উপাচার্য নিয়োগ হয়নি

প্রশাসনিক সংকটে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

আনিসুর রহমান

ছবি : বণিক বার্তা

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের পর দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা পদত্যাগ করতে থাকেন। পদত্যাগ করেন উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তাও। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পদত্যাগ না করলেও কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিরা। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয় ‘অভিভাবকহীন’ হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে অবশ্য বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু এখনো অন্তত ১৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয়নি। ফলে এসব বিশ্ববিদ্যালয় একধরনের প্রশাসনিক সংকটের মুখে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অবিলম্বে উপাচার্য ও শীর্ষস্থানীয় প্রশাসনিক পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ক্যাম্পাসগুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

গত ৮ আগস্ট শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পদত্যাগ করেন কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শেখ আব্দুস সালাম, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান ও কোষাধ্যক্ষ ড. আলমগীর হোসেন ভূঁইয়া। 

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জানান, উপাচার্যসহ প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলো ফাঁকা থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভা ও একাডেমিক কাউন্সিল নিয়মিত হচ্ছে না। ফলে প্রশাসনিক জটিলতা বেড়েছে। ক্লাস অনলাইনে চললেও পরীক্ষাসহ অন্যান্য কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে এক মাসের বেশি সময় ধরে। অধিকাংশ আবাসিক হলে দেখা দিয়েছে নানা সংকট। সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পাচ্ছেন না হল দেখভালের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। সংকট নিরসনে দ্রুত সময়ের মধ্যে যোগ্য উপাচার্য নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন তারা। 

স্থবিরতা বিরাজ করছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়েও (ববি)। গত ২০ আগস্ট শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে পদত্যাগ করেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. বদরুজ্জামানসহ প্রশাসনিক পদের ১৯ জন। এসব গুরুত্বপূর্ণ পদ খালি থাকায় নানা সমস্যায় পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। 

শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জানান, পরীক্ষা-ক্লাস পিছিয়ে যাওয়ায় সেশনজটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। উপাচার্য না থাকায় পরীক্ষক নিযুক্ত করা যাচ্ছে না। উপাচার্য ছাড়া করা যাচ্ছে না অনেক ধরনের আর্থিক লেনদেনও।

গত ১১ আগস্ট শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পদত্যাগ করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আব্দুল মঈন। ২৮ আগস্ট পদত্যাগ করেন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. হুমায়ুন কবির। এ ক্যাম্পাসেও এখনো নতুন উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয়নি।

উপাচার্য নিয়োগের দাবিতে গতকাল বিক্ষোভ ও মানববন্ধন হয় হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (হাবিপ্রবি)। বিশ্ববিদ্যালয়ের  ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে উপাচার্য না থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেশন জটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।’

উপাচার্য না থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় জ্যেষ্ঠ অধ্যাপককে দিয়ে সাময়িকভাবে জরুরি প্রশাসনিক ও আর্থিক দায়িত্ব চালিয়ে নিতে গত ২৯ আগস্ট নির্দেশনা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে এ নির্দেশনা মোতাবেক পরিচালিত হচ্ছে। তবে অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী মনে করেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ পরামর্শ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের পরিপন্থী।

গত ১৯ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরকৃবি) অধ্যাপক ড. মো. গিয়াসউদ্দীন মিয়া উপাচার্যের পদ থেকে সরে দাঁড়ান। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনার সাময়িক দায়িত্ব পেয়েছেন মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জি কে এম মোস্তাফিজুর রহমান। নতুন উপাচার্য নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক, আর্থিক ও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। 

শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে পদত্যাগ করেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. জামাল উদ্দিন ভূঞা। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অ্যানিমেল ও বায়োমেডিকেল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. ছিদ্দিকুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব দেয়া হয়।

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) উপাচার্য মো. জাহাঙ্গীর আলম পদত্যাগ করেন ১ সেপ্টেম্বর। বর্তমানে জ্যেষ্ঠ ডিন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন। 

গত ২০ আগস্ট খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রারসহ প্রশাসনিক প্রধানরা একযোগে পদত্যাগ করলে প্রশাসনিক সংকট দেখা দেয়। এরপর ২ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন ও ডিসিপ্লিন প্রধানদের সভায় জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিমকে জরুরি প্রশাসনিক ও আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। 

গত ১৭ আগস্ট পদত্যাগ করেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. স্বদেশ চন্দ্র সামন্ত। পরে অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পান কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক মোহাম্মদ জামাল হোসেন। 

২১ আগস্ট পদত্যাগ করেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) উপাচার্য আনোয়ার হোসেন। বর্তমানে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এইচএম জাকির হোসেন আর্থিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করছেন। 

গত ১০ আগস্ট পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য এসএম মোস্তফা কামাল খান ও কোষাধ্যক্ষ কেএম সালাহ উদ্দিন পদত্যাগ করেন। ২১ আগস্ট পদত্যাগ করেন উপাচার্য অধ্যাপক হাফিজা খাতুন। এর পর থেকেই অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি। স্থবিরতা তৈরি হয় প্রশাসনিক কার্যক্রমে।

শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০ আগস্ট পদত্যাগ করেন গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক একিউএম মাহবুব। এর আগের দিন পদত্যাগ করেন রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সেলিনা আক্তার ও উপ-উপাচার্য কাঞ্চন চাকমা। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গতিশীলতার স্বার্থে অবিলম্বে উপাচার্যসহ প্রশাসনের শীর্ষ পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. মহিউদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উপাচার্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ব্যক্তি। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিদ্ধান্তগুলো উপাচার্যের নির্দেশে হয়। ফলে দু-এক সপ্তাহের জন্য কেউ রুটিন দায়িত্ব পালন করতে পারেন। কিন্তু দেড় মাস বা আরো দীর্ঘ সময় উপাচার্য ছাড়া চলে না। তাই যত দ্রুত সম্ভব উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সচল করার উদ্যোগ নেয়া উচিত।’

ড. মহিউদ্দিন মনে করেন উপাচার্য নিয়োগ দিতে যত দেরি হবে, ক্যাম্পাসগুলোয় স্থিতিশীলতা ফিরতে তত দেরি হবে। শিক্ষাও পিছিয়ে পড়বে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন