প্রাথমিক জ্বালানির সরবরাহ ঠিক রাখাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ

আবু তাহের

ছবি : বণিক বার্তা

দেশে প্রতি বছর জ্বালানি আমদানি করতে হয় অন্তত ১৩ বিলিয়ন ডলারের। এর অর্ধেকের কাছাকাছি বা ৬ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানির প্রয়োজন পড়ে শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনে। সামনের দিনগুলোয় এ ব্যয় আরো বাড়ার পূর্বাভাস রয়েছে। যদিও এজন্য প্রয়োজনীয় ডলারের সংস্থান করা যাচ্ছে না। প্রয়োজনমতো কয়লা, এলএনজি ও ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে না পারায় ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে সারা দেশে। শিল্প-কারখানাসহ বিভিন্ন খাতেও এর প্রভাব বাড়ছে। গ্যাস সংকটে ব্যাপক মাত্রায় বিঘ্নিত হচ্ছে সার উৎপাদন। জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল করতে অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন প্রাথমিক জ্বালানির (জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কয়লা) সরবরাহ ঠিক রাখা। 

দেশে প্রাথমিক জ্বালানির সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় বিদ্যুৎ খাতে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে খাতটির পরিকল্পনাগুলো আবর্তিত হয়েছে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) হিসাব অনুযায়ী, দেশে গ্যাস, কয়লা, ফার্নেস অয়েল, ডিজেল ও এলএনজি-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মোট সক্ষমতা এখন ২৫ হাজার ৭৩৮ মেগাওয়াট। এর সিংহভাগই তৈরি হয়েছে গত দেড় দশকে। উৎপাদন সক্ষমতায় জোর দেয়া হলেও উপেক্ষিত থেকেছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর প্রয়োজনীয় জ্বালানি সংস্থানের বিষয়টি। কিন্তু এসব কেন্দ্র চালানোর জন্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ, পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ ও অবকাঠামো সক্ষমতা গড়ে তোলা যায়নি। মহাপরিকল্পনাগুলো সাজানো হয়েছে আমদানীকৃত জ্বালানির ওপর ভিত্তি করে। 

দেশে জাতীয় গ্রিডে মোট গ্যাস সরবরাহের এক-তৃতীয়াংশই আসে আমদানীকৃত এলএনজির মাধ্যমে। কিন্তু এলএনজি সরবরাহের জন্য দুটি টার্মিনালের একটি দুর্ঘটনার কারণে বন্ধ ছিল সাড়ে তিন মাস। এ সময় দেশে গ্যাসের সংকট তীব্র হয়ে দেখা দেয়। বর্তমানে দুটি টার্মিনাল সচল থাকলেও এখনই পূর্ণ সক্ষমতায় এলএনজি দেয়া যাচ্ছে না। কারণ প্রয়োজনীয় এলএনজি আমদানি করতে পারছে না পেট্রোবাংলা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ আইন স্থগিত করায় দ্রুততার সঙ্গে কোনো একটি কোম্পানিকে দিয়ে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির সুযোগ এখন আর নেই। দরপত্রের মাধ্যমে এলএনজি আমদানি করতে চলতি মাসের পুরোটা লেগে যেতে পারে বলে পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে।

পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সামিটের এলএনজি টার্মিনাল চালু করা হয়েছে। তবে এখনো সেখান থেকে পূর্ণ সক্ষমতায় গ্যাস পাওয়া যাবে না। যতটুকু তাদের টার্মিনালে রিজার্ভ রয়েছে, সেটুকু দিয়ে সীমিত পরিসরে সরবরাহ করবে তারা। আর পূর্ণ সক্ষমতায় টার্মিনাল দিয়ে গ্যাস পেতে আগামী ৫-৬ অক্টোবর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।’

দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। যদিও সর্বোচ্চ সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে। পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় চালাতে হলে প্রতিদিন ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন। তবে কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণ, অদক্ষ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হিসাব বাদ দিলে গ্যাস প্রয়োজন অন্তত ১ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো এখন দিনে গ্যাস পাচ্ছে গড়ে সাড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাস না থাকায় বাকি কেন্দ্রগুলো অলস বসিয়ে রাখতে হচ্ছে বিপিডিবিকে।

দেশে জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে ৬ হাজার ১৭৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার। এর ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রের সক্ষমতা ৫ হাজার ৮৮৫ মেগাওয়াট। ডিজেলভিত্তিকের সক্ষমতা ২৯০ মেগাওয়াট। এসব কেন্দ্র থেকে এখন দিনে এক হাজার থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে। বাকিটুকু অলস বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। এ ধরনের কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অন্যগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। আমদানীকৃত বিদ্যুৎকে হিসাবে না নিলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা ৭ হাজার ১৭৯ মেগাওয়াট। এর মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা যাচ্ছে গড়ে সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট। বাকি অর্ধেকের বেশি সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রাখতে হচ্ছে।

প্রাথমিক জ্বালানি আমদানিতে সৃষ্ট এ সংকট অনুধাবন করতে পারছেন অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্টরাও। এরই মধ্যে জ্বালানি আমদানিতে অর্থ সংস্থানের জন্য বাজেট সহায়তা হিসেবে বিশ্বব্যাংকের কাছে ১ বিলিয়ন ডলার চাওয়া হয়েছে। গত সপ্তাহে দেয়া এক চিঠিতে দুই কিস্তিতে ৫০ কোটি ডলার করে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)।

জ্বালানি সংকটে চাহিদামাফিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। বিদ্যুতের চাহিদা ১৩ হাজার মেগাওয়াট ছাড়ালেই লোডশেডিং হচ্ছে। তিন সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশাবাদী অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। গত ১১ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ে এক মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, ‘আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যুতের বর্তমান অবস্থার উন্নতি হবে।’

গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো বন্ধ রাখতে হচ্ছে সার কারখানাগুলোও। দেশের তিনটি ইউরিয়া সার কারখানা গত ছয় মাসে পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়েছে। সর্বশেষ গতকালও সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের হযরত শাহজালাল সার-কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে শুধু নরসিংদীর ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে। চাহিদামাফিক উৎপাদন না হওয়ায় আগামী বোরো মৌসুমে সারের সরবরাহ নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। গ্যাস সংকটে কারখানা বন্ধ হওয়ায় এ বছর সাত লাখ টন ইউরিয়া উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে সংশয় রয়েছে।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশে সার উৎপাদনে অন্যতম কাঁচামাল গ্যাস। দেশে পাঁচটি সার কারখানায় স্বাভাবিকভাবে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হলে প্রতিদিন গড়ে ৩২৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন। সেখানে সার কারখানাগুলো গ্যাসের সরবরাহ পায় ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। 

জ্বালানি খাতের শীর্ষ অন্তত দুজন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানান, দেশে জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারের কোনো সংকট নেই। এমনকি সরবরাহকারীদের কাছ থেকেও বড় কোনো ইস্যু নেই। জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ডলার ও এলসি নিষ্পত্তি করা গেলে সুষ্ঠুভাবে জ্বালানি সরবরাহ ঠিক রাখা যাবে। তবে এ মুহূর্তে জ্বালানি খাতে ডলার প্রয়োজন। এমনকি যেসব এলসির নিষ্পত্তি আটকে রয়েছে, সেগুলো ঠিক করা দরকার। সরবরাহকারীদের সঙ্গে নিয়মিত লেনদেন ঠিক না রাখলে কিছুটা সংকট থেকেই যায়।

বাংলাদেশ পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক কর্মজোট বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এক্সটার্নাল ডেবটের (বিডব্লিউজিইডি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মোট উৎপাদন সক্ষমতা ২৪ হাজার ২৪২ মেগাওয়াট। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ৫৬ শতাংশই অলস বসে থেকে বিপিডিবি থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ক্যাপসিটি চার্জ হিসেবে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতি মাসে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানিতে অর্থ দরকার ৫০ কোটি ডলার। সে হিসাবে প্রতি বছর জ্বীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জ্বালানি আমদানিতে প্রয়োজন বছরে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার। 

যদিও এজন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলার নেই সরকারের কাছে। এ কারণে চাহিদা বাড়লেও বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় চালানো যাচ্ছে না। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম এখন নিম্নমুখী। কিন্তু তা আমদানি করা যাচ্ছে না শুধু ডলার সংকটের কারণে। ফলে কখনো বৃহৎ এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট আবার কখনো পুরো বিদ্যুৎ কেন্দ্রই বন্ধ রাখতে হচ্ছে বিপিডিবিকে।

সরকার এরই মধ্যে এলএনজি আমদানির জন্য সৌদি আরবের জেদ্দাভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইটিএফসি) কাছ থেকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য পেট্রোবাংলা এবারই প্রথম এ ঋণ গ্রহণ করেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে বিদ্যুৎ খাতে প্রাথমিক জ্বালানি আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে নির্ভরতা কমানোর সুযোগ রয়েছে। এজন্য স্থানীয় গ্যাস ও কয়লার উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। সেই সঙ্গে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। আমদানিনির্ভরতা অতিমাত্রায় বেড়ে গেলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে। এ চাপ কমাতে গ্রিডে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ সক্ষমতা তৈরি হয়েছে, তার যৌক্তিক ব্যবহার করতে হবে।’


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন