অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ডলার সংকট কাটিয়ে উঠছে পাকিস্তান, বাংলাদেশ পারবে কি

হাছান আদনান

ছবি : বণিক বার্তা

তীব্র ডলার সংকটে নাজুক পরিস্থিতি ছিল পাকিস্তানের। দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে চলে যাওয়া দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছিল মাত্র ৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। রেকর্ড পতনের দেখা পায় পাকিস্তানি রুপি। কিছুদিন হলো নাজুক সে পরিস্থিতি থেকে কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তান। এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে ‘রোশান ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট’ নামের একটি ব্যাংক সেবার উদ্ভাবন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রবাসী পাকিস্তানিরা এরই মধ্যে এ ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার জমা করেছে।

বৈশ্বিক বিভিন্ন সংস্থার পর্যবেক্ষণ বলছে, এ মুহূর্তে মুদ্রাবাজারে পারফরম্যান্সে এশিয়ার শীর্ষ মুদ্রা পাকিস্তানি রুপি। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৩০৮-৩১০ রুপি। বর্তমানে তা ২৭৮ রুপিতে নেমে এসেছে। এ সময়ে ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপি ১০ শতাংশের বেশি শক্তিশালী হয়েছে। আর পাকিস্তানের নিট রিজার্ভ ৩ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।

আড়াই বছর ধরে ডলারের তীব্র সংকট চলছে বাংলাদেশেও। এ সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। ডলারের গ্রস রিজার্ভ ১৮ বিলিয়নের ঘরে (আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী বিপিএম৬ পদ্ধতিতে হিসাবায়নে) নেমে এসেছে। আর ব্যবহারযোগ্য নিট রিজার্ভ নেমে এসেছে মাত্র ১৩ বিলিয়ন ডলারে। 

ডলারের জোগান বাড়াতে এ পর্যন্ত অনেক উদ্যোগই নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো ফল পাওয়া যায়নি। গত বছরের ২৯ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য বৈদেশিক মুদ্রায় আমানত রাখার সুযোগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপন আমলে নিয়ে দেশের বেশকিছু ব্যাংক এরই মধ্যে ‘অফশোর ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট’ নামে একটি ব্যাংক সেবা চালু করেছে। ব্যাংকাররা বলছেন, এটিকে অনেকটা পাকিস্তানে চালু হওয়া রোশান ডিজিটাল অ্যাকাউন্টেরই বাংলাদেশী সংস্করণ বলা চলে। ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রবাসী পাকিস্তানিদের জন্য ব্যাংক হিসাবটি চালু করেছিল স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান।

প্রবাসীদের জন্য চালু করা অফশোর ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট নিয়ে বেশ আশাবাদী মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘কয়েকটি ব্যাংক এরই মধ্যে অফশোর ডিপোজিট অ্যাকাউন্টের বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি প্রবাসীদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠানও হয়েছে। প্রবাসীদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে বলে শুনেছি। তবে পাকিস্তানের মতো সাফল্য পেতে বেশ সময় লাগবে।’

তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান প্রবাসীদের জন্য ডলারে আমানত রাখার সুযোগটি ২০২০ সালে চালু করেছে। আমরা মাত্রই এ বিষয়ে কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছি। পাকিস্তানিদের অনেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উচ্চ পর্যায়ে চাকরি করে। তারা অনেক বেশি বেতন পায়। এক্ষেত্রে প্রবাসী বাংলাদেশীরা বেশ পিছিয়ে আছে। তবে আকৃষ্ট করা গেলে বাংলাদেশও প্রবাসীদের কাছ থেকে শত বিলিয়ন ডলারের আমানত সংগ্রহ করতে পারবে। এক্ষেত্রে দেশের ব্যাংক খাতের প্রতি আস্থা-অনাস্থার বিষয়ে প্রবাসীদের কাছে পরিষ্কার বার্তা পৌঁছাতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও সুশাসনের বিষয়ে আরো বেশি কঠোর ও কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।’

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৬ লাখ ৮৯ হাজার ৬৫০টি রোশান ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। এসব হিসাবে জমাকৃত আমানতের স্থিতি ছিল ৭৮৩ কোটি বা ৭ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। মেয়াদ শেষ হওয়ায় এপ্রিল পর্যন্ত ১ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার আমানত প্রত্যাহার হয়েছে। বাকি আমানতও দেশটির অর্থনীতিতে নানাভাবে ভূমিকা রাখছে।

বিদেশে অবস্থানকারী পাকিস্তানিরা অল্প কিছু নথিপত্র দিয়ে অনলাইনেই রোশান ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট চালু করতে পারছে। এক্ষেত্রে পুরো প্রক্রিয়াটিই সম্পাদন হচ্ছে ডিজিটাল প্রক্রিয়ায়। অর্থাৎ এ হিসাব চালুর ক্ষেত্রে ব্যক্তির উপস্থিতির প্রয়োজন হচ্ছে না। আবার ডলারে জমাকৃত আমানত প্রত্যাহার প্রক্রিয়াটিও বেশ সহজ। আকর্ষণীয় মুনাফার পাশাপাশি প্রক্রিয়াগত জটিলতা না থাকায় রোশান ডিজিটাল অ্যাকাউন্টে ডলার জমা রাখতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন প্রবাসী পাকিস্তানিরা।

২০২১ সালের এপ্রিলে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ১৫১ পাকিস্তানি রুপি। এর পর থেকে দেশটির অর্থনীতি ও রিজার্ভ পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হয়। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে এসে পাকিস্তানে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৩১০ রুপিতে গিয়ে ঠেকে। চলতি বছরে এসে দেশটির অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। মাত্র ৩ বিলিয়ন থেকে বেড়ে নিট রিজার্ভ এরই মধ্যে ৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। আর স্থানীয় মুদ্রা শক্তিশালী হয়ে প্রতি ডলারের বিনিময় হার নেমে এসেছে ২৭৮ রুপিতে। ব্লুমবার্গসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পর্যবেক্ষণ বলছে, পাকিস্তানের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে রোশান ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট। প্রবাসী পাকিস্তানিদের জমাকৃত প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের ওপর ভর করে দেশটির রিজার্ভ, মুদ্রা ও অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, গত এক বছরে শক্তিশালী হওয়ার দিক থেকে এশিয়ার শীর্ষ মুদ্রা পাকিস্তানি রুপি। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে শ্রীলংকান রুপি। দেউলিয়া অবস্থান থেকে বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে শ্রীলংকার অর্থনীতি, রিজার্ভ ও স্থানীয় মুদ্রা। এ সময়ে এশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ চীন ও ভারতের মুদ্রা দুর্বল হয়েছে। একইভাবে দুর্বল হয়েছে ভিয়েতনাম, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর মুদ্রাও।

প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য ডলারে আমানত রাখার সুযোগ দিয়ে ২০২৩ সালের ২৯ নভেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে হিসাব খুলে প্রবাসী বাংলাদেশীরা বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলারে মেয়াদি আমানত রাখতে পারবেন। এ আমানতের বিপরীতে ৭ থেকে প্রায় ৯ শতাংশ সুদ পাওয়া যাবে। সর্বনিম্ন তিন মাস থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর মেয়াদে এ আমানত রাখা যাবে। মেয়াদ শেষে কিংবা যেকোনো সময়ে প্রবাসীরা ডলারে আমানত তুলে নিতে পারবেন। বাংলাদেশের বাইরে অবস্থানকারী প্রবাসী বাংলাদেশী, বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বিদেশী নাগরিক, বিদেশে নিবন্ধিত ও পরিচালিত প্রতিষ্ঠান এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এ আমানত হিসাব পরিচালনার সুযোগ পাবেন বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা আমলে নিয়ে প্রবাসীদের জন্য দুই ধরনের ব্যাংক হিসাব চালু করেছে দেশের কয়েকটি ব্যাংক। প্রথমটি হলো আন্তর্জাতিক ব্যাংক হিসাব বা আইবি অ্যাকাউন্ট। প্রবাসীদের দেশে অবস্থানরত যেকোনো স্বজন ব্যাংকে গিয়ে এ হিসাব চালু করতে পারবেন। এক্ষেত্রে প্রবাসীর কর্মক্ষেত্রের আইডি কার্ডসহ প্রয়োজনীয় নথিপত্র জমা দিতে হবে। প্রবাসী বাংলাদেশী ওই ব্যাংক হিসাবে ডলার পাঠাবেন এবং দেশে থাকা স্বজন ব্যাংক হিসাবটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন। 

অন্যটি হলো অফশোর ব্যাংকিং ফিক্সড ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট। যেকোনো প্রবাসী বাংলাদেশী সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ওয়েবসাইটে গিয়ে এ হিসাব খুলতে পারবেন। এক্ষেত্রে প্রবাসীকে নিজের ছবি, পাসপোর্ট ও কর্মক্ষেত্রের আইডি কার্ড অনলাইনে আপলোড করতে হবে। হিসাব খোলার পর যেকোনো মেয়াদে প্রবাসীরা ডলারে বা বিদেশী মুদ্রায় আমানত রাখতে পারবেন। পরবর্তী সময়ে যেকোনো সময় জমাকৃত আমানত মুনাফাসহ প্রত্যাবাসন করা যাবে। এ দুই ধরনের ব্যাংক হিসাবে জমাকৃত আমানতের মুনাফার ওপর বাংলাদেশে কোনো কর পরিশোধ করতে হবে না। একইভাবে এ হিসাব পরিচালনায় কোনো ফিও লাগবে না। 

প্রবাসীদের জন্য অফশোর ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট চালু করা ব্যাংকগুলোর একটি ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম শিরিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এক সপ্তাহ হলো আমরা অফশোর ব্যাংকিং ফিক্সড ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট চালু করেছি। এরই মধ্যে ৩০টি হিসাব খোলা হয়েছে। কিছু ডলার জমাও হয়েছে। আশা করছি, প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে প্রডাক্টটি জনপ্রিয়তা পাবে। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ওয়েবসাইটে গিয়ে খুব সহজে অ্যাকাউন্ট খোলা যাচ্ছে। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে যে কেউ এ হিসাব খুলতে পারবেন। গ্রাহক বাংলাদেশী হলে কর্মক্ষেত্রের পরিচয়পত্রের কপি সংযুক্ত করবেন। আর অন্য দেশের নাগরিক হলে শুধু পাসপোর্টের কপি সংযুক্ত করলেই হবে।’

যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশীদের আকৃষ্ট করতে গত ২৪ মে সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের একটি হোটেলে সেমিনার আয়োজন করে দেশের চারটি ব্যাংক। ওই অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নরসহ দেশের বেশকিছু ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী অংশ নেন। অনুষ্ঠানে প্রশ্নোত্তর পর্বের শুরুতেই একজন প্রবাসী জানতে চান, দেশের কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে পারছে না। এ অবস্থায় প্রবাসীদের জমাকৃত আমানত ডলারে ফেরত দিতে না পারলে কী হবে?

অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া দুটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে জানান, ওই প্রবাসীর করা প্রশ্নের যথাযথ উত্তর আয়োজকদের পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি। উল্টো সময় শেষ হয়ে যাওয়ার কথা বলে অনুষ্ঠান শেষ করার ঘোষণা দেয়া হয়। এতে উপস্থিত প্রবাসীদের অনেকেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘হাতে গোনা দুয়েকটি ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। এ সংবাদের বিরূপ প্রভাব দেশের পুরো ব্যাংক খাতের ওপরই পড়েছে। প্রবাসীরা এ সংবাদে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন। এ কারণে অফশোর ডিপোজিট অ্যাকাউন্টের সাফল্য নিয়ে কিছুটা সংশয় রয়েছে। দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে আস্থাহীনতার প্রশ্নটি এখন বেশ বড় হয়ে উঠেছে। এ প্রশ্নের সুরাহা না হলে পুরো অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন