তিন মাসে বেড়েছে খেলাপি ঋণ

ঋণ পুনঃতফসিল নয়, আসন্ন অর্থবছরে ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

বাংলাদেশের অর্থনীতি নানা সমস্যায় জর্জরিত। এর মধ্যে আর্থিক খাত, বিশেষ করে ব্যাংক খাতের অবস্থা বেশি শোচনীয়। তারল্য ও ডলার সংকট, লাগামহীন খেলাপি ঋণ, সুশাসনের ঘাটতি, ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ প্রবাহ বেশি প্রভৃতি কারণে ব্যাংকগুলো সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। বিভিন্ন সময় এসব সংকট সমাধানে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও সেগুলো ফলপ্রসূ হয়নি। সম্প্রতি অকার্যকর উদ্যোগের চিত্রই ফুটে উঠেছে বণিক বার্তার প্রতিবেদনে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার দুটিই অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা ছিল। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা বেড়েছে এবং গড় খেলাপি ঋণের হার ৯ শতাংশ থেকে ১১ দশমিক ১১ শতাংশে ঠেকেছে। ব্যাংকসংশ্লিষ্টদের মতে, গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে বাছবিচার ছাড়াই ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছিল। পুনঃতফসিল করা সেসব ঋণের পাশাপাশি নতুন ঋণও খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।

দেশের মূলধারার বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দেখা গেছে, ব্যাংক খাত থেকে অনিয়মের মাধ্যমে লোপাট করা অর্থ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের ১২ শতাংশের বেশি। এ অর্থ দিয়ে অনায়াসে বাজেট ঘাটতি মেটানো সম্ভব হতো। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাত আরো দুর্বল হচ্ছে। এ খাতের নীতিমালাকে প্রভাবিত করতে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ প্রাধান্য পায়। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। এতে ব্যাংক খাত অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে না, উল্টো কিছু ব্যক্তিস্বার্থের কাছে খাতটি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতির উন্নয়ন করতে হলে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। এজন্য খাতটির সংস্কার আবশ্যক। আসন্ন অর্থবছরে এ বিষয়ে জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। 

ঋণ পুনঃতফসিল বাড়ায় ব্যাংক খাতে ‘স্ট্রেসড’ বা ‘দুর্দশাগ্রস্ত’ ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে দেশের ব্যাংক খাতের পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। খেলাপি ও পুনঃতফসিলকৃত ঋণকে ‘দুর্দশাগ্রস্ত’ হিসেবে দেখায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এ হিসেবে দেশের ব্যাংকগুলোর দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৪১৩ কোটি টাকায়। অন্যদিকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় অযোগ্য হওয়ায় ব্যাংকগুলো প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপনও করেছে। সব মিলিয়ে দেশের ব্যাংক খাতের এক-চতুর্থাংশের বেশি ঋণ এখন দুর্দশাগ্রস্ত। 

আগে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত এককালীন বা ডাউন পেমেন্ট জমা দিতে হতো। কিন্তু খেলাপিদের প্রতি নমনীয় হতে গিয়ে ২০১৯ সালে এ হার ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। যদিও ব্যাংকের প্রভাবশালী গ্রাহকরা কোনো ডাউন পেমেন্ট না দিয়েও খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। গ্রাহকের অনুকূলে ঋণসীমা বাড়িয়ে ব্যাংকগুলো খেলাপি হওয়ার যোগ্য ঋণকে নিয়মিত দেখিয়ে থাকে। 

অন্যদিকে ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষমতাও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের হাতে ছেড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অথচ আগে ব্যাংকগুলো নিজ পর্ষদে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করে সেটি অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যাচাই-বাছাইয়ের পর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করত। কিন্তু গত বছরের জুলাইয়ে সে ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রজ্ঞাপনটি জারি হওয়ার পর ব্যাংকগুলো নিজেদের খেয়ালখুশিমতো ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পায়।

ব্যাংক বিশেষজ্ঞদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ উদার নীতিই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলে উল্লম্ফনের অন্যতম কারণ। এছাড়া সুশাসনের অভাবে ঋণের পুনঃতফসিল নীতিমালা সহজ করা সত্ত্বেও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আশঙ্কা রয়েছে, দেশের ব্যাংকগুলোয় দৃশ্যমান খেলাপি ঋণের চেয়ে ধামাচাপা দেয়া খেলাপি ঋণ অনেক বেশি।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২৩-২৪: চলমান সংকট ও করণীয়’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে উল্লেখ করা হয়, ২০০৮-২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে ব্যাংক খাত থেকে লোপাট হয়েছে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। এ সময় ভুয়া কাগজপত্র ও অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়ে ঋণসহ বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ লোপাটসহ ব্যাংক খাতে নানা ধরনের আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। 

ব্যাংকে যে টাকা জমা থাকে, সেটি জনগণের টাকা। এ টাকা ব্যয়ের খাত অবশ্যই সুবিবেচনার বিষয়। সে পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক খাতে নিয়ম-কানুন বাস্তবায়ন ও সংস্কার খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে বলে সংস্থাটির দাবি। বস্তুত ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়ম-কানুন ও নীতিমালা আছে। কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন দেখা যায় না। এমনকি যথাযথ পরিদর্শন, পরিবীক্ষণও হয় না। ঋণখেলাপির সঙ্গে জড়িতরাই ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের নিয়ম করে দেন। এ ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে উত্তরণে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও নীতিমালার বাস্তবায়ন দরকার।

বর্তমানে অর্থনীতি অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নীতিনির্ধারকদের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করা প্রধান কাজ হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে গোষ্ঠীস্বার্থের কাছে সবকিছু যেভাবে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে, তাতে কেবল নিঃস্বার্থ শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষেই সম্ভব অর্থনৈতিক সংস্কারের কঠিন পথে যাওয়া। এর মাধ্যমেই অর্থনীতিকে উদ্ধার করা সম্ভব হতে পারে।

অর্থনীতিতে এসব চ্যালেঞ্জ নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দিচ্ছে। এ সময়ে বিচক্ষণতার সঙ্গে পথ চললে তা দেশের অর্থনীতিকে সঠিক পথে চলতে বাধ্য করবে। তাই কঠিন সময় অতিক্রম করার জন্য শক্তভাবে হাল ধরা প্রয়োজন। এছাড়া প্রয়োজনীয় সংস্কারের পথেও অগ্রসর হওয়া উচিত। 

সম্প্রতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে। যদিও আসন্ন অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক খাত সংস্কারের তেমন কোনো উদ্যোগ প্রতিফলিত হচ্ছে না। 

খেলাপি ঋণ এখন ব্যাংক খাত ও দেশের অর্থনীতির বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের উচিত, নতুন অর্থবছরে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের মোট পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। এদিকে খেলাপি ঋণ এমন একসময়ে বেড়েছে যখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফের) কাছ থেকে সরকার ৪ দশমিক ৭ ডলার ঋণ পেতে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ কমানোর লক্ষ্য নিয়েছে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্র পরিচালিত ব্যাংকগুলোয় মন্দ ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এ লক্ষ্যমাত্রা ৫ শতাংশ। এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে শক্ত ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরতে হবে। নতুন করে যেন খেলাপি ঋণের বোঝা না বাড়ে সেজন্য ব্যাংকগুলোরও সতর্কতা প্রয়োজন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন