এফডব্লিউএ সেবা

১০ হাজার কোটি টাকার বাজারে প্রবেশের অপেক্ষায় তিন সেলফোন অপারেটর

প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা নিয়ে উদ্বেগে আইএসপি অপারেটররা

আরফিন শরিয়ত

ছবি : বণিক বার্তা

সম্প্রতি তারবিহীন ব্রডব্যান্ড অর্থাৎ ‘ফিক্সড ওয়্যারলেস অ্যাকসেস’ (এফডব্লিউএ) সেবা দেয়ার লাইসেন্স পেয়েছে দেশের তিন সেলফোন অপারেটর। এর মাধ্যমে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের (আইএসপি) ১০ হাজার কোটি টাকার বাজারে প্রবেশ করতে যাচ্ছে গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক। তাদের এ অন্তর্ভুক্তির ফলে উদ্বেগে পড়েছে দেশের ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডাররা (আইএসপি)। কারণ ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের এ বাজার এতদিন পরিচালিত হচ্ছিল শুধু আইএসপির মাধ্যমে। কিন্তু নতুন করে যুক্ত হওয়া সেলফোন কোম্পানিগুলো সক্ষমতার দিক থেকে আইএসপির চেয়ে অনেক এগিয়ে। এ কারণে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাটা আইএসপির জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। 

গত ফেব্রুয়ারিতে তিন অপারেটরকে এফডব্লিউএ সেবার অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। বর্তমানে এ সেবা আইএসপি অপারেটররা কেবল (তার) সংযোগের মাধ্যমে দিতে পারে। এখন সেলফোন অপারেটররা অনুমোদন পাওয়ায় দেশের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবসায় পরিবর্তন আসবে।

বিটিআরসির হিসাবে দেশে লাইসেন্সধারী আইএসপি অপারেটরের সংখ্যা ২ হাজার ৮৯৭। এর মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে ১১৮টি, বিভাগীয় পর্যায়ে ৩৪১, জেলা পর্যায়ে ১৪৯ এবং উপজেলা বা থানা পর্যায়ের আইএসপি অপারেটর রয়েছে ২ হাজার ২৮৯টি। এছাড়া দেশজুড়ে অবৈধ আইএসপি অপারেটর রয়েছে প্রায় তিন হাজার। 

আইএসপি অপারেটরদের সংগঠন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ  (আইএসপিএবি) বলছে, সংগঠনটির সদস্য অপারেটরদের বার্ষিক আয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। আইএসপি সেবার মাধ্যমে দেশে তিন হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশের ক্ষুদ্র এবং মাঝারি বিনিয়োগ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মসংস্থান রয়েছে পাঁচ-ছয় লাখ মানুষের।

আইএসপিএবি জানায়, শীর্ষ ১০টি আইএসপি অপারেটরের বার্ষিক আয় প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। এ ১০ কোম্পানি বাজারে বড় বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে। ৩০০ মাঝারি অপারেটরের আয় ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। উপজেলা, থানা ও জেলা পর্যায়ে আয় হয় ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এছাড়া তিন হাজারের বেশি অবৈধ আইএসপি অপারেটরের বার্ষিক আয় ১ হাজার কোটি টাকা। 

আইএসপিবির সভাপতি ইমদাদুল হকের আশঙ্কা, এফডব্লিউএ সেবা শুরু হলে ১০ হাজার কোটি টাকার বাজারের অন্ততপক্ষে ৪০-৫০ শতাংশ সেলফোন অপারেটরদের দখলে চলে যাবে। তিনি বলেন, ‘দেশে আইএসপি অপারেটররা এখন ব্যবসায়িকভাবে বিপর্যস্ত রয়েছে। অপারেটরদের ৯০ শতাংশ সরঞ্জাম আমদানি করতে হয়। মূল্যস্ফীতি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে আমদানি খরচ অনেক বেড়েছে। এখন নতুন করে এফডব্লিউএ সেবার মাধ্যমে আমাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। অনেককে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে হতে পারে।’

আইএসপিবি সভাপতি বলেন, ‘আমাদের ২৫-৪০ শতাংশ মার্কেট আক্রান্ত হবে। বিদেশী অপারেটররা মার্কেট দখল করলে দেশীয় উদ্যোক্তারা ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না।’

দেশের টেলিকম অপারেটরদের জন্য সম্প্রতি নতুন লাইসেন্সিং গাইডলাইন প্রকাশ করে বিটিআরসি। ‘রেগুলেটরি অ্যান্ড লাইসেন্সিং গাইডলাইন ফর সেলুলার মোবাইল সার্ভিস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ গাইডলাইনে ১৪ ধরনের সেবার কথা বলা হয়েছে। এগুলোর একটি হলো ‘ফিক্সড ওয়্যারলেস অ্যাকসেস’ সেবা। এ সেবার মাধ্যমে টেলিকম অপারেটররা নির্দিষ্ট একটি জায়গায় উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড সেবা দিতে পারবে। 

সেলফোন অপারেটররা বলছে, এফডব্লিউএ সেবার মাধ্যমে ব্রডব্যান্ড অপারেটরদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। তারা কেবলের মাধ্যমে সেবা দেয়, আর অপারেটরদের সংযোগ হবে তারবিহীন। যে ভালো সেবা দিতে পারবে, গ্রাহক তাদেরই গ্রহণ করবে। এ ক্ষেত্রে আইএসপি অপারেটরদের নতুন নতুন সেবার মাধ্যমে গ্রাহক ধরে রাখতে হবে। 

সেলফোন অপারেটরদের এফডব্লিউএ সেবা প্রদানের অনুমোদন সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. বিএম মইনুল হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন প্রায় তিন হাজার আইএসপি অপারেটর রয়েছে। আইএসপির মাধ্যমে কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। তাদের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। এটা প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার। গ্রাহকদের সেবা দিয়ে এবং গ্রাহক সন্তুষ্টি অর্জন করে তাদের টিকে থাকতে হবে। এখানে কোনোভাবে শুধু একটি সার্ভিস দিয়ে বসে থাকলাম, এটা চিন্তা করলে হবে না। মোবাইল অপারেটররা যে সার্ভিস দেয়ার কথা বলছে, তা যে তারা পারবে, তা নয়। কিছু জায়গায় আইএসপি সেরা সমাধান।’ 

অধ্যাপক মইনুল হোসেন বলেন, ‘আইএসপিতে কিছু ইনোভেশন থাকতে হবে। আইএসপির মাধ্যমে কি আমি শুধু ইন্টারনেট সেবা দেব নাকি কনটেন্ট ডেলিভারির মতো সেবা দেব, তা ভাবতে হবে। এছাড়া এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, যেন সবাই মানসম্মত সেবা দিয়ে নিজেদের মতো ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে। একটি সুস্থ ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরি করা বিটিআরসির দায়িত্ব।’ 

বিটিআরসির কমিশনার প্রকৌশলী শেখ রিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘আমরা টেলিকম অপারেটরদের ফিক্সড ওয়্যারলেস সার্ভিসের সুযোগ দিয়েছি। কিন্তু এর মানে এটা নয় যে আইএসপি অপারেটরদের সেবায় বিঘ্ন ঘটিয়েছি। বিটিআরসি সবসময় ইকোসিস্টেম তৈরিতে বিশ্বাসী। বাজারে প্রতিযোগিতা থাকবে, যে যার মতো করে ব্যবসা পরিচালনা করবে। ওয়াই-ফাই সেবা এবং সেলফোন অপারেটরদের এফডব্লিউএ সেবা একই ধরনের মনে হলেও আলাদা।’

তিনি বলেন, ‘কেবলের মাধ্যমে ব্রডব্যান্ড কানেকশন যেভাবে কাজ করবে, ওয়্যারলেস প্রযুক্তিতে সেভাবে কাজ করবে না। আমাদের এখানে একসময় ল্যান্ডফোন ছিল, এখন ল্যান্ডফোন সেবা উঠে গেছে। কিন্তু ল্যান্ডফোন সেবা পৃথিবীর অনেক দেশেই চালু আছে। আমরা প্রযুক্তির উন্নয়ন করতে পারিনি বলে এ সমস্যা তৈরি হয়েছে। আইএসপি অপারেটরদেরও প্রযুক্তির আধুনিকায়নে কাজ করতে হবে। তাহলে তারা বাজারে টিকে থাকতে পারবে।’ 

এ বিষয়ে জানতে গ্রামীণফোনের এক্সটার্নাল কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্ট, রবির মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন এবং বাংলালিংকের করপোরেট কমিউনিকেশনে মেইল পাঠানো হয়। তবে কোনো প্রতিষ্ঠান গতকাল পর্যন্ত বক্তব্য দেয়নি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন