সময়ের ভাবনা

ঈদুল আজহার আনন্দে ডেঙ্গু যেন বিষাদের কারণ না হয়

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার

ছবি : বণিক বার্তা

মশকীর অত্যাচার আর চোখ রাঙানিতে বাঙালির জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। গত ১ জানুয়ারি থেকে ১২ জুন পর্যন্ত ৩৯ জন মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে ডেঙ্গুর ভয়াল থাবা। আর ৩ হাজার ১৫০ জন মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এ ডেঙ্গুর অত্যাচারে। যেকোনো ধরনের উৎসবের আমেজে আমাদের সবকিছুরই দাম যেমন বাড়ে, বাড়ে ভোগান্তিও। এই যেমন বছরের দুই ঈদে মানুষের প্রয়োজনীয় ভ্রমণে অসম্ভব কষ্ট পোহাতে হয় রাস্তাঘাটে। একইভাবে যাতায়াতের পরিবহনটি পাওয়াও হয়ে ওঠে সোনার হরিণ। বাস, ট্রেন, লঞ্চ, বিমান সব পথেই অসম্ভব ভিড় আর ভোগান্তি। এর ওপর রয়েছে জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতি। ঈদুল ফিতরের আগে প্রয়োজনীয় উপকরণের লাগামহীন মূল্য আর ঈদুল আজহার আগে কোরবানির গরু ও খাসির মূল্য যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমন বৃদ্ধি পায় জনস্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ সংক্রামক রোগের প্রবণতা। ডেঙ্গু একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও ক্রমান্বয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠা মারাত্মক রোগ। একদিকে বর্ষাকাল শুরু হয়েছে, ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজননস্থল বৃদ্ধির সময়ও শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে আমাদের মুসলিমদের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদুল আজহার পুরাদস্তর প্রস্তুতি। এ ধর্মীয় উৎসবের সবচেয়ে বড় দিক হলো পশু কোরবানি করা। আমাদের দেশের খামারিরা সারা বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাদের গরু-ছাগলকে বাজারজাত করেন স্বল্প লাভের আশায়। দেশের প্রতিটি অঞ্চলেই গরুর হাট বসেছে। এ হাটের সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে মশা প্রজননের স্থান। গরুকে পানি পান করানোর ব্যবস্থার সঙ্গে পানির উৎস ও সরবরাহের ব্যবস্থাপনা যদি সঠিক নিয়ম মেনে না হয়, তবে শুধু এডিস মশাই নয়, সবচেয়ে বিরক্তির কিউলেক্স মশার ঘনত্ব অবিশ্বাস্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গরুর বাজারের পরিসর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ব্যস্ততা আর লাভের আশায় অনেক সময় খামারিরা নিজেই খাবার খেতে ভুলে যান, তাদের চারপাশে কোথায় পানি জমে থাকল আর কোথায় ময়লা-আর্বজনা জমে পরিবেশের প্রভূত ক্ষতি সাধন করল তা তাদের মাথায় থাকার কথা নয়। তাই গরুর হাটের ইজারাদার বা দায়িত্বপ্রাপ্তরা অবশ্যই বিষয়গুলো অতি গুরুত্বসহকারে নেবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবেন। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে খামারিরা ঢাকা শহরে এসে যেমন বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় গরুর হাঁটে অংশগ্রহণ করেন আবার হাট শেষে এলাকায় ফিরে যান। এভাবে শহর থেকে একেবারে প্রত্যন্ত এলাকায় সংক্রমিত মশা অথবা মশার ডিম অতি সহজেই ছড়িয়ে পড়ছে। সংক্রমিত মশা একবার যখন কোনো এলাকার ঢুকে পড়বে এবং ওই এলাকার অসংক্রমিত মশাকে সংক্রমণের আওতায় নিয়ে আসবে তখন পরিস্থিতি আরো যে কত বেশি ভয়ংকর হবে তা বলাই বাহল্য। অন্যদিকে শহরের যেসব পরিবার শহর ছেড়ে নাড়ির টানে গ্রামে যাচ্ছে ঈদ করার জন্য তাদের সামান্য আসাবধানতার জন্য নিজের তালাবদ্ধ বাড়িটি হয়ে উঠতে পারে এডিস মশার কারখানা। কারণ এবার ঈদে একটি লম্বা ছুটি রয়েছে যারা ১৯ ও ২০ জুন ছুটি নেবেন তারা তো এক সপ্তাহের বেশি সময় পাবেন, যে সময়টি এডিস মশার ডিম ফুটে লার্ভা, পিউপাল, স্টেজ পার করে পূর্ণাঙ্গ মশায় রূপান্তরিত হওয়া অতি সহজ। তাই বাড়ি তালাবদ্ধ করার আগে সঠিকভাবে নিশ্চিত হবেন সব পানির উৎস বন্ধ আছে কিনা এবং সব পানির পাত্র শুকনা রাখার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কিনা। যদি ছাদে কোনো পানির উৎস থেকে থাকে তাহলে অবশ্যই তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বা প্রয়োজনীয় লোক নিয়োগ করতে হবে। নিমার্ণাধীন বাড়ির কর্মীরা ছুটিতে যাওয়ার আগে অবশ্যই নির্মাণাধীন বাড়িতে পানি জমা হওয়ার সব উৎস নির্মূল করতে হবে অথবা একজন দক্ষ মানুষকে দায়িত্ব যথার্থভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে। যদি পানি নিষ্কাশন সম্ভব না হয় তবে অবশ্যই নিয়মিত অ্যাডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড প্রয়োগের সুবন্দোবস্ত করতে হবে। বাথরুমের কমোডের ঢাকনা বন্ধ করে রেখে যেতে হবে। সব পাত্র উল্টো করে রাখতে হবে। গ্যারেজে গাড়ি ধোয়ার পর তা অবশ্যই শুষ্ক করে তারপর গ্যারেজ ত্যাগ করতে হবে। গ্যারেজে যারা গরু বা ছাগল রাখছেন কোরবানির জন্য তাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে কোনোভাবেই যেন পানি পরিত্যক্ত অবস্থায় না থাকে। এবার আসি কোরবানির পশু জবাই দেয়ার পরবর্তী অবস্থার কথা। কোরবানির মহত্ত্ব তখনই প্রকৃতভাবে ফুটে উঠবে যখন কোরবানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকাণ্ড মানুষ তথা কোনো জীবের জন্যই কষ্ট বা ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে না। তাই কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হাসিল যেমন আল্লাহর তুষ্টি, তেমন সব জীবের প্রতি সুবিচার করাও আল্লাহর আদেশ। তাই এ বর্জ্য থেকে কোনোভাবেই যেন কোনো ধরনের রোগ-জীবাণু ছড়াতে না পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। কোরবানির ক্ষতিকারক বর্জ্য হতে পারে জমির উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির প্রধান উপাদান। তবে তার জন্য চাই সঠিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা। কি গ্রাম, কি শহর, সব স্থানেই বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। এটাকে জীবাণু বা তার বাহকের উৎসে পরিণত করা যাবে না। মশা ও মাছি উভয়েই এ বর্জ্য দ্বারা দূষিত স্থানে প্রজনন ঘটাবে। বিশেষ করে কিউলেক্স মশা পরিবেশের জন্যও হুমকিস্বরূপ; বায়ুদূষণের মূল উপাদান। দূষণের বিরূপ প্রভাব অন্যান্য ভেক্টরের ওপরও ব্যাপক। তাই পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে নিজের পশুত্ব কোরবানি দিয়ে আমরা পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র জাতিতে পরিণত হব। হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর যে ত্যাগ তাকে মহান করেছে তা যুগে যুগে স্থানান্তরিত হচ্ছে আমাদের মধ্যে। আমরা বুঝতে পারছি লোভ, লালসা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা আর অন্যের নিন্দা শুধুই কদর্যপূর্ণ কাজ। এটি কখনই মানব মঙ্গলের জন্য নয়। তাই ত্যাগ আর মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়ার মধ্যেই সফলতা, কামিয়াবি আর অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার এক অনবদ্য সোপান। দূষণ ও দোষণ দুটোই পরিহার করে এ চমৎকার ধরিত্রীকে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের বাস উপযোগী করতে সব চেষ্টা অব্যাহত রাখি। আমরা রোগমুক্ত দুঃখ-দুর্দশাবিহীন এক অনন্য জীবন গড়ে তুলি। 

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান

কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন