৬ জুন থেকে কার্যকর হচ্ছে নতুন কাস্টমস আইন

নিজস্ব প্রতিবেদক

আগামী ৬ জুন থেকে কার্যকর হচ্ছে কাস্টমস আইন, ২০২৩। গত ৩০ মে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সই করা এক প্রজ্ঞাপন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এতে কর্মকর্তাদের জন্য শুল্ক ফাঁকি বা আইনের লঙ্ঘন উদ্ঘাটনের জন্য পুরস্কার এবং রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করলে আর্থিক প্রণোদনা পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

এছাড়া নতুন আইনটিতে বিদেশ থেকে আসা কোনো যাত্রী নিজের লাগেজ সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিলে বা ঘোষণা বহির্ভূত পণ্য আনলে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হবে। আর তার লাগেজে থাকা পণ্য রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হবে। এছাড়া, নিষিদ্ধ পণ্য নিয়ে এলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।

আইনটির ২৫৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধির অধীনে সরল বিশ্বাসে কৃত অথবা অভিপ্রেত কোনো কার্যের জন্য সরকার বা কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা অথবা অন্য কোনো আইনগত কার্যধারা দায়ের করা যাইবে না।’

গত বছরের ৩১ অক্টোবর জাতীয় সংসদে কাস্টমস আইন-২০২৩ পাস হয়। পুরোনো আইনে ২২৩টি ধারা ছিল। নতুন আইনে ২৬৯টি ধারা রয়েছে। রাজস্ব সংগ্রহ ও বাণিজ্য সহজীকরণের লক্ষ্যে বিশ্ব কাস্টমস সংস্থার (ডব্লিউসিও) অনুমোদিত আন্তর্জাতিক চুক্তি ও কনভেনশন অনুযায়ী এবং আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা, যেমনঅনুমোদিত অর্থনৈতিক অপারেটর (এইও), পারস্পরিক স্বীকৃতি চুক্তি (এমআরএ), ইলেকট্রনিক ঘোষণা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, পোস্ট ক্লিয়ারেন্স অডিট (পিসিএ) ইত্যাদি নতুন আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

শুল্ক ফাঁকি বা আইনের লঙ্ঘন উদ্ঘাটনের জন্য পুরস্কার শিরোনামে ২৫৪ ধারায় বলা হয়েছে, (১) এই আইন বা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, বোর্ড, নিম্নবর্ণিত ব্যক্তিগণকে, উপ- ধারা (২) এর বিধান সাপেক্ষে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতি, পরিস্থিতিতে এবং, পুরস্কার মঞ্জুর করিতে পারিবে, যথা, (ক) কাস্টমস শুল্ক ফাঁকি বা ফাঁকি প্রচেষ্টা অথবা এই আইন বা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইন, যাহার অধীনে কোনো কাস্টমস কর্মকর্তা, কর বা অন্যান্য রাজস্ব আদায়ে, এর কোনো বিধানের লঙ্ঘন সম্পর্কিত বিষয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের নিকট সংবাদ প্রদানকারী কোনো কোনো ব্যক্তিকে; (খ) কোনো কাস্টমস কর্মকর্তা বা অন্য কোনো সরকারি সংস্থা অথবা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা কর্মচারীকে, যিনি কাস্টমস শুল্ক ফাঁকি বা ফাঁকি প্রচেষ্টা বা এই আইন অথবা অন্য কোনো আইনের লঙ্ঘন উদ্ঘাটন করেন।

(২) উপ-ধারা (১) এর অধীন পুরস্কার মঞ্জুর করা যাইবে, যদি উক্ত উপ-ধারায় উল্লিখিত সংবাদ সরবরাহ, কাস্টমস শুল্ক ফাঁকি বা ফাঁকি প্রচেষ্টা অথবা আইন লঙ্ঘন উদ্ঘাটনের বা উন্মোচনের ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণিত কার্য ফলপ্রসূভাবে সমাপ্ত হয়, যথা, (অ) ফাঁকি বা ফাঁকি প্রচেষ্টা অথবা লঙ্ঘনের ঘটনার সহিত সংশ্লিষ্ট পণ্য বা অন্য কোনো বস্তু জব্দ এবং বাজেয়াপ্ত হয়; অথবা (আ) এই আইন বা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনের অধীন আরো পযোগ্য কাস্টমস শুল্ক বা অন্য কোনো রাজস্ব আদায় অথবা সংশ্লিষ্ট আইনের অধীন আরোপিত অর্থদণ্ড বা জরিমানা আদায় হয়; অথবা (ই) ফাঁকি বা ফাঁকি প্রচেষ্টা অথবা লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের বা তাহার উপর দণ্ড আরোপিত হয়।

কাস্টমস কর্মকর্তা এবং কর্মচারীগণকে আর্থিক প্রণোদনা পুরস্কার শিরোনামে ২৫৫ ধারায় বলা হয়েছে, এই আইন বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না না কেন, বোর্ড, আমদানি পর্যায়ে উদ্বৃত্ত রাজস্ব আদায়ের একটি অংশ সকল কাস্টমস কর্মকর্তা এবং কর্মচারী এবং বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণকে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতি, পরিস্থিতি পরিমাণে পরিমাণে, আর্থিক প্রণোদনা হিসাবে পুরষ্কার প্রদান করিতে পারিবে: তবে শর্ত থাকে যে, কোনো নির্দিষ্ট অর্থ বৎসরে আর্থিক প্রণোদনা পুরস্কার প্রদান করিতে হইলে, উক্ত বৎসরে আমদানি পর্যায়ে রাজস্ব আদায় সরকার কর্তৃক নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করিতে হইবে।

কাস্টমস আইনের ১৫৪ ধারায় বলা আছে, বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের কাস্টমসের কাছে তার লাগেজ সম্পর্কে তথ্য দিতে হবে। যাত্রী বা ক্রু লাগেজে রক্ষিত পণ্য সম্পর্কে কাস্টমস কর্মকর্তার কাছে লিখিত বা মৌখিক ঘোষণা দিতে পারবেন এবং কাস্টমস কর্মকর্তার প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। লাগেজ তল্লাশির আগে যাত্রী যদি রক্ষিত পণ্য সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে ব্যর্থ হন এবং তল্লাশিকালে ঘোষণা বহির্ভূত পণ্য পাওয়া যায়, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কাস্টমস কর্মকর্তা সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা করতে পারবেন। তাছাড়া, সংশ্লিষ্ট পণ্য বাজেয়াপ্তযোগ্য হবে।

নতুন কাস্টমস আইনে কনটেইনার জট এড়াতে শুল্কায়নের ১০ দিনের মধ্যে শুল্ক-কর পরিশোধ করে বন্দর থেকে পণ্য খালাসের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে পণ্য খালাসে ব্যর্থ হলে ১০ শতাংশ হারে সুদ পরিশোধ করতে হবে।

কাস্টমস আইন-২০২৩-এর ৩২ ধারায় বলা আছে, আমদানি পণ্যের শুল্ক-কর, চার্জ নির্ধারণের পর তা ১০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। এ সময় অতিক্রম করলে শুল্ক-কর পরিশোধের সর্বশেষ তারিখ থেকে খালাসের সময় পর্যন্ত বার্ষিক ১০ শতাংশ হারে সাধারণ সুদ পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া, শুল্ক-কর বকেয়া থাকলে বকেয়া অর্থের ওপর ১০ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। এতে ব্যবসার খরচ বাড়তে পারে। আইনে বন্দরে পৌঁছার পাঁচ দিনের মধ্যে পণ্যের ঘোষণা বা বিল অব এন্ট্রি জমার বিধান রাখা হয়েছে।

এ নিয়ম ভঙ্গ করলে আমদানিকারককে জরিমানা গুনতে হবে। যদিও বিল অব এন্ট্রি সংশোধনের সুযোগ এবং শুল্ক ফাঁকি উদ্ঘাটনের আগে অপরাধ স্বীকার করলে জরিমানা থেকে অব্যাহতির বিধান রাখা হয়েছে।

আইনের ৮২ ধারায় বলা আছে, পণ্য ঘোষণা বা বিল অব এন্ট্রিতে দেওয়া তথ্যের সত্যতা, সঠিকতা সম্পর্কে আমদানিকারক-রপ্তানিকারক দায়বদ্ধ থাকবে। একই সঙ্গে পণ্য খালাসে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টও দায়ী থাকবে। পণ্যের সঠিকতা যাচাইয়ে কাস্টমস কর্মকর্তা দলিলাদি চাইতে পারবেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তথ্য না দিলে সংশ্লিষ্ট আমদানি-রপ্তানিকারককে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হবে।

আইনের ৮৪ ধারায় বলা আছে, কাস্টমস স্টেশনে পণ্য নামার পর আমদানিকারককে পাঁচ দিনের মধ্যে পণ্যের ঘোষণা বা বিল অব এন্ট্রি জমা দিতে হবে। চাইলে পণ্য বন্দরে পৌঁছানোর ৩০ দিন আগেও বিল অব এন্ট্রি জমা দেওয়া যাবে। এ নিয়ম ভঙ্গ করলে আমদানিকারককে সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হবে।

এ ছাড়া আইনের ১৭৩(৪) ধারায় বলা আছে, আদালতে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় কাস্টমস পণ্যের নমুনা সংরক্ষণ করে জব্দকৃত পণ্য নিলামে বিক্রয় বা বিলি-বন্দেজ করতে পারবেন।

আইনের ১৯৩ ধারায় বলা আছে, পুলিশ চোরাই মাল সন্দেহে কোনো পণ্য আটক করলে বা জব্দ করলে আটকের একটি নোটিশ নিকটস্থ কাস্টমস গুদামে পাঠাতে হবে। অভিযোগ খারিজ বা তদন্ত বা বিচার সমাপ্ত হওয়ার পর আটক করা জিনিসপত্র নিকটতম কাস্টমস গুদামে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। এর ব্যত্যয় ঘটলে যে পুলিশ কর্মকর্তাকে গুদামে পণ্য পাঠানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, দায়িত্বে অবহেলার দায়ে ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকার দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই ধরনের দায়িত্বে অবহেলার ক্ষেত্রে আগে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার বিধান ছিল।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন