ভর্তুকির বিশেষ বন্ডে আগ্রহ দেখাচ্ছে না বিদেশী ব্যাংকগুলো

মেহেদী হাসান রাহাত

ছবি : বণিক বার্তা

বিশেষ বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে সার ও বিদ্যুতে ভর্তুকি বাবদ বকেয়া পড়ে যাওয়া অর্থ পরিশোধের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। এরই মধ্যে বকেয়া ভর্তুকির বিপরীতে ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। প্রক্রিয়াধীন রয়েছে আরো ৭ হাজার কোটি টাকার বন্ড। এখন পর্যন্ত এসব বন্ডের সাবস্ক্রিপশন করছে মূলত স্থানীয় ব্যাংকগুলোই। বিদ্যুৎ খাতে অর্থায়ন থাকলেও সরকারি ভর্তুকির এ বন্ডে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না দেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী বিদেশী ব্যাংকগুলো। মূলত এসব বন্ডের সুদহার ও সুযোগ-সুবিধা আকর্ষণীয় না হওয়ার কারণে বিদেশী ব্যাংকগুলো আগ্রহী হচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সামিট পাওয়ার স্থানীয় ব্যাংকের পাশাপাশি বিদেশী ব্যাংকগুলোর কাছ থেকেও ঋণ নিয়েছে। স্থানীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নেয়া ঋণ বিশেষ বন্ডের মাধ্যমে সমন্বয় করছে প্রতিষ্ঠানটি। আর বিদেশী ব্যাংকগুলো বন্ড না নেয়ায় তাদের পাওনা পরিশোধ করা হচ্ছে সামিটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আয় থেকে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) প্রেসিডেন্ট ও সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক মোহাম্মদ ফয়সাল করিম খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌কোন ব্যাংক বন্ডে সাবস্ক্রিপশন করবে সেটি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করে থাকে। বিপিডিবির কাছে বকেয়া থাকা অর্থ পরিশোধের জন্য একটি সমাধান খুঁজে বের করায় আমরা স্থানীয় ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে কৃতজ্ঞ। সামিটের প্রকল্পের আয় থেকেই বিদেশী ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করা হচ্ছে।’

বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী বিদেশী ব্যাংকগুলো এখান থেকে প্রতি বছরই বড় অংকের মুনাফা করে। এর মধ্যে ট্রেজারি বিল-বন্ডের বিনিয়োগ থেকে ভালো মুনাফা আসে ব্যাংকগুলোর। গত বছর দেশের ব্যাংক খাতের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকার মুনাফা করেছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে সুদ খাত ও সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ থেকে আসা আয়ের অবদানই ছিল সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশনের (এইচএসবিসি) মতো বৃহৎ ব্যাংকগুলোর বড় বিনিয়োগ রয়েছে। ভর্তুকির বন্ডে সাবস্ক্রিপশনে অনাগ্রহের বিষয়ে দেশের কোনো বিদেশী ব্যাংকই আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি।

চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি সারে ভর্তুকির বিপরীতে বিশেষ বন্ড ইস্যুর কার্যক্রম শুরু করে অর্থ মন্ত্রণালয়। পরে বিদ্যুতের বকেয়া ভর্তুকির বিপরীতে বন্ড ইস্যু করা হয়। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত এ দুই খাতে মোট ২০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকার বিশেষ বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। এর মধ্যে সারে ১৩ ব্যাংকের অনুকূলে ৯ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকার এবং বিদ্যুতে ২৮ ব্যাংকের অনুকূলে ১০ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকার বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। 

এখন পর্যন্ত ৮৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বকেয়া বিলের অর্থ বন্ডের মাধ্যমে পরিশোধ হয়েছে। এছাড়া বিদ্যুতে ভর্তুকির বিপরীতে আরো ৭ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর জন্য ঈদের আগেই বেশকিছু সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। দ্রুতই এসব বন্ড ইস্যু করা হবে। পরিকল্পনা রয়েছে পরে আরো সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করার। এরই মধ্যে ইস্যুকৃত এবং সামনে ইস্যু হতে যাওয়া বিশেষ বন্ডে এখন পর্যন্ত শুধু স্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকগুলোরই সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। যদিও বিদ্যুতে স্থানীয় ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বিদেশী ব্যাংকগুলোরও বিনিয়োগ রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো বিদেশী ব্যাংকই সরকারের ভর্তুকির বন্ডে সাবস্ক্রিপশনের আগ্রহ দেখায়নি। বন্ডগুলোর সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহারের ভিত্তিতে। বর্তমানে এ হার ৮ শতাংশ। আর বন্ডের মেয়াদ নির্ধারণ করা হচ্ছে ৮-১০ বছর। 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থায়নকারী ব্যাংকগুলোর অনুকূলে সরকারের ভর্তুকির অংশ বন্ড হিসেবে ইস্যু করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বন্ড ইস্যুর পর অর্থায়নকারী ব্যাংকগুলোর কাছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যে দায় রয়েছে সেটি সমন্বয় হয়ে যাবে। এর মাধ্যমে ব্যাংকের মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণগুলো খেলাপি হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যাবে এবং এর বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হবে না। পাশাপাশি ব্যাংকগুলো বন্ডের অর্থ সমপরিমাণ বিধিবদ্ধ জমার (এসএলআর) বাধ্যবাধকতা পূরণেও ব্যবহার করতে পারবে। এছাড়া ব্যাংকগুলো এ বন্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জমা রেখে রেপোর মাধ্যমে তারল্য সুবিধা নিতে পারবে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বকেয়া বিলের পুরো অর্থ হাতে না পেলেও তাদের ব্যাংক ঋণ থেকে বন্ডের সমপরিমাণ অর্থ পরিশোধ হয়ে যাবে। এতে দায় কমে আসার পাশাপাশি খেলাপি হওয়ার হাত থেকে রেহাই পাবে প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব সুবিধার পরও আগ্রহী না হওয়ায় বিদেশী ব্যাংকগুলোর অনুকূলে বন্ড ইস্যু সম্ভব হয়নি। যেসব ব্যাংক বন্ড নেয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে, শুধু তাদেরই ইস্যু করা হয়েছে।

এখন পর্যন্ত সার ও বিদ্যুতের ভর্তুকির বিপরীতে যেসব ব্যাংকের অনুকূলে বিশেষ বন্ড ইস্যু করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে এবি ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ, ঢাকা ব্যাংক, ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, মেঘনা ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স (এনসিসি) ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, শাহ্‌জালাল ইসলামী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল), রূপালী ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংক।

ব্যাংকাররা বলছেন, ভর্তুকির বন্ডে ব্যাংকগুলোর সুবিধার তুলনায় অসুবিধাই বেশি। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর একমাত্র সুবিধা হলো বিদ্যুৎ খাতের মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ খেলাপি হয়ে পড়লে এর বিপরীতে যে পরিমাণ সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হতো, বন্ড ইস্যুর কারণে ব্যাংকগুলো সেটি থেকে রেহাই পাবে। বিশেষ বন্ডের বিপরীতে সুদ পাওয়া যাবে ৮ শতাংশ। আবার রেপোর মাধ্যমে তারল্য সুবিধা নিলেও একই পরিমাণ সুদ দিতে হবে। অন্যদিকে বর্তমানে বেসরকারি খাতে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। সরকারের ট্রেজারি বিল বন্ডের সুদহার ১২ শতাংশের ওপরে। ফলে ভর্তুকির বিশেষ বন্ডের তুলনায় বেসরকারি খাত কিংবা সরকারের মেয়াদি ট্রেজারি বিল বন্ডে বিনিয়োগ করা বেশি লাভজনক। তাছাড়া ভবিষ্যতে নীতি সুদহার কমে গেলে বিশেষ বন্ডের সুদহারও কমে যাবে। যদিও অন্য যেকোনো মেয়াদি বন্ডে বিনিয়োগ করা হলে নির্ধারিত হারে এর চেয়ে বেশি সুদ আসত। বিদেশী ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট নেই। তারা নামমাত্র সুদে গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত পাচ্ছে। ফলে বিশেষ বন্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জমা রেখে রেপোর মাধ্যমে অর্থ ধার নেয়ার যে সুবিধা, সেটিও বিদেশী ব্যাংকগুলোর জন্য আকর্ষণীয় নয়। এসব কারণে বিদেশী ব্যাংকগুলো সরকারের ভর্তুকির বন্ডে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। 

বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির অর্থ পরিশোধে জটিলতার কারণে এ খাতে ভবিষ্যতে অর্থায়ন নিয়েও বিদেশী ব্যাংকগুলোর আগ্রহে ভাটা পড়ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌এক্ষেত্রে ব্যাংক ও গ্রাহক ঠেকে গেছে। সেই সঙ্গে সরকারও ঠেকে গেছে। কিন্তু বিদেশী ব্যাংকগুলো তো আর ঠেকে যায়নি। তারা কেন বিনিয়োগ করবে? বাজারদরের চেয়ে বিশেষ বন্ডের সুদহার অনেক কম। গ্রাহক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না বলে তাদের অর্থায়নকারী স্থানীয় ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে এ বন্ড নিয়েছে। বিদেশী ব্যাংকগুলো তা কোনোভাবেই নেবে না। তাদের প্রধান কার্যালয় কোনোভাবেই এটির অনুমোদন দেবে না।’

প্রথম দফায় বিশেষ বন্ডের মাধ্যমে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতের বকেয়া থাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে। সরকার এখন খাতটির ডিসেম্বর পর্যন্ত বকেয়া পড়া ভর্তুকির অর্থও বন্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করতে চাইছে। এরই ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় দফায় বিদ্যুতে ভর্তুকির বিপরীতে বন্ড ইস্যু করা হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ৪২ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা, জ্বালানি খাতে ৬ হাজার ২৩২ কোটি, কৃষি খাতে ২৬ হাজার ৫৫ কোটি ও সারে ২৫ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। আর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ ১ লাখ ১০ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বিশেষ বন্ড ইস্যু করার কারণে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বিপিডিবির জন্য সরকারের ভর্তুকির বরাদ্দ ১০ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা কমে গেছে।

বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতের উদ্যোক্তা ও কনফিডেন্স গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কাছ থেকে বিল পাওয়ার পর সে অর্থ থেকে আমরা বিদেশী ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ করছি। কয়েক দফায় বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে বিল সমন্বয় হওয়ার কারণে বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতের বকেয়া অনেকটাই কমে এসেছে। নতুন করে ৭ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এটি ইস্যু হয়ে গেলে বিদ্যুৎ খাতের বকেয়া ১০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে চলে আসবে। বকেয়া সমন্বয়ের কারণে আগামী দুই মাস বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি তেল আমদানিতে অর্থ সংকট থাকবে না। প্রত্যাশা থাকবে বকেয়া বিল যাতে আবারো জমে না যায়। কারণ তাহলে আইপিপিগুলোকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জ্বালানি আমদানিতে আবারো তারল্য সংকটে পড়তে হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন