ভূরাজনীতি

গাজা ইস্যুতে বিশ্বমঞ্চে আইনি গোলকধাঁধায় পড়ছে কি ইসরায়েল?

মোহাম্মদ জমির

ছবি : বণিক বার্তা

জাতিসংঘের শীর্ষ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের (আইসিজে) বিচারকরা গত ২৪ মে ইসরায়েলকে দক্ষিণ গাজা উপত্যকার রাফা শহরে তাদের সামরিক আগ্রাসন জরুরি ভিত্তিতে বন্ধের নির্দেশ প্রদান করেন। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে দক্ষিণ আফ্রিকার দায়েরকৃত মামলাটির পক্ষে নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী অগ্রগতি। যদিও আইসিজে বা আন্তর্জাতিক আদালতের নিজস্ব আদেশ কার্যকর করার কোনো পন্থা নেই, তবে গাজা অভিযানের কারণে ইসরায়েল যে বৈশ্বিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে তার নিদর্শন এ রায়। ইসরায়েল তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করে গত মাসে রাফায় সর্বাত্মক বিধ্বংসী হামলা জারি রেখেছে। এতে অন্যান্য পশ্চিমা মিত্রের পক্ষেও ইসরায়েলকে অন্ধ সমর্থন দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। 

রায়টি পঠনকালে আন্তর্জাতিক আদালতের প্রেসিডেন্ট নওয়াফ সালাম বলেন, ‘অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এর আগেও ইসরায়েলকে বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক আদালত।’ তিনি আরো উল্লেখ করেন যে ইসরায়েল রাষ্ট্রের উচিত জরুরি ভিত্তিতে সামরিক আক্রমণ বন্ধ করা এবং রাফা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে চলমান অন্যান্য অমানবিক কার্যক্রম থামানো। 

রায়টিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে ইসরায়েল নিজেদের দ্বারা সংঘটিত হামলা ও উচ্ছেদ ক্রিয়া চলাকালীন মানুষের জীবনের নিরাপত্তার তথ্য গোপন করেছে কিংবা রাফা থেকে পালিয়ে আসা আট লাখ ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য খাদ্য, পানি, পয়োব্যবস্থা ও চিকিৎসার প্রাপ্যতা সম্পর্কেও পর্যাপ্ত তথ্য দেয়নি। ফলাফলস্বরূপ আদালত এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে ইসরায়েল রাফায় চলমান তাদের সামরিক আগ্রাসনের ফলে উদ্ভূত উদ্বেগ যথাযথভাবে সমাধানের চেষ্টা না করে বরং আরো অবজ্ঞা করেছে।

আন্তর্জাতিক আদালতের ওই রায় সারা বিশ্বের ১৫ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত প্যানেলে ১৫-২ ভোটের ব্যবধানে গৃহীত হয় এবং বিরোধিতাকারী মাত্র দুজন বিচারকদের একজন উগান্ডার এবং অন্যজন ইসরায়েলের। 

হলোকাস্টের পরিপ্রেক্ষিতে গৃহীত ‘গণহত্যা কনভেনশন’ লঙ্ঘন করার অভিযোগে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার করা মামলাটিরই অংশ হিসেবে দেশটির অনুরোধের এক সপ্তাহ পরই রায়টি ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে সম্প্রতি আইসিজে ইসরায়েলকে অতি দ্রুততার সঙ্গে রাফায় ঘৃণ্য হামলা বন্ধে নির্দেশ প্রদান করে বহুল প্রতীক্ষিত রুলটিও জারি করেছে। এ পদক্ষেপ দক্ষিণ আফ্রিকার আরজিকে সমর্থন করেই গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গৃহীত হয়েছে। 

বিচারক দলের প্রধান নওয়াফ সালাম বলেন, ‘গাজায় পরিস্থিতি উন্নয়নে সর্বশেষ রায়ে ইসরায়েলকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হলেও বর্তমানে গাজার দুর্দশা আরো বেড়েছে।’ অবশ্য ইসরায়েল এ অভিযোগের তীব্র বিরোধিতা করেছে। তারা বলছে, গাজায় অভিযান বন্ধে দেয়া যেকোনো রায় প্রত্যাখ্যান করবে তারা।

গত ২৪ মে রায় পড়ার সময় নওয়াফ সালাম আরো বলেন, ‘ইসরায়েলকে অবশ্যই তাদের এ সামরিক অভিযান অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং রাফা অঞ্চলে চলমান তৎপরতাও থামাতে হবে। যেগুলো গাজায় ফিলিস্তিনের মানুষের জীবন হুমকির মুখে ফেলছে, যা কিনা আন্তর্জাতিক আইনে গণহত্যা সংঘটন হিসেবে বর্ণিত।’ তিনি আরো বলেন যে, ‘ইসরায়েলকে অবশ্যই গাজায় সংঘটিত গণহত্যার অভিযোগ তদন্তকারী জাতিসংঘের যেকোনো সংস্থাকে অবাধ প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে। রায়টিতে ইসরায়েলের প্রতি গাজায় মৌলিক পরিষেবা ও মানবিক সহায়তা জরুরি ভিত্তিতে বাধাহীন প্রবেশের সর্বোচ্চ অধিকারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আহ্বানের পুনরুক্তি ঘটেছে। তাছাড়া গাজায় মানবিক পরিস্থিতি বিপর্যয়ের আরো অবনতি ঘটছে বলে রায় দেয়া হয়েছে।’ বিচারক সালাম তার পর্যবেক্ষণে জানান যে, আদালত বিষয়টিকে গভীরভাবে উদ্বেগজনক হিসেবে চিহ্নিত করছেন যে গাজায় ইসরায়েলি জিম্মিরা এখনো হামাস ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে বন্দি, তিনি এসব জিম্মির দ্রুত ও নিঃশর্ত মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানান।

ইসরায়েল আদালতের এ রায়কে প্রত্যাখ্যান করে বলছে যে গাজায় তাদের সামরিক অভিযান আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল। দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জাচি হানেগবির মতে, ইসরায়েল রাফা অঞ্চলে এমন কোনো সামরিক অভিযান চালায়নি এবং চালাবে না যা জীবনযাত্রার ওপর আঘাত হানতে পারে বা বেসামরিক ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে আংশিক বা সামগ্রিকভাবে ধ্বংস করতে পারে। অথচ তাদের যুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বেনি গ্যান্টজ মন্তব্য করেছেন যে যখনই প্রয়োজন এবং যেখানেই প্রয়োজন, এমনকি রাফায়ও ইসরায়েল হামলা অব্যাহত রাখবে। 

এদিকে জাতিসংঘে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত রিয়াদ মনসুর আইসিজের এ রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন এবং ইসরায়েলকে এটি মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আমরা আশা করি যে আইসিজের নীতিমালাগুলো দ্বিধাহীনভাবে বাস্তবায়ন হবে, কারণ এটা অত্যাবশ্যকীয়। এই কনভেনশনের অংশীদার হিসেবে ইসরায়েলকেও সেটা মেনে নিতে হবে।

গাজার বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ইসরায়েলের সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের সবচেয়ে বড় কারণগুলো হচ্ছে, দেশটিতে বিদ্যমান চরম নিষ্ঠুরতম সামরিকায়ন ও সেটার পেছনের মদদদাতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের পূর্ণ সমর্থন ও সাহায্য। বিশ্বের ইতিহাসে এ যুদ্ধের মতো আর কোনো যুদ্ধকে সারা পৃথিবীর এতগুলো দেশ ও জাতি এত ব্যাপকভাবে নিন্দা ও ধিক্কার জানায়নি।

রুটসঅ্যাকশনের ন্যাশনাল ডিরেক্টর নরম্যান সলোমন তার War Made Invisible: How America Hides the Human Tolls of Its Military Machine বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, গাজা যুদ্ধ প্রকৃত অর্থেই সব পরিমাপেই মানবতার বিরুদ্ধে এ-যাবৎকালের সর্বোচ্চ ও চলমান অন্যায় মানবিক বিপর্যয়। এর জবাবদিহিতা শুধু গণহারে হত্যাকাণ্ড ঘটানো ইসরায়েলি নেতাদেরই নয়, সেসব সরকারেরও দেয়া উচিত যাদের প্ররোচনায় এটি ঘটছে।

যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী হিসেবে যেসব অপরাধ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) নতুন ঘোষণা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলো ২০২৩-এর অক্টোবরের শুরু থেকেই ইসরায়েল ও হামাস উভয় পক্ষের নেতাদের দিয়েই সংঘটিত হয়ে আসছে। যদিও উভয় পক্ষই এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে থাকে, কিন্তু এটার অমানবিক পরিণতি তারা যেভাবে অবহেলা করছে সেটার প্রভাব আরো ভয়ংকর। তা সত্ত্বেও কেউ মানুক বা না মানুক, প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে আইসিসির গ্রেফতারি পরোয়ানার আবেদনকে তাৎক্ষণিকভাবে নিন্দা করতে বাধ্য হয়েছেন। বেনয়ামিন নেতানিয়াহু এবং ইয়োভ গ্যালান্ট সাত মাসেরও বেশি সময় ধরে যা করছে তা যেকোনো নৈতিক ও আইনগত ভিত্তিতে সমর্থনযোগ্য নয়। 

নরম্যান সলোমন আরো মনে করেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য হামাসকে অবশ্যই নিন্দা করতে হবে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সামরিক ও আর্থিক মদদে ইসরায়েলি সরকার যেসব ঘৃণ্য অমানবিক অপরাধ সংঘটিত করছে তাও ক্ষমার অযোগ্য।

এ প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি আইসিসির অধিবেশন চলাকালীন দেয়া প্রধান কৌঁসুলির বক্তব্যটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি তার কার্যালয় দ্বারা সংগৃহীত এবং নিরীক্ষিত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ইয়াহিয়া সিনওয়ার, গাজা উপত্যকায় ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলনের (হামাস) প্রধান, মোহাম্মদ দিয়াব ইব্রাহিম আল-মাসরি হামাসের সামরিক বাহিনীর প্রধান এবং ইসমাইল হানিয়াহের (হামাস পলিটিক্যাল ব্যুরোপ্রধান) ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে (গাজা উপত্যকায়) কমপক্ষে ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে সংঘটিত কিছু যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য অপরাধমূলক দায়বদ্ধতা শনাক্ত করেন।

আইসিসির কৌঁসুলি আরো পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, এ যুদ্ধাপরাধকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে একটি বৈশ্বিক যুদ্ধাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার সশস্ত্র বিবাদ হিসেবে এবং বৈশ্বিকভাবে এটিকে ইসরায়েল ও হামাসের (ও অন্যান্য সশস্ত্র ফিলিস্তিনি বাহিনী) মধ্যকার যুদ্ধ হিসেবে দেখা হচ্ছে না। সুতরাং আমরা এ মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের সমান্তরালে দেখতে পাই যে, এখানে আসলে ইসরায়েলি সরকারের অনুসৃত নীতি অনুযায়ী পদ্ধতিগত উপায়ে ব্যাপকভাবে ফিলিস্তিনের বেসামরিক মানুষকে আক্রমণের বিষয়বস্তু করা হচ্ছে। এই অপরাধ, আমাদের মূল্যায়ন অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।

এটাও মনে করা ঠিক হবে যে ইসরায়েলে হামাসের বন্দুকধারীদের হামলার পরই তারা গাজায় আগ্রাসন শুরু করেছে। কারণ হামাস গাজা উপত্যকা শাসনকারী দল, যারা ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন মানুষকে হত্যা করেছে এবং ২৫২ জনকে অপহরণ করে গাজায় নিয়ে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়েও গত ২৫ মে হামাসকে তেল আবিবের দিকে প্রথমবারের মতো রকেট নিক্ষেপ করতে দেখা গেছে।

আর মুদ্রার উল্টো পাশে ইসরায়েল গাজায় আক্রমণ উত্তরোত্তর বাড়িয়েই চলেছে। ফলে গত ৭ অক্টোবর থেকে এ যুদ্ধে হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, কমপক্ষে ৩৫ হাজার ৮০০ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৮০ হাজারের বেশি আহত হয়েছে। তাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু যারা কিনা সবাই সাধারণ বেসামরিক জনগণের অংশ।

সর্বশেষ বিচারিক পদক্ষেপের ভিত্তিতে মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ, ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান, যেন তারা অপরাধ ও গণহত্যা প্রতিরোধ ও দণ্ড সম্পর্কিত কনভেনশনের নীতিমালা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন-কাঠামোর বাধ্যবাধকতা মেনে চলে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন বাস্তবায়নের পক্ষে কাজ করে। আইসিজে কর্তৃক জারীকৃত অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা, যা আইনত বাধ্যতামূলক এবং প্রয়োগযোগ্য বলে বিবেচিত হবে, কারণ সেগুলো সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক বিচারিক সংস্থা দ্বারা জারি করা হয়েছে। এছাড়া মিসর জোর দিয়ে বলেছে যে দখলদার শক্তি হিসেবে গাজা উপত্যকায় ক্রমে অবনতিপ্রাপ্ত মানবিক পরিস্থিতির জন্য ইসরায়েল সম্পূর্ণ আইনি দায় বহন করছে। ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আইন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সব বিধান লঙ্ঘন করে ফিলিস্তিনি জনগণকে লক্ষ্যবস্তু বানানো এবং তাদের অনাহার ও অবরোধে রাখার বিরুদ্ধে তাদের পদ্ধতিগত নীতি বন্ধ করার আহ্বান জানায়।

এছাড়া সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের প্রতি রাফায় অবিলম্বে সামরিক আগ্রাসন ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড বন্ধের জন্য আইসিজের রায়কে স্বাগত জানায় সৌদি আরব। 

ভূরাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে এরই মধ্যে গতিপ্রকৃতি পাল্টাতে শুরু করেছে। আমরা আশাবাদ রাখতেই পারি যে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ইসরায়েল অচিরেই সেটা বুঝে উঠতে সক্ষম হবে।

মোহাম্মদ জমির: সাবেক রাষ্ট্রদূত, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, তথ্য অধিকার ও সুশাসন বিষয়াদির বিশ্লেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন