নতুন কর্তৃপক্ষ গঠন

চামড়া শিল্পের বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারে

ছবি : বণিক বার্তা

চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য দেশীয় কাঁচামালভিত্তিক একটি রফতানিমুখী শিল্প। জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি, রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়, কর্মসংস্থান ও মূল্য সংযোজনের নিরিখে এটি একটি অপার সম্ভাবনাময় খাত। বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য দ্বিতীয় বৃহৎ রফতানি পণ্য। দীর্ঘদিন ধরেই পরিকল্পনা ও আন্তর্জাতিক গুণগত মানের অভাবে ব্যর্থতার চক্করে ঘুরপাক খাচ্ছে এ শিল্প খাত। এতে পর্যায়ক্রমে চামড়া রফতানির আয় কমে যাচ্ছে। অথচ চামড়া শিল্পের প্রধান এ কাঁচামাল চামড়ার সহজলভ্যতা থাকলেও এর যথাযথ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। 

দেশের চামড়া শিল্প ব্যবস্থাপনায় ‘বাংলাদেশ চামড়া শিল্প ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আইন, ২০২৪’ শীর্ষক আইনের খসড়া প্রণয়ন করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। আশা করা যায়, নতুন আইন এ শিল্পের বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারে। এ শিল্পের ব্যবস্থাপনায় যেসব অসংগতি রয়েছে সেসবের উন্নতি ঘটবে। এছাড়া বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ অর্জনে প্রয়োজনীয় মানদণ্ড পূরণের পাশাপাশি এ শিল্পের গুণগত মান সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে আইনটি। চামড়া শিল্পে বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা ও নীতিসহায়তা দেয়াও সহজ হবে। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে আয়ের খাতগুলোর যথাযথ তত্ত্বাবধান জরুরি। সম্ভাবনাময় খাতগুলোর উন্নয়নে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। 

দেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক। মোট রফতানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে এ খাত থেকে। এর বাইরে যে দু-তিনটি খাত থেকে ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারের বেশি আয় দেশে আসে, তার মধ্যে চামড়া খাত একটি। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি থেকে ৯৬ কোটি ১৫ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এ অংক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ১৭ শতাংশ কম। ১৩৫ কোটি (১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন) ডলার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ২১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে এ খাত থেকে রফতানি আয় হয়েছিল ১১২ কোটি (১ দশমিক ১২ বিলিয়ন) ডলার। পুরো অর্থবছরে (জুলাই-জুন) এসেছিল ১২২ কোটি ৩৬ লাখ (১ দশমিক ২২ বিলিয়ন) ডলার, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম। লক্ষ্যের চেয়ে কম ছিল ১৫ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।

দৃশ্যত সার্বিক রফতানিতে পিছিয়ে পড়ছে এ খাত। বিভিন্ন সময় সংশ্লিষ্টরা কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার কথা জানালেও সে বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হয়নি। প্রতিনিয়তই ট্যানারির বর্জ্যে নানাভাবে পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদীসহ পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। যা ঈদুল আজহার সময় বেড়ে যায় কয়েক গুণ। সাভারের চামড়া শিল্পের বিদ্যমান সংকট সমাধান করার জন্য স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কখনো কখনো আলাপ-আলোচনা হলেও বাস্তবে তেমন কোনো কাজ লক্ষ করা যায়নি। এ শিল্পের সংকট কাটাতে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। 

রফতানি-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলোর কাছে ভালো দামে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করতে হলে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ থাকতে হয়। বৈশ্বিক বাজারের কথা মাথায় রেখে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্প নগরী স্থানান্তরের জন্য ২০০৩ সালে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। সে অনুযায়ী ২০০ একর জমি নিয়ে সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরায় গড়ে ওঠে চামড়া শিল্প নগরী। বর্তমানে সাভারে ১৪১টি ট্যানারি রয়েছে। যেখানে ৫৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) তৈরি করা হয়। কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় এলডব্লিউজি সনদ অর্জনও সম্ভব হচ্ছে না। মূলত এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় দেশের চামড়া শিল্পের অগ্রগতি হচ্ছে না। এ খাতের উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এলডব্লিউজি সনদ অর্জনে যেসব মানদণ্ড রয়েছে তা পূরণে জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে সরকারকে। 

২০০৫ সালে নাইকি, অ্যাডিডাস ও টিম্বারল্যান্ডের মতো কয়েকটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ও জুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মিলে এলডব্লিউজি গঠন করে। পরিবেশ সুরক্ষায় জোর দিয়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদন নিশ্চিত করাই সংস্থাটির লক্ষ্য। বর্তমানে বিশ্বে এক হাজারের বেশি ব্র্যান্ড ও সরবরাহ খাতের প্রতিষ্ঠান এলডব্লিউজির সদস্য। এলডব্লিউজির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, সংস্থাটি কারখানা নিরীক্ষার জন্য একটি সাধারণ মানকাঠামো তৈরি করেছে। এক্ষেত্রে তারা পরিবেশ ব্যবস্থাপনা, ক্ষতিকর উপাদান, বর্জ্য পরিশোধন, কাঁচামালের উৎস ইত্যাদি বিষয় খতিয়ে দেখে।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) বলছে, এবারের ঈদে সারা দেশে ৮০ লাখ চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে ৪ লাখ ৭৫ হাজার চামড়া সংগ্রহ হয়েছে। তবে অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে চামড়া প্রক্রিয়া করায় তিনদিনে কয়েক লাখ চামড়া নষ্ট হয়েছে। তাই চামড়া সংরক্ষণে গুণগত মান বজায় রাখতেও শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের আওতায় এনে দক্ষতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। 

চামড়া খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্প নগরের দূষণ বন্ধ না হওয়ায় ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি বাংলাদেশী চামড়া কিনছে না। ফলে বাংলাদেশী চামড়া বড় ক্রেতা বর্তমানে চীন। তারা কম দাম দেয়। সেটির প্রভাব কাঁচা চামড়ার দামেও পড়ছে। বাংলাদেশ থেকে চীনে যে শতকরা ৮০ ভাগ লেদার যাচ্ছে, তা মূলত ক্রাস্ট লেদার। সেগুলোকে বিভিন্নভাবে প্রক্রিয়াজাত করে ফিনিশ লেদারে পরিণত করে বিভিন্ন দেশে রফতানি করছে চীন। অথচ বাংলাদেশ নিজেই যদি আধুনিক ট্যানারি শিল্প গড়ে তোলার মাধ্যমে ফিনিশ লেদার রফতানি করতে পারত, তাহলে আরো বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারত। 

যদিও সাত বছর আগে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্পকে সাভারে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তবে অবস্থার বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। কমপ্লায়েন্সের অভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে দেশীয় চামড়ার মূল্য কমেছে। আবার ট্যানারির শ্রমিকরাও ন্যূনতম মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শ্রমিকদের আবাসন ও চিকিৎসাসহ তাদের জীবনযাপনের মৌলিক চাহিদা পূরণে নেই যথাযথ ব্যবস্থা। ট্যানারিগুলোয় স্থায়ী ও অস্থায়ী দুই ধরনের শ্রমিক কাজ করেন। তাদের জীবন অনেকটা দুর্বিষহ। মজুরি বোর্ডের নির্ধারিত গ্রেড নয়, অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের বেতন নির্ধারিত হলেও ওভারটাইম ও ছুটি সুবিধা সীমিত। নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা। সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থাও ঠিকমতো করতে পারেন না তারা। তাই শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। 

এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে এ বছরও চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়। কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে বরাবরের মতো এবারো চামড়া সিন্ডিকেট সক্রিয় এমন খবরও এসেছে পত্রপত্রিকায়। বিক্রেতারা পানির দরেই কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। আর এ পরিস্থিতি যে চামড়া খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে, তা বলাই বাহুল্য। তাই এ খাতের উন্নয়নে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ জরুরি। 

চামড়া, জুতা ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। অথচ পরিবেশ দূষণ, অর্থ সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে চামড়া শিল্প ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে তা মেনে নেয়া যায় না। এ শিল্পকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। রফতানি প্রবৃদ্ধির জন্য উন্নত বিশ্বের চাহিদা অনুযায়ী শিল্পটিকে পরিবেশবান্ধব করাটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে সংশ্লিষ্টদেরই। বিলম্বে হলেও সরকার চামড়া শিল্প ব্যবস্থাপনায় আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠন করছে তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া অতীতের অনেক ভালো উদ্যোগের মতো এটাও তেমন ভালো ফল দেবে না। চামড়া ও চামড়াজাত শিল্পে রফতানি আয় স্রেফ ১ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে থাকছে, এমনটা কাম্য নয়। প্রয়োজনীয় প্রণোদনা ও সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে এটা তৈরি পোশাক খাতের মতো বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেকটি প্রধান খাত হতে পারে। এক্ষেত্রে নতুন কর্তৃপক্ষ তার দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করবে—এমনটাই প্রত্যাশা সবার।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন