ডিএই-বিবিএসের পেঁয়াজ উৎপাদনের তথ্যে ফারাক

পেঁয়াজের বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখতে উৎপাদনের প্রকৃত তথ্য নিশ্চিত করতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

বাংলাদেশে নিত্য ভোগ্যপণ্য পেঁয়াজের চাহিদা ব্যাপক। চাহিদার সিংহভাগই পূরণ হয় দেশীয় উৎপাদনের মাধ্যমে। তবে উৎপাদন ও সংরক্ষণ পর্যায়ে কয়েক টন পেঁয়াজ প্রতি বছর নষ্টও হলে ঘাটতি দেখা দেয়। আমদানির মাধ্যমে এ ঘাটতি পূরণ হয়। আমদানির জন্য বাংলাদেশ মূলত নির্ভরশীল ভারতের ওপর। যেহেতু ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির খরচ কম এবং সহজে সড়কপথে আনা যায়। এ কারণেই পেঁয়াজ রফতানির ওপর ভারত নিষেধাজ্ঞা দিলে বাংলাদেশে পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়ে পড়ে, হুড়মুড় করে দাম বেড়ে যায়। দেশীয় উৎপাদন বাড়িয়ে, চাহিদা মাফিক সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলে পেঁয়াজের বাজার ও দাম স্থিতিশীল রাখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে দেশে উৎপাদনের সঠিক পরিমাণ জানা জরুরি। যদিও একদিকে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদনের প্রকৃত চিত্র নেই, আবার প্রাপ্ত তথ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। বণিক বার্তার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারের দুটি সংস্থা—কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মধ্যে পেঁয়াজ উৎপাদনের তফাৎ দেখা যাচ্ছে নয় লাখ টনের বেশি, যা মোট চাহিদার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। বলা বাহুল্য, এ তথ্যবিভ্রাট পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা তৈরির পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে। উৎপাদনের প্রকৃত তথ্য নিশ্চিত করতে সরকারি সংস্থাগুলোর উচিত সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে একক তথ্য প্রকাশ করা। সমন্বয় সাধনে বিবিএস অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। যেহেতু জাতীয়ভাবে বিবিএস যেকোনো পরিসংখ্যান প্রকাশের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা। 

উৎপাদনের সঠিক স্বরূপ না জেনে যথাযথ সিদ্ধান্ত বা নীতি গ্রহণ বেশ কঠিন। তথ্যে অমিল থাকায় পেঁয়াজের চাহিদা নিরূপণ এবং সরবরাহ নিশ্চিত করতে বেগ পোহাতে হচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। এর সুযোগ নিচ্ছে মুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা। আকস্মিকভাবে দাম বেড়ে গেলে ভোগান্তিতে পড়েন ভোক্তারা। তাই পেঁয়াজের বাজারদর স্থিতিশীল রাখা প্রয়োজন। এজন্য উৎপাদনের প্রকৃত চিত্র নিশ্চিত করতে হবে।

পেঁয়াজ নিয়ে সবচেয়ে বড় ভোগান্তি ঘটে ২০১৯ সালে ভারত হঠাৎ পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিলে। চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতিজনিত কারণে তাৎক্ষণিক পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়; আমদানিতে বেশ বেগ পেতে হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান, মিয়ানমার, তুরস্ক, চীন ও মিসর থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয় মন্ত্রণালয়। নৌ-স্থল-আকাশপথেও পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। এর পরও ওই সময় খুচরা বাজারে ২৫০-৩০০ টাকা ছুঁয়েছিল পেঁয়াজের দাম। এ ঘটনার পর সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পেঁয়াজের আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধি ভোক্তাদের জন্য বড় বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠেছে। 

বছরে ভোগ্যপণ্যটির চাহিদা ২৬ লাখ টন। তবে উৎপাদনের সঠিক হিসাবে রয়েছে ভিন্নতা। বিশেষজ্ঞদের মতে, তথ্যের গরমিলে চাহিদা-জোগানের পার্থক্য দেখা দেয় যা নীতি গ্রহণ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় সমস্যা তৈরি করে। প্রকৃত তথ্যের অভাবে সময়মতো আমদানি করা যায় না। ফলে বাজারে হঠাৎ সংকট দেখা দেয়। এতে ভোগান্তির শিকার হন ক্রেতারা।

ডিএইর তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার ৫০০ টন। তবে বিবিএস বলছে, একই অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল ২৫ লাখ ৪৬ হাজার ৯৯৪ টন। ফলে পেঁয়াজের উৎপাদন নিয়ে ডিএইর তুলনায় বিবিএসের তথ্যে পার্থক্য দেখা যাচ্ছে ৯ লাখ ৯ হাজার ৫০৬ টন। সংশ্লিষ্টদের মতে, পদ্ধতিগত পার্থক্যের কারণে এ দুই সংস্থার পেঁয়াজের উৎপাদন তথ্যে ব্যবধান দেখা যাচ্ছে। 

ডিএই মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। এছাড়া পেঁয়াজ শুকানোর পর এবং নষ্ট হওয়ায় পর যে পরিমাণ কমে যায় এবং চাহিদার ঘাটতি থাকে, সে পরিমাণ আমদানি করে থাকে। পক্ষান্তরে বিবিএস হিসাব করে উৎপাদন ও সংরক্ষণ পর্যায়ে নষ্ট হওয়ার পর পেঁয়াজের মোট উৎপাদন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে মোট পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৯৪ হাজার টন। ভারত ছাড়া চলতি অর্থবছরে পেঁয়াজ এসেছে চীন, পাকিস্তান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও নেদারল্যান্ডস থেকে। তবে সব মিলিয়ে বিকল্প এ ছয় দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে মোট আমদানির মাত্র শূন্য দশমিক ৮৭ শতাংশ। আবার এনবিআরের হিসাবে, ২০২২ সালে বাংলাদেশ ৭ লাখ ২৭ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করে। ওই বছর আর কোনো দেশ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি পেঁয়াজ আমদানি করেনি। এর পরের অবস্থানে ছিল যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র ও মালয়েশিয়া। আবার স্থানীয় উৎপাদনের দিক থেকেও বাংলাদেশ তেমন একটা পিছিয়ে নেই। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, পেঁয়াজ উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। ডিএইর হিসাব অনুযায়ীও দেশে চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত তিন অর্থবছরের ব্যবধানে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন বেড়েছে ৩৬ শতাংশের বেশি। কিন্তু স্থানীয় উৎপাদন বাড়লেও এখনো পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না, কেন আমদানি করতে হয়, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন দিয়ে চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না—এসব কারণ তদন্ত করা দরকার। 

অর্থনীতিবিদদের মতে, ‌তথ্য দেয়ার সময় নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কিছুটা বাড়িয়ে দেখানোর একটা প্রবণতা থাকে। আবার বিবিএস অনেক দেরিতে তথ্য প্রকাশ করে থাকে। ফলে বাজার ব্যবস্থাপনায় সেই তথ্য কোনো কাজে আসে না। তার ওপর তথ্যের অমিল বিভ্রান্তি তৈরি করে। সুতরাং সঠিক বাজার ব্যবস্থপনার জন্য এ দুই সংস্থার সমন্বিতভাবে হিসাব করা উচিত। তাহলে আশা করা যায় এ ধরনের অসংগতি দূর হবে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন