চট্টগ্রামে পুরনোদের সরিয়ে পাহাড়ে নতুন দখলদারত্ব

সুজিত সাহা, চট্টগ্রাম ব্যুরো

চট্টগ্রামের আকবর শাহ এলাকায় টিনের বেড়া দিয়ে দখল করা হয়েছে পাহাড় ছবি: ফাইল/নিজস্ব আলোকচিত্রী

চট্টগ্রামে পাহাড় দখল করে স্থাপনা নির্মাণ পুরনো বিষয়। বিভিন্ন সময় পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো এর প্রতিবাদ জানিয়ে এলেও দৃশ্যমান কোনো ফল পাওয়া যায়নি। জেলা প্রশাসন ও রেলওয়েসহ সরকারি বেশ কয়েকটি সংস্থার তথ্যমতে,  পাহাড় দখলে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধিরা জড়িত। মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলের বিভিন্ন নেতাকর্মী পাহাড়ে ঘরবাড়ি নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন। তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুরনো দখলদাররা রয়েছেন আত্মগোপনে। এই সুযোগে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও তাদের ছত্রছায়ায় থাকা প্রভাবশালীরা পাহাড়ে দখলদারত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, ২০০৭ চট্টগ্রামে ভয়াবহ পাহাড়ধসের পর গঠন করা হয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা যুক্ত থাকলেও কেবল বর্ষা মৌসুমে ইউটিলিটি সার্ভিস বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্তেই সীমাবদ্ধ কমিটির কার্যক্রম। বর্ষা মৌসুমে বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার কাজ করলেও পাহাড় কাটা ও দখলদারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। চট্টগ্রামের প্রায় সব পাহাড় কাটার পর অবশিষ্ট রয়েছে সামান্য। পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযান পরিচালনা করা হলেও মামলায় গ্রেফতার হন শ্রমিকরা। মালিক কিংবা জড়িত প্রভাবশালীকে নোটিস দিয়ে সামান্য জরিমানা করা হলেও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না পরিবেশ অধিদপ্তর বা জেলা প্রশাসন।

মঙ্গলবার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত হয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ২৯তম সভা। সভায় জানানো হয়, মহানগরীতে ২৬টি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৬ হাজার ৫৫৮টি। ২৬টি পাহাড়ের মধ্যে ১৬টি সরকারি সংস্থার ও ১০টি ব্যক্তিমালিকানাধীন। আগে গত ২০ জুন অনুষ্ঠিত হওয়া কমিটির ২৮তম সভায়ও একই বিষয়ে আলোচনা হয়। দুটি সভার মধ্যবর্তী সময়ে সংস্থাগুলোকে ১৫ থেকে সর্বোচ্চ এক মাসের সময় বেঁধে দেয়া হলেও কোনো সংস্থাই ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ  কিংবা অবৈধ দখলদারদের সরাতে পারেনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত একটি শহরকে পাহাড় কাটার মাধ্যমে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট ছাড়াও জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ পাহাড়ে বসবাস ও পাহাড় কাটা। প্রশাসন জানে কারা এসব পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু অজানা কারণে লোক দেখানো তৎপরতা ছাড়া আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি।’

জেলা প্রশাসন ও রেলওয়েসহ সরকারি কয়েকটি সংস্থার তথ্যমতে, মূলত রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও তাদের ছত্রছায়ায় থাকা প্রভাশালীরা পাহাড়ে ঘরবাড়ি নির্মাণ করে ভাড়া দেয়। কেউ কেউ মাসিক ভাড়া উত্তোলন করলেও অনেকে ভাড়া দেয়ার পাশাপাশি বসবাসকারীদের কাছ থেকে এককালীন অর্থও হাতিয়ে নেন। এ কারণে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উচ্ছেদের উদ্যাগ নেয়া হলেও সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্ষা মৌসুমে ভারি বৃষ্টিপাতের সময় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের উচ্ছেদে উদ্যোগী হলেও পাহাড় দখল ঠেকাতে ব্যবস্থা নেয়নি। ব্যক্তি পর্যায়ে পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে অভিযোগ কিংবা অভিযানের কার্যক্রম শুরু হলেও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের তৎপরতায় সেটি ভেস্তে যায়। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে গেলেও পাহাড় দখল বন্ধে প্রশাসনের উদ্যোগ দেখা যায়নি। তবে সুবিধাভোগী একটি গোষ্ঠী চলে গেলেও পাহাড় থেকে সুবিধা নিচ্ছে অন্য গ্রুপগুলো। রাজনৈতিক চাপ না থাকলেও পাহাড় দখলের বিরুদ্ধে বৈঠকেই সীমাবদ্ধ চট্টগ্রামের প্রশাসন।

সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় প্রশাসনের ব্যস্ততা, দীর্ঘ সময় পুলিশ বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে এক মাসে চট্টগ্রামে পাহাড় কাটার হার বেড়েছে। একাধিকবার কারফিউ পরিস্থিতির সুযোগে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী, শেরশাহ, আকবর শাহ, খুলশীসহ বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় কেটে নতুন বসতি স্থাপন করা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে অভিযান কিংবা পদক্ষেপ না থাকায় একের পর এক দখল হচ্ছে পাহাড়।

এ ব্যাপারে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির আহ্বায়ক ও বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পাহাড় থেকে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ ও পাহাড় কাটার বিষয়ে দীর্ঘ তৎপরতা থাকলেও বর্তমানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য সরকারি বিভিন্ন সংস্থাগুলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা পালন করবে। প্রশাসনিক কোনো চাপ না থাকায় পাহাড় রক্ষা কমিটি ফলপ্রসূ তৎপরতা চালাবে।’

অভিযোগ রয়েছে, পাহাড়ে বসবাসের ক্ষেত্রে উৎসাহিত করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ভবন নির্মাণে অনুমোদন, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ওয়াসার সংযোগ। অর্থাৎ সরকারি সংস্থাগুলো বিভিন্নভাবে অবৈধ বসবাসকারীদের ইউটিলিটি সংযোগ দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে প্রভাবশালীরা সংযোগ নিয়ে পাহাড়ে অবৈধভাবে ঘরবাড়ি নির্মাণ করছে। তাছাড়া পাহাড় শ্রেণীভুক্ত ভূমিকে কেটে সমান করার পর সমতল বা আবাসিক দেখিয়ে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়ায় পাহাড় কাটার হার বাড়ছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা।

চট্টগ্রামে পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নিছার আহমেদ মঞ্জু ও ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. জহুরুল আলম জসিম। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক পাহাড় কেটে আবাসন প্রকল্প, পাহাড়ে অবৈধভাবে বসতি স্থাপনসহ বিভিন্ন অভিযোগ থাকলেও দীর্ঘ সময় প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মামলা হলেও দুই কাউন্সিলরসহ আওয়ামী লীগ ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা পাহাড় কাটা বন্ধ করেননি।

পুলিশ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, আগে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো যেত না। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীরা পালিয়ে গেলেও অন্য দলের নেতাকর্মীরা পাহাড় দখলে যুক্ত হচ্ছেন। পুলিশের তৎপরতা বাড়াতে এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ নেয়া হলে এখনই পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন