আলোকপাত

প্রাথমিক শিক্ষাকে অবহেলা করে উন্নত হয়েছে পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই

ড. শ্যামল চৌধুরী

ছবি : বণিক বার্তা

প্রাথমিক শিক্ষা কোনো দেশের ভিত হিসেবে কাজ করে। উন্নতমানের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতে শিক্ষকরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে বেতনাদি ও সুবিধা পান তা দিয়ে সম্মানজনক জীবন যাপন করা দুষ্কর এবং তাদের পক্ষে উন্নতমানের শিক্ষা দেয়া কঠিনই বৈকি। সম্প্রতি বণিক বার্তায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো নিয়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের বেতন কাঠামো খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বেতন আংশিকভাবে দুটো বিষয়কে নির্ধারণ করে থাকে। প্রথমত, কোনো ব্যক্তি শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করবেন নাকি ব্যাংকে বা অন্য পেশায় যোগদান করবেন নাকি রাজনীতিবিদ হবেন—এটা মূলত নির্ধারণ করে থাকে বেতন। দ্বিতীয়ত, যখন কোনো ব্যক্তি এ পেশায় যুক্ত হলেন তখন তিনি কীভাবে কাজ করবেন বা পড়াবেন সেটা নির্ভর করে তার বেতনের ওপর। কেন এমনটা হয়ে থাকে? 

একজন মানুষ কীভাবে তার ছাত্রদের পড়াবেন বা কতটুকু যত্নসহকারে পড়াবেন বা কতটুকু যত্ন নেবেন এটা নির্ভর করে দুটো প্রেরণার (মোটিভেশন) ওপর। মনোবিজ্ঞানীদের ধারণা অনুসারে, একটি ইনট্রিন্সিক মোটিভেশন (অন্তর্নিহিত প্রেরণা), অন্যটি এক্সট্রিন্সিক মোটিভেশন (বাহ্যিক প্রেরণা)। এ দুটো প্রেরণার ওপরই নির্ভর করে শিক্ষকরা তাদের ছাত্রদের কতটুকু পড়াবেন বা কতটুকু যত্ন নেবেন। এখানে অন্তর্নিহিত প্রেরণার বিষয়টি কী তা আগে পরিষ্কার হওয়া দরকার। ইনট্রিন্সিক মোটিভেশন মূলত একজন ব্যক্তির ভেতর থেকে সহজাতভাবে যে বিষয়টি আসে বা যে বিষয়টি নিজে নিজে করতে পছন্দ করেন। যেমন একজন শিক্ষক যিনি মানুষ হিসেবে অন্য মানুষকে সহায়তা বা ছাত্রদের শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ে সহযোগিতা করতে ভালোবাসেন বা পছন্দ করেন। অর্থাৎ সহজাতভাবেই বা অভ্যন্তরীণভাবে তিনি অন্যদের শেখাতে বা পড়াতে ভালোবাসেন বা আগ্রহী বা উদ্যোগী হন। এসব লোকদের জন্য বেতনটি হয়তো জরুরি নয়। বর্তমান যুগে এ ধরনের মানুষ পাওয়া মুশকিল, যারা টাকা-পয়সার চিন্তা না করে কেবল শিক্ষকতা পেশাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেবেন। এর সঙ্গে বাহ্যিক প্রেরণার বিষয়টিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে যুক্ত বেতন, পুরস্কার ও স্বীকৃতি। আর বিপরীতভাবে বলতে গেলে তা হলো শাস্তি। শিক্ষকরা কতটুকু মনোযোগ দিয়ে পড়াবেন বা ভালো করে পড়াবেন সেই বিষয়টি নির্ভর করে বাহ্যিক প্রেরণার ওপর। এক্ষেত্রে বেশি টাকার জন্য ভালো করে পড়াবেন। আবার পর্যাপ্ত বেতন না পেলে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়ে থাকে, যা পাঠদানে অনীহা তৈরি করে। তাই এ দুই বিষয় খুবই জরুরি। দেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে মানসম্মত করতে শিক্ষকদের জন্য এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে দুটো প্রেরণাকেই উৎসাহিত করা হবে।

দক্ষ জনশক্তি গঠনে প্রাথমিক শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ খাতে বাংলাদেশ প্রচুর বিনিয়োগ করে থাকে। তাই এ বিষয়গুলো নিয়ে নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা উচিত। শিক্ষকদের স্বল্প বেতন শিশুদের গড়ে ওঠা ও উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নীত হওয়াকে অনেকভাবেই প্রভাবিত করবে। দেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান খুব নাজুক। প্রাথমিক শিক্ষায় একজন শিশুর যেগুলো অর্জন করা জরুরি, সেগুলো যদি সে অর্জন না করতে পারে তাহলে মাধ্যমিক পর্যায়ে গিয়ে ভালো করতে পারবে না। দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন বা দক্ষ জনশক্তি গঠনে প্রাথমিক পর্যায়ে যে শিক্ষার প্রয়োজন তা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিশুরা পাচ্ছে না। কাজেই দক্ষ মানবসম্পদ গঠনে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিহার্য। আর দক্ষ মানবসম্পদ আয়ের ক্ষেত্রে বা ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। আমাদের বাজেটে দেখা গেছে, মোট অর্থ বরাদ্দের একটা বড় অংশই যায় অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে। আমার মনে হয়, শিক্ষা খাতে বিদ্যমান বাজেটেই শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো সম্ভব। তবে তার জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। তবে আমি বলছি না যে, স্কুলঘর আর বানানো হবে না। নতুন করে স্কুলঘর করার চেয়ে যেগুলো বিদ্যমান রয়েছে সেগুলোকে রেখেই শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো সম্ভব। 

আমার জানামতে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে অনেক ব্যয় হয়। প্রশিক্ষণের পুরোটাই যে শিক্ষকদের মানোন্নয়নে ব্যবহৃত হয় সেটা বলা সম্ভব না। অবকাঠামো ও প্রশিক্ষণের কিছু টাকাও শিক্ষকদের বেতনের জন্য বরাদ্দ করা যেতে পারে, যা বেতন বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমানে দেশে পদ্মা সেতু ও মেট্রো রেলের মতো বড় বড় অবকাঠামো বাস্তবায়ন হয়েছে। এসব অবকাঠামো দেশের অর্থনীতির গতিশীলতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। অবকাঠামো ভালোভাবে ব্যবহারের জন্য দরকার দক্ষ শ্রমশক্তি। দক্ষ জনশক্তি গঠনে প্রাথমিক শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরির জন্য যদি বাংলাদেশ প্রাথমিক পর্যায়ে বিনিয়োগ না করে তাহলে দক্ষ শ্রমশক্তি কখনই তৈরি হবে না। প্রাথমিক শিক্ষাকে অবহেলা করে উন্নত হয়ে গেছে পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই। তাই দেশের জাতি গঠনে বা দক্ষ মানবসম্পদ গঠনে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি। প্রাথমিক শিক্ষাকে সম্পূরক বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে পারে সরকার। 

প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে কোটার প্রচলন আছে। কিছু কোটা নারী-পুরুষের সংখ্যায় ভারসাম্য রক্ষার্থে করা হয়েছে। এতে শিক্ষকতায় নারীদের সংখ্যা বেড়েছে এবং এটি ভালো একটা দিক। তবে মেধাভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে এটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। যদি বেতন না বাড়িয়ে কেবল অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে কোটা ব্যবস্থা চালু রাখা হয়, এ পেশার প্রতি ভালো মানের শিক্ষার্থীরা আকৃষ্ট হবে না। উচ্চ শিক্ষা অর্জনের পর কেউই স্বল্প বেতনের পেশায় আসতে চায় না। বেতন বাড়ানোর মাধ্যমে দক্ষ ছাত্র-ছাত্রীদের এ পেশায় আকৃষ্ট করা সম্ভব। 

২০৩০ সালের মধ্যে যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) নেয়া হয়েছে তাতে প্রাথমিক শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। প্রাথমিক শিক্ষায় যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে তা অর্জনে শিক্ষক নিয়োগের আগে ও পরে মানোন্নয়ন দরকার। প্রথমত, নতুনভাবে যাদের নিয়োগ দেয়া হবে, সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া সুপরিকল্পিত হতে হবে। একই সঙ্গে অন্যান্য চাকরির তুলনায় সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে। যেমন এখন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই বিসিএসমুখো হচ্ছেন এবং সেদিকে ছুটছেন। এর কারণ হলো বিসিএস পেশার সুযোগ-সুবিধা। শিক্ষকতা পেশা জাতি গঠনে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ পেশায় আয় ও অন্যান্য বৈষম্য কমিয়ে আনা উচিত। বিসিএসের সমপর্যায়ে না হোক, কাছাকাছি পর্যায়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা উন্নীত করা উচিত। তাহলে নতুনদের এ পেশায় আনা যাবে। তবে কেবল নতুনদের নিয়ে ভাবলে চলবে না। পুরনো শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে।

এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় লক্ষ রাখা দরকার। আমাদের প্রাথমিকের শিক্ষকদের বিদ্যালয়ে পাঠদানের বাইরে নানা সরকারি কাজে যুক্ত করা হয়, যা পাঠদানে অত্যন্ত ব্যাঘাত ঘটায়। শিক্ষকদের ওপর থেকে সেসব কাজের চাপ কমানো উচিত এবং প্রয়োজনে পাঠদানের সময় বাড়াতে হবে।

প্রাথমিক শিক্ষায় যথেষ্ট মনোযোগ ও বিনিয়োগ ছাড়া কোনো জাতি দাঁড়াতে পারেনি। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর আমরা উন্নত দেশ হওয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোচ্ছি তা বাস্তব রূপ দিতে হলে মানবসম্পদ উন্নয়নে জোর দিতে হবে। আর মানবসম্পদ উন্নয়নের ভিত তৈরি হয় প্রাথমিক শিক্ষায়। মেধাবীদের প্রাথমিক শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে বেতনাদি ও সুবিধা বৃদ্ধি জরুরি। একই সঙ্গে পাঠ্যক্রম উন্নয়ন ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষাকে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। 

ড. শ্যামল চৌধুরী: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় (অস্ট্রেলিয়া)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন