বিকেবির সঙ্গে একীভূত হচ্ছে রাকাব

সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চুক্তি

হাছান আদনান

ছবি : বণিক বার্তা

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) সঙ্গে একীভূত হচ্ছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)। সরকারের মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংক দুটির মধ্যে এ বিষয়ে মতৈক্য হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গতকাল অনুষ্ঠিত রুদ্ধদ্বার এক বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। সবকিছু ঠিকঠাক এগোলে আগামী সোমবার সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বিষয়টি বণিক বার্তাকে নিশ্চিত করেছেন।

সূত্র জানায়, বিকেবি ও রাকাবের একীভূতকরণের বিষয়ে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার গতকাল বৈঠক ডাকেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে ব্যাংক দুটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) অংশ নেন। উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। রুদ্ধদ্বার ওই বৈঠকেই ব্যাংক দুটির একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত হয়। যদিও বিষয়টি সব পক্ষ থেকেই গোপন রাখা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিকেবির এমডি মো. শওকত আলী খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গভর্নর স্যার দুই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিকে ডেকেছিলেন। সেখানে একীভূতকরণের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে সিদ্ধান্তের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জানানো হবে। এ বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। দুটি ব্যাংকেরই মালিকানা সরকারের। এখন সরকার যদি একীভূতকরণের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে অবশ্যই স্বাগত জানাব।’

রাষ্ট্রপতির এক আদেশে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। বিশেষায়িত এ ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠা হয়েছে মূলত ফসল, মাছ ও প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে ঋণ দেয়ার জন্য। যদিও ২০১০ সাল-পরবর্তী সময়ে সে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয় ব্যাংকটি। কৃষকদের ঋণ দেয়ার পরিবর্তে পুরোদমে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে কৃষি ব্যাংক। বড় ঋণ ও ঋণপত্র (এলসি) খোলার মাধ্যমে সরে যায় মূল লক্ষ্য থেকে। এ কারণে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে আর্থিকভাবে নাজুক পরিস্থিতিতে পড়ে।

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ভেঙেই ১৯৮৬ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কৃষি ব্যাংকের রাজশাহী বিভাগের শাখাগুলো নিয়েই ব্যাংকটির যাত্রা। এরই মধ্যে সরকার রাজশাহী বিভাগের আটটি জেলা নিয়ে রংপুর বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছে। এ কারণে বেশ কয়েক বছর ধরেই ব্যাংক দুটিকে একীভূত করে দেয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছিল। কৃষি ব্যাংকের মতোই ২০১০ সাল-পরবর্তী সময়ে রাকাবও লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে। প্রভাবশালী কিছু গ্রাহককে কোল্ডস্টোরেজ নির্মাণসহ বড় ঋণ দিয়ে বিপদ বাড়িয়েছে ব্যাংকটি। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিকেবির পরিশোধিত মূলধন ৯০০ কোটি টাকা। যদিও গত বছর পর্যন্ত ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১৬ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষায়িত ব্যাংকটির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ঠেকেছে ১৫ হাজার ২১৫ কোটি টাকায়। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ২০ শতাংশের বেশি খেলাপির খাতায় উঠেছে।

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ১ হাজার ৩৮টি শাখা নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ব্যাংকটিতে গ্রাহকদের আমানত রয়েছে ৪০ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা। এ আমানত থেকে ৩২ হাজার ৪৮ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা খেলাপি। মূলত ২০১০ সাল-পরবর্তী সময়ে বিতরণকৃত বড় ঋণগুলো ফেরত না আসায় বিকেবির খেলাপি ঋণ এতটা বেড়েছে। 

অন্যদিকে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে কার্যক্রম পরিচালনা করা রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের পরিস্থিতিও বেশ নাজুক। ৮২৪ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের এ ব্যাংক ২ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। ব্যাংকটিতে জমাকৃত আমানতের পরিমাণ ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। আর ৭ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকটি। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ১ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ২১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। বিকেবির মতোই বছরের পর বছর ধরে লোকসান দিয়ে যাচ্ছে রাকাব। বর্তমানে ব্যাংকটির শাখা রয়েছে ৩৮৩টি।

দেশের ব্যাংক খাতে ছয় মাস ধরেই মার্জার-অ্যাকুইজিশন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাচ্ছে ব্যাংকের সংখ্যা ৬১ থেকে কমিয়ে ৪৫-এ নামিয়ে আনতে। এরই মধ্যে অনিয়ম-দুর্নীতিতে বিধ্বস্ত পদ্মা ব্যাংককে একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এক্সিম ব্যাংক। গত ১৮ মার্চ বেসরকারি এ ব্যাংক দুটির মধ্যে এমওইউ স্বাক্ষর হয়। আরো পাঁচ-সাতটি বেসরকারি ও সরকারি ব্যাংককেও একীভূতকরণের বিষয়ে জোর আলোচনা চলছে। চলতি মাসেই আরো একাধিক ব্যাংক একীভূতকরণের ঘোষণা আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

পদ্মা ও এক্সিম ব্যাংকের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, পদ্মা ব্যাংকের যাবতীয় সম্পদ ও দায় এক্সিম ব্যাংকের অনুকূলে স্থানান্তর হবে। তবে পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সরকার গঠিত অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে চলে যাবে। ব্যাংকটির নিয়মিত ঋণ সার্ভিস করবে এক্সিম ব্যাংক। পদ্মা ব্যাংকের আমানতকারী, গ্রাহক, শাখা-উপশাখা, জনবলসহ যাবতীয় অবকাঠামো এক্সিম ব্যাংকের বলে পরিগণিত হবে। একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শেষ হলে দেশের আর্থিক খাতে আর পদ্মা ব্যাংকের অস্তিত্ব থাকবে না। তবে এখনই পদ্মা ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি যাবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, বিকেবি ও রাকাবের চুক্তিতেও একই ধরনের শর্ত থাকবে। একীভূতকরণ শেষ হলে রাকাবের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে। দুটি ব্যাংকেরই মালিকানা সরকারের হওয়ায় প্রক্রিয়াটি অপেক্ষাকৃত সহজ হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন