পেঁয়াজ উৎপাদন

দুই সংস্থার দুই তথ্যে বিড়ম্বনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভুক্তভোগী ভোক্তারা

ইয়াহইয়া নকিব

ছবি : বণিক বার্তা

পেঁয়াজ উৎপাদনের তথ্য নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) সঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বিস্তর ফারাক দেখা যাচ্ছে। অন্যান্য কৃষিপণ্যের উৎপাদনের হিসাব নিয়ে সংস্থা দুটির মধ্যে সমন্বয় থাকলেও পেঁয়াজের ক্ষেত্রে রয়েছে ভিন্নতা। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটির চাহিদা নিরূপণ এবং সরবরাহ নিশ্চিত করতে সমস্যায় পড়ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আর তথ্যের এমন ফারাকের সুযোগ নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরাও। ফলে বিপাকে পড়ছে ভোক্তারা।

গত কয়েক বছর ধরে পেঁয়াজের আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধি ভোক্তাদের জন্য বড় বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠেছে। গত এক মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি। কেজিতে বেড়েছে ১০-১৫ টাকা। বছরে পণ্যটির চাহিদা ২৬ লাখ টন। তবে উৎপাদনের সঠিক হিসাব নিয়ে দেখা দিয়েছে ভিন্নতা। সরকারের দুটি সংস্থার মধ্যে উৎপাদনের তফাৎ দেখা যাচ্ছে নয় লাখ টনের বেশি, যা মোট চাহিদার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। তথ্যের এমন বিস্তর ফারাক পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা তৈরির পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রের অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট তথ্য থাকা উচিত। দুই ধরনের তথ্যের কারণে চাহিদা-জোগানের পার্থক্য দেখা দেয়, যা নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে ও বাজার ব্যবস্থাপনায় সমস্যা তৈরি করে। তথ্যের এমন গরমিল থাকলে দামে প্রায়ই উত্থান-পতন দেখা দেয়। ব্যবসায়ীদের মধ্যেও ভুল বার্তা যায়। ফলে সময়মতো আমদানি না করায় বাজারে হঠাৎ সংকট দেখা দেয়। এতে ভোগান্তিতে পড়ে ক্রেতা সাধারণ, বাড়ে মূল্যস্ফীতিও।

ডিএইর তথ্যমতে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছিল ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার ৫০০ টন। তবে বিবিএস বলছে, একই অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছিল ২৫ লাখ ৪৬ হাজার ৯৯৪ টন। ফলে পেঁয়াজের উৎপাদন নিয়ে ডিএইর তুলনায় বিবিএসের তথ্যে পার্থক্য দেখা যাচ্ছে ৯ লাখ ৯ হাজার ৫০৬ টন।

তবে নিজেদের হিসাবকে ‘‌পরিষ্কার ও স্বচ্ছ’ বলে দাবি করছেন ডিএইর মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌হিসাব নিয়ে আমরা বিবিএসের সঙ্গে ঝগড়া করতে চাই না। তারা কীভাবে হিসাব করে তা আমরা জানি না। আমরা মাঠের তথ্য যা পাই, তা হিসাবে নিয়ে আসি। কিন্তু পেঁয়াজ শুকানোর পর এবং নষ্ট হওয়ায় ছয়-আট লাখ টন কমে যায়। যেটি আমরা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করার চেষ্টা করি। কিন্তু বিবিএসের হিসাব ধরলে উৎপাদন ও সংরক্ষণ পর্যায়ে নষ্ট হওয়ার পর পেঁয়াজ উৎপাদন ২০ লাখ টনের নিচে নেমে যেত। তখন আমাদের বছরে ১৫-১৬ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হতো। কিন্তু দেশে এমন কোনো রেকর্ড নেই। গত ছয় বছর আমরা ছয়-আট লাখ টন আমদানি করছি।’

এ বিষয়ে বিবিএসের কৃষি উইংয়ের পরিচালক আলাউদ্দিন আল আজাদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌আমরা আমাদের পদ্ধতি অনুসরণ করে হিসাব করে থাকি। ডিইএ কীভাবে হিসাব করে, তা নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।’

পেঁয়াজ নিয়ে সবচেয়ে বড় ভোগান্তি ঘটে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে। ওই সময় ভারত হঠাৎ করে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়। তখন বেশ নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হয় দেশের বাজারে। চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতিজনিত কারণে তাৎক্ষণিক পেঁয়াজ আমদানিতে বেশ বেগ পেতে হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। তখন পাকিস্তান, মিয়ানমার, তুরস্ক, চীন ও মিসর থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয় মন্ত্রণালয়। নৌ ও স্থলপথের পাশাপাশি আকাশপথেও পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছিল। এর পরও সেবার খুচরা বাজারে ২৫০-৩০০ টাকা ছুঁয়েছিল পেঁয়াজের দাম।

উৎপাদন এত বেশি হলে পেঁয়াজের দাম এত বাড়ত না বলে মনে করছেন কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌তথ্য দেয়ার সময় নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কিছুটা বাড়িয়ে দেখানোর একটা প্রবণতা থাকে। তাই দুই সংস্থার তথ্যে গরমিল থাকে। বিবিএস অনেক দেরিতে তথ্য দেয়। ফলে সময়মতো আমদানি করা যায় না। আর ভারত পেঁয়াজের আমদানি বন্ধ করলে বাজারে হৈচৈ পড়ে যায়। উৎপাদনের পরই বিবিএস তথ্য দিলে সেটা কাজে লাগত। কিন্তু মৌসুম চলে গেলে তথ্য দিলে তা বইয়ের মধ্যেই শোভা পায়। বাজার ব্যবস্থাপনায় সেই তথ্য কোনো কাজে আসে না। আমাদের পেঁয়াজের প্রকৃত চাহিদা ২৯-৩০ লাখ টন। কিন্তু উৎপাদনের পর কিছু পেঁয়াজ নষ্ট হওয়ায় নিট উৎপাদন দাঁড়ায় ২২ লাখ টনের মতো। ফলে চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর আমাদের ছয়-সাত লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়।’

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল ২৫ লাখ ৬১ হাজার টন, যা গত অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে ৩৪ লাখ টনে। অর্থাৎ তিন বছরের ব্যবধানে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন বেড়েছে ৩৬ শতাংশের বেশি। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয় পাবনা, ফরিদপুর ও রাজবাড়ী জেলায়। কিন্তু স্থানীয় উৎপাদন বাড়লেও এখনো পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না।

দেশের মধ্যে একেক সংস্থা উৎপাদনের একেক তথ্য দেয়, যা অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেখা যায় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সংস্থাগুলোর তথ্যে আবার অনেক বেশি তফাৎ থাকে, যা উচিত না বলে মনে করছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লান্ট প্যাথলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বিতভাবে হিসাব করা উচিত। রাষ্ট্রের যেকোনো ডাটা একই হওয়া উচিত। একেক প্রতিষ্ঠান একেক ডাটা দেবে এটা হতে পারে না। এতে বাজার ব্যবস্থাপনায় সমস্যা তৈরি হয়। চাহিদা নিরূপণে সমস্যা হওয়ায় সার্বিক নীতি গ্রহণেও সমস্যা হতে পারে।’

তিনি আরো বলেন, ‘‌পেঁয়াজের ক্ষেত্রে ফসলোত্তর ক্ষতি (উৎপাদনের পর সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পর্যায়ে) অনেক বেশি। এটা ২০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। যদি ২০ ভাগও ধরি, তাহলে পেঁয়াজের নিট উৎপাদন অনেক কমে যায়। বিষয়টিকে অনেক সময় বিবেচনায় নেয়া হয় না। ফলে ঘাটতি তৈরি হয়।’

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল বাজারে দেশী পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ৬৫-৮০ টাকা। এক সপ্তাহ আগে যা ৭৫ টাকার মধ্যে ছিল। এক মাস আগে দাম ছিল প্রতি কেজিতে ৫৫-৬৫ টাকার মধ্যে। সে হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যটির দাম বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি।

সার্বিক বিষয়ে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, ‘‌চাহিদার চেয়ে পেঁয়াজের উৎপাদন বেশি হলে দাম কম হতো। কিন্তু নানা প্রচেষ্টার পরও দাম কমছে না। ডিএইর তথ্য ঠিক থাকলে এত উচ্চ দাম হতো না। তথ্যের হেরফের থাকলেই মূল্য ওঠানামা করে। নিজেদের কর্মকাণ্ড ভালো দেখানোর জন্য অনেক সময় সংস্থাগুলো ফলাফল বেশি দেখায়। কিন্তু দুই ধরনের তথ্যে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। ব্যবসায়ীদের মধ্যেও ভুল বার্তা যায়। উৎপাদন বেশি বলা হলে ব্যবসায়ীরা আমদানির জন্য প্রস্তুত থাকে না। পরে দাম বেড়ে গেলে আমদানির সিদ্ধান্ত হলেও পণ্য আসতে দেরি হয়। এতে দাম আরো বেড়ে গিয়ে ভোগান্তি তৈরি হয়, যা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে। যা একটি রাজনৈতিক সরকারের জন্যও বিড়ম্বনা সৃষ্টি করে।’

দুই সংস্থার মধ্যে কথা বলার পরামর্শ দিয়ে এ কৃষি অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, ‘‌তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয়ভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বিবিএস। তাদের এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ রয়েছে। আইনগতভাবেও তাদের তথ্য গ্রহণযোগ্য। ডিইএ যদি নিজেদের ব্যবহারের জন্য তথ্য সংগ্রহ করেও থাকে, তা প্রচার করা ঠিক না। কারণ, তারা সেভাবে প্রশিক্ষিত নয়। এতে বিভ্রান্তি তৈরি হয়।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন