পরিবহন ধর্মঘট ও অবরোধে স্থবির রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি

বণিক বার্তা প্রতিনিধি I রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি

পরিবহন ধর্মঘট ও অবরোধের কারণে গতকাল রাঙ্গামাটি শহর ছিল অনেকটাই ফাঁকা ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে গতকাল নতুন করে কোনো সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। তবে অবরোধ ও পরিবহন ধর্মঘটের কারণে গতকাল এ দুই জেলার জনজীবন ছিল অনেকটাই স্থবির। 

এদিকে পাহাড়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির চেষ্টা হলে হাত ভেঙে দেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। সহিংসতার ঘটনা খতিয়ে দেখতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে পাহাড়ি ও বাঙালিদের সম্প্রীতি নষ্ট করতে ‘বাইরে থেকে’ ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এএফ হাসান আরিফ।

পাহাড়ের সাম্প্রতিক সহিংসতার সূত্রপাত ঘটে বুধবার। ওইদিন চুরির অভিযোগে খাগড়াছড়িতে মামুন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এর প্রতিবাদে পরদিন দীঘিনালায় বিক্ষোভ করে বাঙালিরা। মিছিলের সময় সেখানে পাহাড়িদের সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে যায়। দীঘিনালায় সংঘর্ষের পর রাতে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে খাগড়াছড়ি সদরে। এসব ঘটনায় মৃত্যু হয় তিনজনের। শুক্রবার সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে আরেক পার্বত্য শহর রাঙ্গামাটিতেও। সেখানে সংঘর্ষে প্রাণ হারান একজন। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দুই জেলা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে স্থানীয় প্রশাসন। অন্যদিকে পাহাড়িদের ওপর হামলার প্রতিবাদে তিন পার্বত্য জেলায় গতকাল থেকে ৭২ ঘণ্টা অবরোধের ডাক দেয় ‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র-জনতা’। রাঙ্গামাটিতে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট ডাকে জেলা বাস, ট্রাক, সিএনজি ও মিনি ট্রাকচালক মালিক ঐক্য পরিষদ।

এর মধ্যে গতকাল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নেতৃত্বে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি পরিদর্শনে যায়। প্রতিনিধি দলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এএফ হাসান আরিফ ও পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমাও ছিলেন। সকালে তারা বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন রাঙ্গামাটিতে। এরপর তারা যান খাগড়াছড়ি।  

রাঙ্গামাটিতে সভার পর সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘পাহাড়ের ঘটনায় আমরা একটা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করব। তার আগে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনো অবস্থাতেই অবনতি হতে দেয়া যাবে না। আমি আপনাদের সবার সহযোগিতা চাই। যারা আইন-শৃঙ্খলা অবনতি করবে, তাদের কোনো অবস্থায় ছাড় দেব না। ভবিষ্যতে যদি তারা আবার চেষ্টা করে, তাদের হাত আমরা ভেঙে দেব।’

স্বরাষ্ট উপদেষ্টা আরো বলেন, ‘আপনাদের কাছে বারবার অনুরোধ করব, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেন উন্নতি হয়। আপনারা আমাদের সহযোগিতা করবেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহযোগিতা করবেন, প্রশাসনকে সহযোগিতা করবেন। জনগণকে বোঝাবেন, যেন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অটুট থাকে, ভালো থাকে।’

এএফ হাসান আরিফ বলেন, ‘পাহাড়ে আসার সময় দেয়ালে দেয়ালে যে গ্রাফিতি দেখেছি, গ্রাফিতির যে বার্তা, তা আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে দেখতে চাই। এখানে সম্প্রীতি থাকবে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা সবাই একসঙ্গে থাকব, একসঙ্গে কাজ করব। আজকের (শনিবার) বৈঠকে যেসব বক্তব্য এসেছে, সবার একই কথা—আমরা সম্প্রীতি চাই।’

তিনি আরো বলেন, ‘কেন জানি মনে হচ্ছে, কোথাও একটা ছন্দপতন হচ্ছে। ছন্দপতনের ব্যাপারে প্রত্যেকের মুখে একটা শব্দ উচ্চারিত হয়েছে—ষড়যন্ত্র। বাইরে থেকে একটা ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে আমাদের এ সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য।’

মতবিনিময় সভা হয় সেনাবাহিনী রাঙ্গামাটি রিজিয়নের প্রান্তিক হলরুমে। সেখানে সরকারি, সামরিক প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ছাড়াও পাহাড়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও বিশিষ্টজনরা মতামত তুলে ধরেন।

খাগড়াছড়িতে মতবিনিময় সভা শুরু হয় বেলা আড়াইটার দিকে, জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে। সভায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘যারা এ সহিংসতায় জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে, যা আগামীর জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।’

এএফ হাসান আরিফ বলেন, ‘একটি তুচ্ছ ঘটনাকে পরিকল্পিতভাবে বড় সহিংসতায় রূপান্তর করা হয়েছে। কেউ চুরি করলে তাকে বিচারবহির্ভূতভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলাও অনেক বড় অপরাধ।’

পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বলেন, ‘উসকানি ও গুজবের ফাঁদে পা দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের চেতনা যেন ম্লান না হয়। এজন্য পাহাড়ি-বাঙালি সবাইকে ভ্রাতৃত্বসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। সাম্প্রতিক সহিংসতায় অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে।’

থমথমে রাঙ্গামাটি

সংঘর্ষ ও সহিংসতার পর থেকেই থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে রাঙ্গামাটি শহরে। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে গতকাল সকাল থেকে যান চলাচল বন্ধ ছিল। ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকায় প্রায় জনশূন্য ছিল শহর। 

সরজমিনে দেখা যায়, জেলা শহরের বনরূপা এলাকার দোকানপাট বন্ধ। রিজার্ভবাজার ও তবলছড়ি এলাকায় কিছু দোকানপাট খোলা দেখা গেছে। শহরের দোয়েল চত্বর, পৌরসভা এলাকা, হ্যাপির মোড়, নিউমার্কেট, স্টেডিয়াম এলাকাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মোতায়েন ছিল পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী। 

শুক্রবারের সহিংসতায় অনেক জায়গায় ব্রন্ডব্যান্ডের সংযোগ পুড়ে যাওয়ায় গতকাল বেশির ভাগ এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ ছিল। তবে মোবাইল ইন্টারনেট সচল পাওয়া গেছে।

খাগড়াছড়ির জনজীবনও স্থবির

অবরোধের কারণে জেলা শহর থেকে গতকাল দূরপাল্লার কোনো যানবাহন ছেড়ে যায়নি। চলাচল করেনি অভ্যন্তরীণ সড়কের যানবাহনও। খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা সড়কের কয়েকটি স্থানে অবরোধের সমর্থনে পিকেটিংয়ের খবর পাওয়া গেছে। সাজেকগামী অনেক পর্যটক গতকাল খাগড়াছড়ি এলেও তারা জেলা শহরে আটকা পড়ে। দীর্ঘক্ষণ গাড়ির অপেক্ষায় থেকেও তারা সাজেকের উদ্দেশে রওনা হতে পারেনি। পর্যটকরা বলছে, অবরোধের কথা তারা জানত না। এছাড়া সাজেকে হোটেল ও রিসোর্টে অনেকের রুম বুকিং করা আছে।

ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়নি

পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার কোথাও সরকারিভাবে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের এ উপদেষ্টা বলেন, ‘সরকারিভাবে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করার বিষয়টি সত্য নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বা কোনো এলাকায় দীর্ঘ সময় ইন্টারনেট বন্ধ ছিল, এমন প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবে না।’ গতকাল ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলায় বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি পরিদর্শন করতে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন