আলোকপাত

কিছু ধনী লোকের অধঃপতন দেখলে সত্যিই দুঃখ হয়

আবু আহমেদ

ছবি : বণিক বার্তা

স্থান-কাল ভেদে ধনী লোকের সংজ্ঞা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। কেউ ধনী জ্ঞানে, কেউ ধনী স্বাস্থ্যে, কেউ ধনী জনবলে। তবে সুস্থতা যে কত মূল্যবান সেটা ওই লোকই বেশি জানার কথা যে বারবার অসুস্থ হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু মানুষজন এমনই ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে আছে যে তারা সুস্থতাকে মূল্য কম দিয়ে আর্থিকভাবে অনেক বেশি ধনী হওয়ার জন্য হন্যে হয়ে ছুটে চলেছে। জ্ঞানে ধনী হওয়ার বিষয়টি অনেক লোকের কাছে একেবারেই মূল্যহীন। অধিকাংশ উচ্চবিত্ত লোককে জিজ্ঞাসা করে যে উত্তর পাওয়া যায় তা হলো—তারা স্কুল-কলেজে যে বিদ্যা অর্জন করেছে শুধু বেশি অর্থ উপার্জনের জন্য। অর্থাৎ তাদের কাছে জ্ঞান হলো অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার। তবে সব জ্ঞান যে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার তাও নয়। অনেক জ্ঞান দিয়েই কোনো অর্থ উপার্জন করা যায় না। ভাববিদ্যা ও দর্শনবিদ্যা বা এসব শাস্ত্র থেকে অর্জিত জ্ঞানের বাজারমূল্য কম। বাজারমূল্য ওই জ্ঞানেরই বেশি, যে জ্ঞান দিয়ে কিছু সৃষ্টি করা যায় বা কিছুতে পরিবর্তন করা যায় এবং ওইসব সৃষ্ট ও পরিবর্তিত কিছুর যদি বাজারমূল্য থাকে তাহলে বুঝে নিতে হবে সেই জ্ঞানের বাজারমূল্য আছে। অনেকের কাছে এর বাইরের জ্ঞানের কোনো মূল্য নেই। তবে এ ধারণা ভুল। ভালো মানুষ হওয়ার জন্যও জ্ঞান লাগে। অনেক কম শিক্ষিত লোক অনেক জ্ঞানী, আবার অনেক কথিত উচ্চশিক্ষিত লোকও অনেক মূর্খ। আমরা আমাদের সমাজেই দেখতে পাই নিরক্ষর অনেক লোক অনেক জ্ঞানী, তাদের জীবনবোধ অনেক প্রখর। হয়তো তারা দরিদ্র, কারণ তারা সেই জ্ঞান বাজারে বেচতে পারেনি। 

যা-ই হোক, ধনী লোক বলতে সারা বিশ্বেই বোঝায় যাদের অর্থকড়ি অনেক বেশি আছে তারা। সারা বিশ্বে ওইসব ধনী লোকদের র‍্যাংকিং প্রকাশ করার জন্য অনেক পত্রিকা, সাময়িকী আছে। ওইসব ধনী লোকদের কাহিনী-জীবনী অন্যরাও পড়ে, আবার স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইতেও তাদের ধনী হওয়ার কৌশল নিয়ে লেখাগুলো ছাত্ররাও পড়ে। ছাত্রদের কাছে তাদের রোল মডেল হিসেবে তুলে ধরা হয়। সর্বত্র ধন আর ধনীদের জয়গান। অর্থকড়ির পরিমাপে ধনী হওয়াটাই যেন জীবনের একমাত্র আরাধ্য বিষয়—এ ধারণাটা সর্বত্রই ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ওই ধরনের ধনী হতে গেলে সম্পদের মালিক হতে হবে। ওইসব সম্পদের যেগুলোর বাজারমূল্য আছে। অর্থের পেছনে দৌড়ানোর কারণে অনেক লোক আবার ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছে। সমাজে দুর্নীতি-ডাকাতি, ঠকবাজিতা—এ সবই ঘটছে ওইসব লোক অর্থের পেছনে ছুটছে বলে। বিশ্বে যত কেলেংকারি হচ্ছে, যত যুদ্ধ হচ্ছে, যত সংঘাত হচ্ছে সবই অর্থকে কেন্দ্র করে। অর্থের সংঘাত পরিবারের মধ্যেও চলে আসে। অর্থের কারণেই ঘরে ঘরে বিবাদ বাড়ছে, খুনাখুনি হচ্ছে। অর্থ হয়ে পড়েছে সবকিছুর নিয়ামক। আদালতে যেসব ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা প্রতিদিন রুজু হচ্ছে তার ৯০ শতাংশই অর্থকেন্দ্রিক এবং পাওনা-দেনার।

কম অর্থে কি জীবন ভালো চলে না; চলে। তবে সেটা বুঝের লোকদের জন্য। যে নৈতিকভাবে অধঃপতিত হয়ে গেছে তার কম অর্থে জীবন চলবে না। সুখকে সে অর্থের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে। তার কাছে মনে হবে সুস্বাস্থ্যও অর্থ দিয়ে কেনা যায়। হায়রে বোকা! সুস্থতা যদি অর্থ দিয়ে কেনা যেত তাহলে কথিত ধনী লোকেরা সবাই সুস্থ থাকত। অথচ সমাজের চারদিকে একটু ভালো করে চেয়ে দেখুন, ধনী লোকরাই বেশি অসুস্থ।

বাংলাদেশের কথাই চিন্তা করুন, ৩০-৪০ বছর আগে লোকেরা এত ধনী ছিল না। তবে তখন সুস্থতা ছিল। সমাজে এত স্বার্থপরতা ছিল না। এখন অনেক লোক অনেক ধনী হয়েছে। তাতে কি সমাজ সামগ্রিকভাবে সুখী হয়েছে? হয়নি। এর কারণ হলো, অর্থকড়ি অর্জনের মাধ্যমে যখন ধনী হওয়ার একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় তখন সমাজের অন্য মূল্যবোধগুলো হারিয়ে যায়। এখন ধনী লোকগুলোও সুখে নেই, অপেক্ষাকৃত কম আয়ের লোকগুলো হা-হুতাশের মধ্যে আছে। ধনের সঙ্গে পারিবারিক বন্ধনের যেন একটা বিপরীত সম্পর্ক। অনেক ধনী পরিবার শুধু ধন নিয়ে কলহ করতে করতে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছে গেছে। ধনকে সহ্য করার জন্য যে বিদ্যা প্রয়োজন তা অনেকেরই নেই। অনেক ধনী অতি ভালোবেসে সন্তানদের জন্য অনেক অর্থ জমা রেখে ইহলোক ত্যাগ করেছে। শেষ পর্যন্ত ওই ধনই হয়ে পড়েছে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কলহের কেন্দ্রবিন্দু। সেজন্য ভালো বিকল্প হলো সন্তানদের বৈষয়িক সম্পদ না দিয়ে ভালো শিক্ষা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করে দিন। দেখবেন সন্তানরা পরিশ্রম করা শিখেছে। খেটে অর্থ উপার্জন করা শিখেছে। সন্তানদের চরিত্রবান করে গড়ে তুলতে হবে। মিথ্যা থেকে দূরে থাকতে হবে। অন্যকে সম্মান করা জানতে হবে। সর্বোপরি সব কাজে সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা করা জানতে হবে। সমাজে ধনী লোকগুলো যদি সৎ থেকে, পরিশ্রম করে ধনী হন তাহলে সেটা হবে অবশ্যই গৌরবের। কিন্তু যদি সম্পদ অর্জিত হয় রাষ্ট্রের বা অন্যের অর্থকে আত্মসাৎ করে তাহলে সেই ধনী হওয়াটা হবে অভিসম্পাতের। অনেকে পদকে ব্যবহার করে ধনী হয়েছে। ওই প্রক্রিয়ায় যারা ধনী হয়েছে তারাও অভিসম্পাতের যোগ্য। এদের জন্য করুণা হয় যে, তারা বুঝতেও পারেনি যে তারা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে আছে। দুর্নীতিবাজ ধনী লোকদের যে কি পরিণতি হয় সেটা যদি অন্য দুর্নীতিবাজ লোকগুলো বুঝতে সক্ষম হতো তাহলে তারা তাৎক্ষণিকভাবে দুর্নীতির পথ থেকে সরে আসত। দুর্নীতিলব্ধ সম্পদ হলো কোবরা সাপের মতো, যে প্রতিনিয়তই ছোবল দেয়ার জন্য ফণা তুলতে থাকবে। দুর্নীতির মাধ্যমে প্রাপ্ত সম্পদের বোঝা অনেক ভারী। তবে অধিকাংশ এসব লোক শুধু দেরিতে অনুভব করে ওই বোঝাটার ভার। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। বড় বড় হাসপাতালের আইসিইউগুলো একবার ভিজিট করে দেখে আসেন কারা কোন ধরনের রোগীরা এগুলোয় ভর্তি আছে। অনেক অর্থ আছে কিন্তু তিনি খেতে পারেন না। তাহলে ওই অর্থের বাজারমূল্য থাকলেও তার কাছে ওই অর্থের কোনো মূল্য আছে কি? অধঃপতনের দিকে এরা এত দ্রুত ছুটে চলেছে। সেটা বোঝার জন্য যে ন্যূনতম বুঝ দরকার সেটাও যেন হারিয়ে ফেলেছে।

আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন