অভিভাষণে প্রধান বিচারপতি

বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য পৃথক সচিবালয় হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক

সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেনে গতকাল অভিভাষণ অনুষ্ঠানে দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য পৃথক সচিবালয় করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেনে গতকাল সারা দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে দেয়া অভিভাষণে তিনি বলেছেন, ‘এটি হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রথম ধাপ। এর পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে।’ এ সময় ১৭ পৃষ্ঠার অভিভাষণে প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগ নিয়ে তার পরিকল্পনা ও রোডম্যাপ তুলে ধরেন।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল ও অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান আপিল বিভাগের প্রাক্তন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম রব্বানী এবং আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিরা। 

বিগত দিনে বিচার বিভাগের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ করা হয়েছে মন্তব্য করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, ‘দেশের কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বিগত সময়ে নগ্ন হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দুর্নীতি, অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিচার বিভাগের দুর্নাম করা হয়েছে। এতে বিচার বিভাগের ওপর আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অথচ বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা হচ্ছে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস। তাই নতুন এ বাংলাদেশে আমরা এমন একটি বিচার বিভাগ গড়তে চাই, যেটি বিচার এবং সততা ও অধিকারবোধের নিশ্চয়তার একটি নিরাপদ দুর্গে পরিণত হবে।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বিচার বিভাগে দুর্নীতিকে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করছি। জেলা জজ ও বিচারকদের দুর্নীতি দমনে ব্যর্থ হলে এটি তার পেশাগত অযোগ্যতা হিসেবে গণ্য করা হবে। আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করতে চাই, এ ধরনের কোনো অনিয়ম আর বরদাশত করা হবে না।’

মামলাজটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মামলাজট বিচার বিভাগের বড় সমস্যা হিসেবে সব আমলেই চিহ্নিত হয়ে এসেছে। বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ৪২ লাখ মামলা বিচার নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষমাণ। মামলাজটের অন্যতম কারণ মামলার তুলনায় বিচারকের সংখ্যা অপ্রতুল। মাত্র দুই হাজার বিচারক দিয়ে এটি সম্ভব নয়। দক্ষ জনবল নিয়োগ জরুরি।’

বিচার বিভাগের পৃথককরণ বিষয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘একটি ন্যায়ভিত্তিক বিচার ব্যবস্থার কাজ হলো নিরপেক্ষভাবে, স্বল্প সময় ও খরচে বিরোধের মীমাংসা নিশ্চিত করে জনগণ, সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুরক্ষা দেয়া। এজন্য বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ ও আইন সভা থেকে পৃথক ও স্বাধীন করা সবচেয়ে জরুরি। কেননা শাসকের আইন নয় বরং আইনের শাসন নিশ্চিত করাই বিচার বিভাগের মূল দায়িত্ব।’ 

সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, ‘বিচারকাজে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বিচারের গতি ও মানকে অনেক উন্নত করতে পারে। সরকারের অন্যান্য অনেক বিভাগে এরই মধ্যে দাপ্তরিক কাজকর্ম ডিজিটাল পদ্ধতিতে করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিচার বিভাগের পিছিয়ে থাকা সমীচীন নয়। বিচার বিভাগকে ডিজিটালাইজড করার জন্য দ্রুত ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। ই-জুডিসিয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে দেশের বিচার ব্যবস্থায় ভার্চুয়াল পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দসহ কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আমি সরকারকে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।’ বিচারপতিদের উদ্দেশে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘বিচার বিভাগে যদি এমন কোনো বিচারক থাকেন, যিনি মানুষের কাছ থেকে তরবারি উপহার নেন, ছাত্রসংগঠনের কাছ থকে ফুল উপহার নেন, মৌলিক অধিকার ছিনিয়ে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলেন। বিচার বিভাগের জন্য এসব ভালো কিছু না। আপনারা কোনো দলীয় মনোভাব রাখবেন না। আপনার বিবেকের সঙ্গে কথা বলেন, কারো সঙ্গে অবিচার করবেন না। নিম্ন আদালতে যারা আছেন, আপনারা মানুষকে যতটুকু সম্ভব হয়রানিমুক্ত রাখবেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘এরই মধ্যে কমিশন গঠন করা হয়েছে। আমরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চাই।’

বিগত সরকারের আমলে বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এক মামলার প্রসঙ্গ টেনে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনারা ড. ইউনূসের আর্জি গ্রহণ করতে বিব্রতবোধ করেছিলেন। কেন করেছিলেন? এটা আপনার দায়িত্ব না? আপনার এটা সাংবিধানিক দায়িত্ব না? আপনি শুনে (শুনানি গ্রহণ করে) রিজেক্ট করে দেন, সমস্যা নেই। আপনি শুনবেনই না। আপনাদের সুনাম কিছু বিচারপতির কারণে ক্ষুণ্ন হয়েছে। এগুলো আর করবেন না। মানুষ বোকা না, মানুষের বিচার-বুদ্ধি আছে।’

অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘বিগত দেড় দশক সময়ে খুন, গুম, হামলা, মামলা, দমন, পীড়ন ও লুটপাটের মাধ্যমে নাগরিকদের মানবাধিকার ও ভোটের অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। দেশী ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট) পর্যন্ত চার হাজারের বেশি মানুষ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। ৭০০-এর অধিক মানুষ গুমের শিকার হয়েছে। সেই দুঃসময়ে আমাদের বিচার বিভাগ ন্যায়বিচারের ধারা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। হয় দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন, নয়তো নতজানু অবস্থান নিয়েছেন। আপনারা জেনে আনন্দিত হবেন, ৩৬ জুলাই থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কেউ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়নি। তার মূল কৃতিত্ব যেতে পারে আমাদের শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক আসিফ নজরুলের নেতৃত্বের প্রতি।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন