পরিচালনা পর্ষদে সিদ্ধান্ত

ইউসিবির সঙ্গে একীভূত হতে চায় না ন্যাশনাল ব্যাংক

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

এখনই কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ। বেসরকারি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের শনিবারের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে ৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এক সভায় ন্যাশনাল ব্যাংককে একীভূত করতে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংককে (ইউসিবি) নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। 

ন্যাশনাল ব্যাংক পর্ষদের সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক সূত্র জানায়, একীভূত হওয়ার বিষয়ে ইউসিবির সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংক পর্ষদের কোনো আলোচনাই হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকেও এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। ঈদের আগে ৯ এপ্রিল গণমাধ্যমে সংবাদটি আসার পর আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। আমানতকারীদের একটি অংশ ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। এজন্য পর্ষদের সভায় ইউসিবিসহ কোনো ব্যাংকের সঙ্গে এখনই একীভূত না হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ন্যাশনাল ব্যাংকের একজন পরিচালক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে পর্ষদ পুনর্গঠনের পর ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক সংস্কার আনা হয়েছে। ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে টাকা আদায়ে নেয়া হয় কঠোর পদক্ষেপ। এ পরিস্থিতিতে মার্জারের আলোচনা সবকিছু তালগোল পাকিয়ে দিয়েছে। পর্ষদের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, ঋণ আদায় বাড়িয়ে ন্যাশনাল ব্যাংককে ভালো করতে হবে। এখনই কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়া যাবে না।’

ওই পরিচালক আরো বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে একীভূত হওয়ার বিষয়ে আমাদের কিছুই জানানো হয়নি। তাই আমরাও পর্ষদের সভার সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানোর প্রয়োজন মনে করছি না।’

দেশের প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর একটি ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটি বেশ সুনামের সঙ্গেই প্রায় তিন দশক পার করেছিল। গত এক যুগের বেশি সময় ধরে সিকদার পরিবারের একচ্ছত্র কর্তৃত্বে পরিচালিত হওয়ায় ন্যাশনাল ব্যাংক পথ হারায় ২০১০ সাল-পরবর্তী সময় থেকে। প্রয়াত জয়নুল হক সিকদারের হাত ধরে সৃষ্টি সে কর্তৃত্বের অবসান হয় গত বছরের শেষের দিকে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে সাত সদস্যের পর্ষদ গঠন করে দেয়া হয়। 

পর্ষদ ভেঙে দেয়ায় প্রয়াত জয়নুল হক সিকদারের স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ থেকে ছিটকে যান। একই সঙ্গে জয়নুল হক সিকদারের ছেলে রিক হক সিকদার ও রন হক সিকদার ব্যাংকটির পরিচালক পদ হারান। ওই পরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে কেবল পারভীন হক সিকদার ব্যাংকটির নতুন পর্ষদে স্থান পেয়েছেন, যিনি জয়নুল হক সিকদারের মেয়ে। 

বিধিবিধান লঙ্ঘন করে ঋণ অনুমোদন, পরিচালনা পর্ষদের ক্ষমতার অপব্যবহার, পরিচালক নির্বাচনে জটিলতা সৃষ্টি, আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকায় মূলত ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করা হয় বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার স্বাক্ষরিত এক আদেশে তখন বলা হয়। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সুপারিশের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আদেশে উল্লেখ করা হয়।

ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় জয়নুল হক সিকদার ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মারা যান। তার মৃত্যুর পর ব্যাংকটির অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে কিছুটা কঠোর হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তখনই সামনে আসতে শুরু করে ব্যাংকটির নড়বড়ে আর্থিক পরিস্থিতি। ২০২২ সালে নিট লোকসান দাঁড়ায় ৩ হাজার ২৬১ কোটি টাকায়। ২০২৩ সালেও ন্যাশনাল ব্যাংক ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নিট লোকসান দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর), ঋণ-আমানত অনুপাত (এডি রেশিও), মূলধন, সঞ্চিতিসহ সব শর্তই পূরণ করতে ব্যর্থ হয় ব্যাংকটি। 

বর্তমানে ন্যাশনাল ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৬০ শতাংশ থেকে কোনো আয় নেই। গত বছর শেষে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৪২ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকা আদায় অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। এর মধ্যে খেলাপির খাতায় উঠেছে ১২ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। মামলায় আটকা পড়েছে ৭ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। বাকি টাকা খেলাপি না হলেও মেয়াদোত্তীর্ণ। আদায় অযোগ্য হওয়ায় অবলোপন করা হয়েছে আরো ১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকার ঋণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে পর্ষদ পুনর্গঠনের পর ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার। গতকাল বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ব্যাংকটিকে ঘুরে দাঁড় করানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারা আন্তরিকভাবে চাচ্ছে ব্যাংকটিকে ভালো করার। আমিও তাদের বলেছি, ব্যাংকটিকে ভালো করার জন্য যা যা করা দরকার, সেটি করতে হবে। এরই মধ্যে ঋণ আদায়ে জোর দেয়া হয়েছে। ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থে পরিচালিত হয়। আমাদের অবশ্যই তাদের স্বার্থ ও আমানতের নিরাপত্তা দিতে হবে।’

দেশের ব্যাংক খাতে মার্জার-অ্যাকুইজিশন নিয়ে ছয় মাস ধরে নানা আলোচনা হচ্ছে। দুর্বলগুলোকে সবলের সঙ্গে একীভূত করে ব্যাংকের সংখ্যা ৬১ থেকে ৪৫-এ নামিয়ে আনার উদ্যোগ নেয় সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত মাসে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চুক্তি করে পদ্মা ব্যাংক। এরপর রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে (রাকাব) কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে (বিডিবিএল) সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক এবং ইউসিবির সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংক একীভূত হওয়ার আলোচনা ওঠে। তবে এরই মধ্যে বেসিক ব্যাংকের পর্ষদ সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়েছে, তারা সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চায় না। এবার এ তালিকায় ন্যাশনাল ব্যাংকের নামও যুক্ত হলো।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন