কূটনীতির হাইপে যেভাবে দেশে বেড়ে চলেছে ইলিশের দাম

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

একসময় সাধারণ মধ্যবিত্তের পাতে ছিল ইলিশের নিত্য আনাগোনা। একেবারে নিম্নবিত্তেরও নাগালের বাইরে ছিল না ইলিশ। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বিশ্বের বেশির ভাগ ইলিশ বাংলাদেশেই উৎপাদন হয়। গত এক যুগে মাছটির উৎপাদন বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু অর্থনীতির সাধারণ নিয়মের ধারায় উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় বাজারে সরবরাহ বেড়ে মূল্য হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি ইলিশের ক্ষেত্রে ঘটেনি। বরং একই সময়ে উৎপাদনের মতো দামও বেড়ে হয়েছে কয়েক গুণ। আর সাধারণ মধ্যবিত্তের টেবিল থেকে বিদায় নিয়েছে ইলিশ। মাছটির ওপর একচেটিয়া অধিকার তৈরি হয়েছে অভিজাতবর্গের। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইলিশের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি কিছুটা শ্লথ হয়ে এসেছে। একই সঙ্গে মাছটি হয়ে উঠেছে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কূটনীতির হাতিয়ার। আবার এর প্রজননকালীন ব্যবস্থাপনাও প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সমন্বিত নয়। দুই দেশেই মাছটির বাজারমূল্যও বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। আর মধ্য ও নিম্নবিত্তের পাতে ক্রমেই দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে ইলিশ। 

কৃষি বিপণন অধিদপ্তর এবং ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বরেও দেশের বাজারে প্রতি কেজি ইলিশের দাম ছিল আকারভেদে ৫০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায়। আর গতকালের বাজারে আকারভেদে প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৮০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকায়। তবে বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঢাকার কোনো কোনো স্থানে তা আরো বেশি। 

ভারতে ইলিশ রফতানি করা হবে না—দায়িত্ব গ্রহণের পর এমন সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্টরা। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার দায়িত্ব গ্রহণের তিনদিন পর সচিবালয়ে ১১ আগস্ট সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘আমরা ভারতে কোনো ইলিশ পাঠাতে পারব না। এটি দামি মাছ। আমরা দেখেছি যে আমাদের দেশের মানুষই ইলিশ খেতে পারে না। কারণ সব ভারতে পাঠানো হয়। যেগুলো থাকে, সেগুলো অনেক দাম দিয়ে খেতে হয়।’ 

বর্তমানে সরকার সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। আসন্ন দুর্গা পূজা উপলক্ষে ভারতে তিন হাজার টন ইলিশ রফতানির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। গতকাল এ-সংক্রান্ত আদেশ জারি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সুলতানা আক্তার স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়, ‘আসন্ন দুর্গা পূজা উপলক্ষে বিভিন্ন রফতানিকারকের আবেদনের বিপরীতে নির্ধারিত শর্তাবলি পূরণ সাপেক্ষে ৩ (তিন) হাজার টন ইলিশ মাছ রফতানির অনুমোদন দেয়া হলো।’

আদেশে আরো বলা হয়, ‘সংশ্লিষ্ট আবেদনকারীদের আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর বেলা ১২টার মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। উল্লিখিত তারিখের পর আবেদন গ্রহণযোগ্য হবে না। যারা এরই মধ্যে আবেদন করেছেন, তাদের নতুন করে আবেদনের প্রয়োজন নেই।’

এ বিষয়ে গতকাল উপদেষ্টা ফরিদা আখতার মার্কিন সংবাদমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে সরবরাহের ওপর নির্ভর করবে কতটা রফতানি করা যাবে। এমনিতে এবার ইলিশ মাছের সরবরাহ কম। মাছ ধরাও কম হয়েছে। আবার যা ধরা হয়েছে তা নানা পথে চলে যাচ্ছে। যার ফলে দেশের বাজারে এখন কেমন প্রভাব পড়ে তা দেখার বিষয়।’

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশ থেকে ইলিশ রফতানি হয়েছিল প্রায় ৬৬৫ টন। এর আগের অর্থবছরে (২০২২-২৩) এর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩৭৬ টন। এছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ হাজার ২১১ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ হাজার ৮৮০ টন ইলিশ রফতানি হয়। 

বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রতি বছরই দুর্গা পূজার আগে দেশের বাজারে ইলিশের দাম বেড়ে যায়। একই সঙ্গে আলোচনায় আসে ভারতে ইলিশ রফতানির প্রসঙ্গটি। দুই দেশের কূটনীতিতে ইলিশকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হলেও তা থেকে কোনো দেশের সাধারণ মানুষের খুব একটা উপকার হয় না। বরং এ নিয়ে আলোচনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে ইলিশের দামও বাড়তে থাকে। এর সঙ্গে সঙ্গে চোরাই পথে ইলিশ পাচারও বাড়তে থাকে। চলতি বছরেও সীমান্তে ইলিশের এমন কিছু চালান ধরা পড়ার তথ্য পাওয়া গেছে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এক কূটনীতিক বলেন, ভারতে ইলিশের আবেদন আছে কেবল বাঙালিদের কাছে। ফলে দুই দেশের কূটনৈতিক দরকষাকষির কৌশল হিসেবে ইলিশ কোনোভাবেই তাৎপর্যপূর্ণ হাতিয়ার না। কোনো মূল্যায়ন ছাড়াই হাতিয়ার হিসেবে এ পণ্যটি ব্যবহারের নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকেই বেশি ভুগতে হয়। ইলিশের দাম বেড়ে যায় দেশের বাজারে। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

কলকাতাভিত্তিক ভারতীয় মাছ আমদানিকারকদের সংগঠন ফিশ ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এফআইএ) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা মাছ ৯৯ শতাংশই পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। এসব মাছ বিক্রি হয় কলকাতার বিভিন্ন পাইকারি বাজারে। মূলত হাওড়া বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। কলকাতার হাওড়া বাজারে যারা আমদানিকারকদের থেকে নিয়মিত মাছ ক্রয় করে তাদের মধ্যে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী আছে যারা মূলত সরবরাহকারী হিসেবেই পরিচিত। তারা ভারতের যেসব গন্তব্যে বাঙালি আছে, সেসব গন্তব্যে চাহিদা অনুযায়ী মাছ সরবরাহ করে। এসব এলাকার মধ্যে রয়েছে হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু, দিল্লি ও মুম্বাই। 

এফআইএ নেতারা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা ইলিশের ৯৯ শতাংশই কলকাতায় বিক্রি হয়। কলকাতা থেকে কার্টনে করে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় ইলিশ পাঠানো হয়। বাঙালিদের বাদ দিলে গোটা ভারতীয় জনগোষ্ঠীর কাছে ইলিশের কোনো গুরুত্ব নেই। অবাঙালি ভারতীয়রা ইলিশের প্রতি বিশেষ আবেদনের বিষয়টি কখনই অনুধাবন করতে পারে না, ফলে তাদের সঙ্গে ইলিশের কোনো সম্পর্ক নেই। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে ভারতে যে পরিমাণ ইলিশ রফতানির অনুমোদন দেয়া হয়; সাধারণত প্রকৃতপক্ষে রফতানি হয়েছে তার চেয়ে কম। 

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বরাবর ৯ সেপ্টেম্বর পাঠানো এক চিঠিতে দুর্গা পূজা উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে ইলিশ রফতানির অনুমোদনের বিষয়টি বিবেচনার তাগিদ জানায় এফআইএ। সংগঠনটি চিঠির সঙ্গে সংযুক্তিতে ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত রফতানির জন্য অনুমোদিত ও রফতানি হওয়া ইলিশের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়। এফআইএর ওই চিঠির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে সর্বশেষ অনুমোদিত পরিমাণে ইলিশ রফতানি হয়েছিল ২০১৯ ও ২০২০ সালে। এর মধ্যে ২০১৯ সালে রফতানির জন্য অনুমোদিত ও রফতানীকৃত ইলিশের পরিমাণ ছিল ৫০০ টন। ২০২০ সালে এর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৮৫০ টন। এরপর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ইলিশ রফতানির অনুমোদন দেয়া হয় ৪ হাজার ৬০০ টন। এর বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয় ১ হাজার ২০০ টন। পরের বছরের একই সময়ে ২ হাজার ৯০০ টন অনুমোদনের বিপরীতে রফতানি হয় ১ হাজার ৩০০ টন ইলিশ। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ইলিশ রফতানির অনুমোদন দেয়া হয় ৩ হাজার ৯৫০ টন। রফতানি হয়েছে ১ হাজার ৩০০ টন।

গতকাল রাতে বণিক বার্তার পক্ষ থেকে এফআইএর সেক্রেটারি সৈয়দ আনোয়ার মকসুদের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে ইলিশ রফতানি প্রসঙ্গে কথা বলতে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, ‘ইলিশ মাছের একটা মৌসুম তিন থেকে চার মাস চলে। আমরা কোনো মৌসুমেই পাঁচ হাজার টনের বেশি ইলিশ ভারতে নিয়ে আসতে পারিনি। আমার প্রশ্ন—বাংলাদেশে মৌসুমে লাখ লাখ টন ইলিশ ওঠে। এর মধ্যে পাঁচ হাজার টন ভারতে এলে কীভাবে বাংলাদেশের বাজারদর বেড়ে যায়? ভারতের জনগোষ্ঠীর মোট চাহিদা বিবেচনায় ইলিশ কোনোভাবেই কূটনৈতিক হাতিয়ার হওয়া উচিত না। বরং এতে ভিন্ন পথে ইলিশ আসা বেড়ে যায়।’

তিনি আরো বলেন, ‘একটা বড় বিষয় হলো বাংলাদেশী মানুষ যত টাকা দিয়ে শুধু মাছ না যেকোনো পণ্য কিনতে পারে, সেটা আমাদের এপারের বাঙালিরা পারে না। ইলিশ মাছও কেটে টুকরো করে কিনতে হয় ভারতীয় বাঙালিদের। ভারতে খুচরা বাজারে কখনই গোটা একটা ইলিশ মাছ বিক্রি হয় না। বাংলাদেশীরা হচ্ছে স্পেন্ডিং মাস্টার। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ স্পেন্ডিং মাস্টার না।’

বাংলাদেশে এখন ইলিশের উৎপাদন প্রবৃদ্ধিও কমে এসেছে। ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে আসার পেছনে নদ-নদী দখল, দূষণ, নদীতে পানির প্রবাহ হ্রাস এবং অপরিকল্পিত নৌ অবকাঠামোকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ইলিশ ডিম পাড়তে নদীর মোহনায় চলে আসে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নদীতে দখল-দূষণ, ডুবোচর ও বাঁধ-সেতুসহ নানা অবকাঠামোর প্রভাবে নদীতে বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মাছটির। ক্রমেই হুমকির মুখে পড়ছে ইলিশের প্রজনন।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায়ও নদীতে ইলিশের বিচরণ হ্রাস ও এর অস্তিত্বের নানা হুমকির কথা বলা হয়েছে। এতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সংকট, নদীতে অবকাঠামো নির্মাণ ও নদী দূষণ-দখলের প্রভাবের কথা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। অবকাঠামোর কারণে নদীর পানিতে পলি জমে সৃষ্টি হচ্ছে ডুবোচরের, বাড়ছে পানির অস্বচ্ছতা। এতে সমুদ্র থেকে নদীতে ইলিশের বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আবার পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ইলিশের প্রজনন ও খাদ্যাভ্যাস হুমকির মুখে পড়ছে। সমুদ্রে পানির স্তর বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে লবণাক্ততা এবং তা মিঠা পানিতেও ছড়িয়ে পড়ছে। উপকূলীয় এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি, প্রজনন ও নার্সারি এলাকার পরিবর্তনের কারণেও হুমকির সৃষ্টি হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন