এক দশকে চামড়ার দাম কমেছে প্রতি বর্গফুটে ৩০ টাকা

আল ফাতাহ মামুন

ছবি : বণিক বার্তা ( ফাইল ছবি)

ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে ৩ জুন কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। এ বছর ঢাকায় গরুর লবণযুক্ত চামড়ার বর্গফুটপ্রতি দাম গত বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ ৫ টাকা, আর ঢাকার বাইরে সর্বোচ্চ ৭ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫-৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০-৫৫ টাকা। অন্যদিকে ঢাকার বাইরে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০-৫৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৪৫-৪৮ টাকা।

গত বছরের তুলনায় এ বছর চামড়ার দাম কিছুটা বাড়লেও গত এক দশকে দেশের কোরবানির পশুর চামড়ার দাম ক্রমান্বয়ে কমেছে। ২০১৩ সালে ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৮৫-৯০ টাকা আর খাসির চামড়ার দর ৫০-৫৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর ফলে ওই বছর রাজধানীতে ছোট আকারের গরুর চামড়ার দর ছিল প্রতিটি ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা, মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ১ হাজার ৮০০ থেকে আড়াই হাজার টাকা। আর বড় আকারের গরুর চামড়ার দর ছিল আড়াই হাজার থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, গরুর চামড়ার দর আনুষ্ঠানিকভাবে কমতে শুরু করে ২০১৪ সালে। ওই বছর চামড়া ব্যবসায়ীদের তিন সংগঠন চামড়ার দর ২০১৩ সালের তুলনায় কিছুটা কমিয়ে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৭০-৭৫ টাকা নির্ধারণ করে। যদিও বাস্তবে আরো বেশি দরে বিক্রি হয়েছিল, সেবার পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তায় লবণবিহীন প্রতি বর্গফুট চামড়া বিক্রি হয় ৯০-১০০ টাকায়। এরপর থেকে চামড়ার দর শুধু কমেছেই। কমতে কমতে ২০১৯ সালে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে অনেকে চামড়া ফেলে দিয়েছিলেন বা মাটিতে পুঁতে ফেলেছিলেন। 

বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে চামড়ার দাম কেন কমছে জানতে চাইলে পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক কল্লোল মোস্তফা বলেন, ‘কাঁচা চামড়ার কম মূল্যের পেছনে আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেট দায়ী। পাশাপাশি চামড়া শিল্পের পরিবেশগত কমপ্লায়েন্স সমস্যাও বড় কারণ। স্বাধীনতার এত বছর পরও দেশের চামড়া শিল্প পরিবেশ দূষণমুক্ত হতে পারেনি। যে কারণে ইউরোপের লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ মিলছে না। ফলে প্রক্রিয়াজাত চামড়া ইউরোপের বদলে চীনের বাজারে কম দামে রফতানি করতে হচ্ছে।’

জানা যায়, চামড়া শিল্পে দূষণের এ সমস্যা দীর্ঘদিনের। হাজারীবাগে থাকাকালে ট্যানারিগুলো প্রতিদিন প্রায় ২১ হাজার ৬০০ ঘনমিটার তরল বর্জ্য পরিশোধন না করেই সরাসরি বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলত। দূষণ কমাতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) নেতৃত্বে সাভারের হেমায়েতপুরে ১ হাজার ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা হয় চামড়া শিল্পনগরী, যার মধ্যে ৫২১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয় কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার বা সিইটিপি নির্মাণে।

২০১৭ সালে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সাভারে সরিয়ে নেয়া হলেও পরিবেশ দূষণ বন্ধ করা যায়নি। কারণ বিপুল অর্থ ব্যয় করে দুই বছরের বদলে নয় বছর সময় নিয়ে নির্মিত সিইটিপি চামড়া শিল্পের সব ধরনের বর্জ্য পূর্ণমাত্রায় পরিশোধনে সক্ষম নয়। 

হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সরাতে ২০০৩ সালে সাভার চামড়া শিল্পনগরীর প্রকল্প হাতে নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। মোট ১২ দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ১ হাজার ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি হয় এ শিল্পনগরী।

২০১৭ সালে বিসিকের নেতৃত্বে হেমায়েতপুরে স্থানান্তর হয় ট্যানারি শিল্প। কিন্তু তখনো শেষ হয়নি সেন্ট্রাল অ্যাফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্টের (সিইটিপি) কাজ। ফলে সিইটিপি ছাড়াই কাজ শুরু করে ১০০টির বেশি প্রতিষ্ঠান। এবার ট্যানারির দূষিত পানি মিশতে থাকে ধলেশ্বরী নদীতে। নতুন শিল্পনগরীও আগের মতোই দূষণ ছড়াতে থাকে। সব মিলিয়ে এত বিনিয়োগের পরও চামড়া শিল্পের সফল ক্ষেত্র হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি এ নগরী। এমনকি সঠিক পরিকল্পনার অভাবে ব্যবসায়ীদের বিপুল বিনিয়োগও কাজে লাগেনি। উল্টো পরিবেশ দূষণের দায়ে এসব ট্যানারি বন্ধ করে দেয়ার জন্য সংসদীয় কমিটি সুপারিশ করেছে। 

চামড়া শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে না পারায় ক্রমান্বয়ে রফতানি আয় হারাচ্ছে দেশ। চামড়া শিল্পের বাজার সম্পর্কে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের (বিআইজিএম) সহযোগী অধ্যাপক ড. মূহ. আব্দুর রহীম খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চামড়া শিল্পকেন্দ্রিক বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী চামড়াজাত পণ্যের বাজার ছিল ৪২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২৩ থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হারে প্রসারিত হয়ে ২০৩২ সালের মধ্যে ৭৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বিশ্বের মোট গবাদি পশুর ১ দশমিক ৩ থেকে ১ দশমিক ৮ শতাংশের আবাসস্থল বাংলাদেশ হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। এ করুণ ও ভগ্নদশার পেছনের কারণগুলোকে সক্রিয় বিবেচনায় আনতে হবে।’

বিআইজিএমের এ সহযোগী অধ্যাপক জানান, শুধু চামড়াই নয়, এসব পশুর হাড় বা অস্থিগুলো রূপান্তরের মাধ্যমে উপজাত (বাই-প্রডাক্ট) হিসেবে রফতানি বাজার দখল করে নিতে পারে। এত সম্ভাবনা সত্ত্বেও বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের অগ্রগতি পুরোটাই নেতিবাচক। ২০১৫ সালে এর বাজার ছিল ২৯৯ মিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৪ মিলিয়ন ডলারে। হ্রাসের এ ধারা অব্যাহত আছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন