দুর্বল ব্যাংকে আমানত রেখে বিপাকে চট্টগ্রাম বন্দর

রাশেদ এইচ চৌধুরী, চট্টগ্রাম ব্যুরো

ছবি : বণিক বার্তা ( ফাইল ছবি)

দুর্বল ও সমস্যাযুক্ত ব্যাংকগুলোয় টাকা রেখে বিপাকে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। মেয়াদি আমানতে বন্দরের যে বিনিয়োগ রয়েছে তার বিপরীতে সুদ দেয়াও বন্ধ করে দিয়েছে একাধিক ব্যাংক। বর্তমানে রেড জোনে থাকা কয়েকটি ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিতে বারবার পদক্ষেপ নিয়েও ব্যর্থ হয়েছে সংস্থাটি। জমানো টাকা ফেরত না পাওয়ায় বন্দর কর্তৃপক্ষ এ অর্থ পুনর্বিনিয়োগও করতে পারছে না। ফলে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করতে বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর এমন আচরণ ব্যাংকিং সুলভ নয় উল্লেখ করে আর্থিক ক্ষতির চিত্র তুলে ধরে চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে চিঠি দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। 

এতে বলা হয়েছে, ব্যাংক থেকে সুদ না পাওয়া ও নগদায়ন করে পুনর্বিনিয়োগ করতে না পারায় বন্দরের চলমান গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হচ্ছে না। 

উন্নয়ন প্রকল্প ও যন্ত্রপাতি ক্রয় স্বাভাবিক রাখতে বন্দরের নামে পরিচালিত ব্যাংক হিসাব ঝুঁকিমুক্ত রাখার পদক্ষেপ হিসেবে নগদায়নপূর্বক অর্থ পরিশোধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ প্রদানে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়েছে।  

সংশ্লিষ্টরা জানান, যেসব ব্যাংকে আমানত রেখে বিপাকে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর তার একটি হলো পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক)। শুরু থেকেই এ ব্যাংকের কার্যক্রম ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। লবিং করে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত জমা নিয়ে অনিয়ম আর দুর্নীতি শুরু করেন এর উদ্যোক্তারা। প্রায় দেউলিয়া হয়ে এখনো একীভূত হওয়ার চেষ্টায় আছে ব্যাংকটি। পদ্মা ব্যাংকের শুধু খাতুনগঞ্জ শাখায় চট্টগ্রাম বন্দরের ২২টি মেয়াদি আমানতের বিপরীতে ১৭৯ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। ব্যাংকিং নীতিমালা অনুযায়ী, আমানতের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখে সুদ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকলেও গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে বন্দরকে সুদ দেয়া বন্ধ করে দেয় পদ্মা ব্যাংক। এ অবস্থায় বন্দর কর্তৃপক্ষ এ শাখার ২২টি মেয়াদি আমানতের মধ্যে ছয়টির বিপরীতে ৯৫ কোটি টাকা নগদায়নের জন্য চিঠি দেয়। কিন্তু তাতে সাড়া দেয়নি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। পদ্মা ব্যাংক ছাড়াও চিঠি দেয়ার পরও বন্দরের তহবিলে টাকা জমা দিচ্ছে না এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে বেসিক ব্যাংক, আইসিবি, ন্যাশনাল ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। 

বন্দরের কর্মকর্তারা বলছেন, নাজুক ব্যাংকগুলোয় চলমান অস্থিরতা বিশেষ করে এস আলম সংশ্লিষ্ট ব্যাংক নিয়ে বড় উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতের ক্ষতগুলো সামনে আসতে শুরু করেছে। ব্যাংকের তহবিল লুটপাটের চিত্র প্রকাশ পেতে থাকায় আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। এমনকি আর্থিক সংকটে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে না পেরে ব্যাংকের শাখা বন্ধ করে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য বলছে, দুর্বল ব্যাংকে থাকা বিনিয়োগকৃত মেয়াদি আমানতের মধ্যে এস আলম সংশ্লিষ্ট চার ব্যাংকের ২১টি শাখায়ই প্রায় হাজার কোটি টাকার তহবিল রয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষের। এর মধ্যে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের চারটি শাখায় ২১২ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চারটি শাখায় ১৯০ কোটি টাকা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের দুটি শাখায় ১১৫ কোটি টাকা ও ইউনিয়ন ব্যাংকের ১১টি শাখায় ৪১১ কোটি টাকা রয়েছে। 

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নেয়া আমানতকারী হিসেবে আমাদের অধিকার। বিনিয়োগ করে তার বিপরীতে ইন্টারেস্ট না পাওয়াটা শুধু দুঃখজনকই নয়, এটা ব্যাংকিংসুলভ আচরণ পরিপন্থী। এতে বন্দর আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া নিরাপদ বোধ না করায় দুর্বল ও সমস্যাযুক্ত ব্যাংকগুলো থেকে আমরা টাকা তুলে নিতে চাচ্ছি, কিন্তু তাও সম্ভব হচ্ছে না। এজন্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি দিয়ে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করতে বাধার সম্মুখীন হওয়ার বিষয়টি অবগত করা হয়েছে।’ 

এফডিআরের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের তহবিল দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে রাখা হয়েছে। মূলত জাহাজ ভেড়ানো, পণ্য ওঠানামা, ইয়ার্ড ভাড়া এবং নিজস্ব জমির ভাড়াসহ বিভিন্ন খাত থেকে প্রতি বছর এ অর্থ আয় করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। আবার এ তহবিল থেকেই বন্দরের চলমান অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। এছাড়া পরিচালন কার্যক্রমের জন্য যন্ত্রপাতি, জনবল ও অপারেশনাল ব্যয়ও নির্বাহ করা হয় এ তহবিলের অর্থে। ফলে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার স্বার্থেই চট্টগ্রাম বন্দরের আমানত ঝুঁকিমুক্ত থাকা অত্যাবশ্যক।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন