স্থিতিশীল বৈশ্বিক বাজার

ভোজ্যতেল গম চিনি ভুট্টার দেশীয় দামে প্রভাব নেই

সুজিত সাহা I চট্টগ্রাম ব্যুরো

ছবি : বণিক বার্তা

বিশ্ববাজারে প্রায় এক বছর ধরে ভোজ্যতেল, গম, চিনি ও ভুট্টার দাম স্থিতিশীল। সে তুলনায় অনেক বেশি দামে দেশের বাজারে লেনদেন হচ্ছে পণ্যগুলো। এর কারণ হিসেবে দেশে নানামুখী অর্থনৈতিক সংকট, মুষ্টিমেয় প্রতিষ্ঠানের হাতে আমদানিনির্ভরতা এবং মূল্য নির্ধারণের সরকারি চেষ্টা সত্ত্বেও তদারকির অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, ডলারের সংকট এবং সাম্প্রতিক মুদ্রাটির বিনিময় হার বৃদ্ধির ফলে আমদানি করা পণ্যের নতুন করে দাম বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

দেশের প্রধান খাদ্যশস্য চাল হলেও প্রতি বছর প্রায় ৬০-৬৫ লাখ টন গম আমদানি হয়। একসময় রাশিয়া-ইউক্রেন ছিল গম আমদানির প্রধান বাজার। ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকে এ খাদ্যশস্যের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন অঞ্চলে বিশ্বের প্রায় ২৮ শতাংশ গম উৎপাদন হয়। বৃহৎ এই সরবরাহকারী দুটি দেশের সংঘাতে অন্যতম আমদানিকারক হিসেবে বাংলাদেশে একপর্যায়ে আটা-ময়দার দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যায়। বর্তমানে বিশ্ববাজারে গমের দাম সহনীয় পর্যায়ে নামলেও দেশের বাজারে পণ্যটির দাম কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নামেনি। বরং সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধিজনিত সংকট দেখিয়ে দাম বেড়েছে মণে ৩০-৪০ টাকা।

একই পরিস্থিতি ভোজ্যতেল, চিনি ও ভুট্টার ক্ষেত্রেও। ভোজ্যতেলের মধ্যে পাম অয়েল ও সয়াবিন দেশের অন্যতম আমদানি পণ্য। সাধারণ মানুষ চালের মতোই মূল্যস্ফীতির সূচক হিসেবে ভোজ্যতেলের দামকে বিবেচনা করে। দেশে ভোজ্যতেলের দাম ২০২২ সালে লিটারপ্রতি ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। ওই সময়ে অপরিশোধিত সয়াবিনের বৈশ্বিক গড় দাম প্রায় ২ হাজার ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে। বর্তমানে সেটি নেমে এসেছে ১ হাজার ডলারের নিচে। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে সয়াবিনের বৈশ্বিক দাম ছিল ৯১২ ডলার, মার্চে ৯৬৫ ও এপ্রিলজুড়ে বিশ্ববাজারে গড়ে অপরিশোধিত সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ৯৫৯ ডলারে। এ হিসাবে ভোজ্যতেলের দাম অর্ধেকের বেশি কমে গেলেও দেশের বাজারে এখনো বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে লিটারপ্রতি ১৭৩ টাকায়। একইভাবে গত ফেব্রুয়ারিতে অপরিশোধিত পাম অয়েলের দাম টনপ্রতি নেমেছিল ৮৫৭ ডলারে। মার্চে কিছুটা বেড়ে ৯৪৩ ও এপ্রিলে ৯৩৬ ডলার হয়। যদিও ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর—তিন মাসে গড়ে অপরিশোধিত পাম অয়েল লেনদেন হয়েছে ৮১৬ ডলারে। বিশ্ববাজারে যে হারে দাম কমেছে সেই হারে দেশের বাজারে প্রভাব পড়েনি।

ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে বিশ্ববাজারে চিনির (অপরিশোধিত) যে দাম, তাতে দেশের বাজারে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকার মধ্যে লেনদেন হওয়ার কথা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে দেশে পাইকারি পর্যায়ে চিনি লেনদেন হচ্ছে মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ৪ হাজার ৪৫০ থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকায়। রোজার সময় অবৈধ পন্থায় চোরাইপথে ভারতীয় চিনি প্রবেশ করায় সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও কম দামে চিনি পাইকারি পর্যায়ে লেনদেন হয়েছিল। সরকারিভাবে চিনির দাম খুচরায় কেজিপ্রতি ১৪০ ও মোড়ক পর্যায়ে সর্বোচ্চ ১৪৫ টাকা নির্ধারণ করে রেখেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

বর্তমানে পাইকারি ও খুচরা বাজারের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশের বাজারে খুচরায় প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২৫-১৩০ টাকায়। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম দামে চিনি বিক্রির পরও দাম পুনর্নির্ধারণ না করায় দাম আশানুরূপ কমছে না বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ চিনি ডিলার ব্যবসায়ী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বণিক বার্তাকে জানান, বিশ্ববাজারে চিনির দাম অনেক কম। দেশে বাড়তি শুল্কের কারণে দাম পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অনেক বেশি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ খাদ্য ও চিনি শিল্প করপোরেশন চিনির দাম নির্ধারণ করে দিয়ে বাজার স্থিতিশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ কারণে দেশে অবৈধভাবে চোরাই চিনি প্রবেশ করছে। এতে সাধারণ ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। ভোগ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকারের দাম পুনর্নির্ধারণ ও বাজার মনিটরিং জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

গম, চিনি ও ভোজ্যতেলের পর খাদ্যশস্য হিসেবে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় ভুট্টা। সীমিত পর্যায়ে মানুষের খাবার ও খাদ্যের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হলেও ভুট্টা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় পশু, মুরগি ও মাছের খাবার তৈরিতে। ভুট্টার দাম বিশ্ববাজারে বিগত এক বছরের ব্যবধানে টনপ্রতি ১০০ ডলারের বেশি কমেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ভুট্টার দাম কমেছে কেজিপ্রতি ৩-৪ টাকা। যদিও বিশ্ববাজারের সঙ্গে প্রকৃত সমন্বয় হলে ভুট্টার দাম ছয় মাসের ব্যবধানে অন্তত ১০-১২ টাকা কমে যাওয়ার কথা ছিল। এ কারণে পোলট্রি মুরগি, কার্পজাতীয় মাছের দাম রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে লেনদেন হচ্ছে। অন্যদিকে এক বছরের বেশি সময় পর গমের দাম অন্তত ৭০ ডলার কমে লেনদেন হচ্ছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি-মার্চে গম টনপ্রতি প্রায় ৩০০ ডলারে লেনদেন হলেও সর্বশেষ এপ্রিলজুড়ে লেনদেন হয়েছে ২২৭ ডলারে। দেশের বাজারে কয়েক মাস আগে দাম কিছুটা নিম্নমুখী হলেও বর্তমানে সেটি আরো বেড়েছে।

দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের দেয়া তথ্যে দেখা গেছে, বর্তমানে পাম অয়েল মণপ্রতি লেনদেন হচ্ছে ৪ হাজার ৮০০ টাকা, সয়াবিন ৫ হাজার ৫০০, রাশিয়া ও ইউক্রেনের গম ১ হাজার ৩৮০ থেকে ১ হাজার ৪০০, কানাডীয় গম ১ হাজার ৬৫০ থেকে ১ হাজার ৬৮০ ও ভুট্টা মণপ্রতি ১ হাজার ৮৭০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকায়। বিশ্ববাজারে দাম কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এসব পণ্যের দাম মণপ্রতি ৫০০ থেকে দেড় হাজার টাকার মতো কমে যাওয়ার কথা ছিল।

আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের সংকট ও বিনিময় হার বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয়েছেন তারা। দেশে পণ্য আমদানিতে অনেক ক্ষেত্রে ডেফার্ড পদ্ধতিতে পেমেন্ট করতে হয় পরে। ফলে একদিনের ব্যবধানে ডলারের বিনিময় হার প্রায় সাড়ে ৭ টাকা বাড়ায় আগের কেনা পণ্যের ক্ষেত্রেও বেশি দাম দিতে হয়েছে।

‌ডলারের বিনিময় হার বাড়ানোর প্রভাব প্রশ্নাতীতভাবে ভোক্তা পর্যায়ে পড়বে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামভিত্তিক খাদ্যশস্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘‌পণ্যের চাহিদা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে নেমে আসার কারণে বর্তমানে আমদানিকারক-ব্যবসায়ীরাই প্রধান ভুক্তভোগী।’

দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডলারের বিনিময় হার বাড়ানোর পর পাইকারি বাজারগুলোয় প্রতি কেজি পণ্যের দাম বেড়েছে ৫-১০ টাকা। তবে শুরুতে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে পাইকারি বাজারে পণ্য লেনদেন কমে গেছে। আমদানি মূল্যের সঙ্গে যে পরিমাণ সমন্বয় হওয়ার কথা ছিল সেভাবে হয়নি বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, ডলারের বিনিময় হার বাড়লেও সরকারিভাবে নির্ধারিত অনেক পণ্যের দাম এখনই বাড়াতে পারছে না কোম্পানিগুলো। ভোজ্যতেল, চিনি, গম আমদানির সঙ্গে যুক্ত দেশের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকটি শিল্প গ্রুপ ও আমদানিকারকদের সংগঠনগুলো এরই মধ্যে পণ্যের দাম সমন্বয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছেন। দাম সমন্বয় না হওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো আগের চেয়ে পণ্য আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানান, সরকার বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্যারিফ কমিশনের মাধ্যমে এখনই দাম বাড়াতে চাইছে না। এ কারণে বেসরকারিভাবে পণ্য আমদানি কমে স্বাভাবিকভাবেই দাম সমন্বয়ের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌বিশ্ববাজারে দাম স্থিতিশীল থাকলেও দেশীয় পরিস্থিতির কারণে পণ্যের দামে প্রভাব পড়ছে না। সরকারিভাবে যে দাম বেঁধে দেয়া হয়েছে তার চেয়ে বেশি দামে এখন পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। আমরা এরই মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে দাম সমন্বয়ের আবেদন জানিয়েছি। বিশেষত ভোজ্যতেল, আটা-ময়দাসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির পর সমন্বয় জরুরি। মোড়কহীন পণ্যগুলোর ওপর ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই পড়লেও মোড়কজাত পণ্যের ক্ষেত্রে সরকারি দাম নির্ধারণ ছাড়া বিপণন সম্ভব নয়।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন