্বের অর্থনীতিতে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের অধিক অবদান রাখছে। 

অসংখ্য কারণে মানুষ সমুদ্রের ওপর নির্ভর করে। তিন বিলিয়নের বেশি মানুষ সরাসরি সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। সমুদ্র থেকে মানুষ প্রতি বছর যে পরিমাণ সম্পদ আহরণ করে এবং এর ওপর ভিত্তি করে পণ্য উৎপাদন করে তার অর্থনৈতিক মূল্য বছরে দাঁড়ায় প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলার।

এত উপকার করার পরও আমরা সমুদ্রকে রেহাই দিচ্ছি না। দিনের পর দিন নানাভাবে, নানা আঙ্গিকে ও ভঙ্গিতে তার ক্ষতি করেই চলছি। পরিসংখ্যান আর বাস্তবতা বলছে, মোট সাগর আর মহাসাগরের ৪০ শতাংশের বেশি ক্ষতির শিকার হয়ে গেছে এরই মধ্যে। মানবসৃষ্ট দূষণ আর আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে এ মহান জলরাশিগুলো। বিজ্ঞানীরা জানান, বিশ্বের প্রায় ১০ শতাংশ প্লাস্টিকজাত আবর্জনায় ভরে গেছে এসব সমুদ্রের কোল ও তলদেশ। জাতিসংঘের পরিবেশ সমীক্ষার এক তথ্যমতে, সমুদ্রের প্রতি বর্গমাইলে ৫০ হাজার পর্যন্ত প্লাস্টিকের বোতল ভাসতে দেখা যায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তেল, কেমিক্যালসহ আরো নানা রকম বর্জ্যের নমুনা। অনেকে ক্ষোভের সঙ্গে বলে বসেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছে জীবনের উৎস সমুদ্র।

সারা বিশ্বে আজ সমুদ্র ও উপকূলবর্তী উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ বিপর্যয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। সাগর ও মহাসাগর নিয়ে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক কার্যালয় একটি বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করেছে যার নাম ‘গ্রিন ইকোনমি ইন এ ব্লু ওয়ার্ল্ড’—এ প্রতিবেদনে বিশ্বের সমুদ্রগুলোর এক করুণ অবস্থা ফুটে উঠেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, নানা রকম দূষণ ও সামুদ্রিক সম্পদের মাত্রাহীন ব্যবহারের ফলে আজ এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এর ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করতে হচ্ছে বিপুলসংখ্যক মানুষকে, আশঙ্কা তৈরি করছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নিয়ে। এ পরিস্থিতির ধারাবাহিকতার ফলে খাদ্যনিরাপত্তা ও উন্নয়নের গতিকে বাধাগ্রস্ত হতে হচ্ছে।

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে আজ সমুদ্রের পানির অক্সিজেনের পরিমাণ কমছে, সমুদ্রের পানিতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে তথা পানির অম্লতা বাড়চ্ছে। তাই ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। পৃথিবীর আবহাওয়া ও জলবায়ুর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক এ সমুদ্র সম্পর্কে আমরা একবিংশ শতাব্দীতে এসেও অজ্ঞ ও অসচেতন। পৃথিবী পৃষ্ঠের সবচেয়ে বৃহৎ অংশজুড়ে থাকা এ সাগর-মহাসাগর সম্পর্কে আমরা জেনেছি মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ। আমাদের কাছে ভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহের হাই রেজল্যুশন ছবি ও ধারণা থাকলেও মহাসাগরের তলার ম্যাপ তৈরি করতে পারেনি বিশ্ব হাই-টেক পাওয়ারের দেশ ও জাতিগুলো। তবে আজ যে দেশ সমুদ্রের ওপর জ্ঞানবিজ্ঞানে যত বেশি আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছে, সামুদ্রিক সম্পদ ও শক্তি কাজে লাগাতে পেরেছে, সুনীল অর্থনীতির অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে তারা তত বেশি উন্নত হয়েছে। তাই আমাদের অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংসপ্রায় সমুদ্রকে বাঁচাতে তথা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে আমাদেরকে সমুদ্র সম্পর্কে জানতে হবে, দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। সমুদ্র রক্ষার আইন করে তা বাস্তবায়নের যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে। 

তাই সাগর ও মহাসাগরগুলোকে বাঁচানোর এখনো সুযোগ আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনগুলোর সম্মিলিত সক্রিয় ভূমিকা পালনের মাধ্যমে এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। টেকসই উন্নয়ন প্রদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে এ ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হবে। প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের সময় পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কাজ করা যাবে না। নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন থেকে শুরু করে ইকো-ট্যুরিজমকে আরো উৎসাহ দেয়ার মাধ্যমে উপকূলবর্তী এলাকার পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে। সমুদ্রে চলাচলকারী ও এর আশপাশে বসবাসকারীদের মধ্যে নানা বিষয়ে সমন্বয় ঘটিয়ে সার্বিক উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

সমুদ্রের এসব অবদান, আবেদন, প্রয়োজনীয়তা আর উপকারিতাকে স্বতন্ত্রভাবে বিশ্বের সবার সামনে তুলে ধরার লক্ষ্যে প্রতি বছর ৮ জুন পালন করা হয় বিশ্ব সমুদ্র দিবস। বিশেষ এই দিবসটি পালনের প্রস্তাব প্রথমবার নিয়ে আসে কানাডা। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোয় অনুষ্ঠিত হয় ধরিত্রী সন্মেলন। সেই সন্মেলনেই কানাডা সমুদ্র নিয়ে একটি বিশেষ দিবস পালনের প্রস্তাব দেয়। সমুদ্রের বিশ্বব্যাপী ভূমিকা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তারপর থেকে নানা চিন্তাভাবনা চলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। শেষ পর্যন্ত ২০০৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিশ্ব সমুদ্র দিবস পালনের প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। অধিবেশনে জাতিসংঘ এ বিশেষ দিবসটি পালন করার জন্য সব সদস্য রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায়। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০০৯ সাল থেকে প্রতি বছর ৮ জুন আন্তর্জাতিকভাবে পালন করা হয়ে আসছে বিশ্ব সমুদ্র দিবস।

দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো, সাগর-মহাসাগর সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বাড়িয়ে তোলা। সেই সঙ্গে সমুদ্র ব্যবহার ও পরিবেশ ভালো রাখার ক্ষেত্রে বিভিন্ন আইনের বিন্যাস, বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের দরজা খুলে দেয় এ বিশেষ দিবসটি। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত জলরাশি হিসেবে সমুদ্রকে সম্মান জানানোর পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয় বিশ্ব সমুদ্র দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘Catalyzing Action for Our Ocean & Climate’ যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায়—‘সমুদ্র ও জলবায়ুর জন্য আমাদের সক্রিয় কার্যক্রম কার্যকর করতে হবে’।

বাংলাদেশ সমুদ্র তীরবর্তী একটি দেশ, যার রয়েছে বিশাল সমুদ্রসীমানা তথা ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সামুদ্রিক সীমানা। সমুদ্রের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতির বিপুল সম্ভাবনা। আগামী দিনে সাগর অর্থনীতি হবে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল শক্তি। তাই বাংলাদেশের জন্য দিবসটি পালনের তাৎপর্য অনেক বেশি।

বাংলাদেশে সুনীল অর্থনীতির বিশাল সুযোগগুলোকে অর্জনে পরিণত করতে সমুদ্র গ্র্যাজুয়েট তরুণদের সংশ্লিষ্ট অফিসে/পদে নিয়োগ করা উচিত, যেখানে তারা কর্মসংস্থানের পাশাপাশি তাদের জ্ঞানকে কাজে লাগাতে পারে। অন্যথায় জ্ঞান হয় নিষ্কাশন করা হবে বা সমুদ্রবিদরা অন্য খাতে সুইচ করতে বাধ্য হবে। একটি সমুদ্রবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব বলে আমি মনে করি। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে সমুদ্রবিষয়ক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে অনতিবিলম্বে। মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক প্র্যাকটিসে সমুদ্রবিজ্ঞানের গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও তাদের কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং সব বয়স ও পেশার মানুষকে সমুদ্র সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের সামুদ্রিক সম্পদ রক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন: অধ্যাপক, ওশানোগ্রাফি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ব্লু গ্রিন ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন