শিক্ষা ভাবনা

বেকারত্ব নিরসনে শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রায়োগিক করতে হবে

আব্দুল বায়েস

ছবি : বণিক বার্তা

কয়েক বছর আগে কভিড নিয়ে যখন আমি ঢাকার একটা হাসপাতালে ভর্তি হই, তখন সাক্ষাৎ ঘটেছিল ওই হাসপাতালে কর্মরত এক সুদর্শন যুবকের সঙ্গে। তার প্রধান কাজ ছিল, হয়তো এখনো আছে, রোগীদের সেবা প্রদান যথা গা মুছে দেয়া, টয়লেটে আনা-নেয়া ইত্যাদি। বলা চলে, একেবারেই মামুলি কাজ যা বাংলাদেশের মান-মর্যাদার মাপকাঠিতে অতি নিচু স্তরের একটা কাজ বলে বিবেচিত। আমি ভাবলাম, কী সুন্দর ছেলেটা, হয়তো গরিব বলে লেখাপড়ায় খুব বেশিদূর এগোতে পারেনি বলে খড়কুটো ধরে বাঁচতে চাইছে।

সাধারণত রোগীর সঙ্গে সেবকের সম্পর্ক বেশ মধুর থাকে—একসময় একে অন্যের আপনও বনে যায়। আমরা দুজন এর ব্যতিক্রম ছিলাম না। একদিন জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, সে মিরপুরের একটা কলেজ থেকে বিবিএ ডিগ্রি অর্জন করেছে। আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মনে পড়ল ছাত্রজীবনে শোনা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটা বিখ্যাত গানের প্যারোডির প্রথম লাইন: আমায় প্রশ্ন করে আমার প্রেমিকারা, আর কতকাল রবে তুমি চাকরি ছাড়া...। আলাপচারিতায় জানা গেল আরো যে আলোচিত ছেলেটার একজন প্রেমিকা আছে, সে ভালো একটা চাকরির জন্য চেষ্টায় কোনো খামতি রাখছে না। তবে অনুমান করি, নাই মামার চেয়ে কানা মামা অনেক ভালো এবং প্রেমিকাকে খুশি করার জন্যই কেবল আপাতত তার এই পেশা বেছে নেয়া, বিদেশে যাওয়ার চিন্তাও তার মাথায় ছিল। 

দুই

বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ নিয়াজ আসাদউল্লাহ সম্প্রতি একটা সেমিনার দিলেন নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগে (ব্রাউন বেগ সেমিনার)। বিভাগীয় সভাপতি আসাদ করিম খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারের বিষয় ছিল, ‘‌প্রতিবাদ, নারীর এজেন্সি এবং কল্যাণ: মিসরীয় বিপ্লব ফিরে দেখা’। জটিল ইকোনমেট্রিক সূত্র ব্যবহার করে তিনি জানালেন এবং তা যদি সঠিক বুঝে থাকি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নির্দেশকের উন্নতি সত্ত্বেও ‘‌আরব বসন্তে’ অংশগ্রহণকারী নারীদের শ্রমশক্তিতে অবদান অপেক্ষাকৃত কম। অর্থাৎ তাদের কর্মসংস্থান বাড়েনি। তাহলে শিক্ষার সুফল কোথায় গেল? সোজা প্রশ্ন কিন্তু উত্তর বেশ জটিল তার কারণ সম্ভবত এই যে কর্মসংস্থান বা শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ শুধু শিক্ষা ও স্বাস্থ্য স্তরের ওপর নির্ভর করে না, বহুদা উপাদানের উপস্থিতি ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে। সেমিনার থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমার করোটিতে জায়গা নিল বাংলাদেশের কর্মসংস্থান পরিস্থিতি তথা শ্রমের বাজার।  

তিন 

বাসায় ফিরে পত্রিকায় খবরের শিরোনাম দেখে চোখ আমার কপালে ওঠার দশা: রেলপথের পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে চাকরি পাওয়াদের সবাই স্নাতকোত্তর”(বণিক বার্তা, মে ৩০, ২০২৪)। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে কোনো কাজই ছোট নয়, এমন আপ্তবাক্য পাশ কাটিয়ে পত্রিকাটি বলতে চাইছে যেখানে কর্তৃপক্ষ চাইছে, এসএসসি বা সমমান (আগে ছিল এইট পাস), সেখানে এমন চাকরি পাওয়া রোগ না উপশমের উপসর্গ তা বোঝা দায়। গল্পের শেষ এখানেই নয়, পত্রিকাটি বলছে, অনেকে তার মাস্টার্স ডিগ্রি শিকেয় তুলে পেটের দায়ে দৈহিক পরিশ্রমের কাজ বেছে নিচ্ছেন। বস্তুত এ প্রবণতা সবখানেই—রেলওয়ের ওয়েম্যান উদাহরণ মাত্র।

প্রসঙ্গত বলে নেয়া ভালো যে চাকরির বাজার—অর্থাৎ অর্থনীতি যাকে বলে শ্রমবাজার—পণ্যের বাজারের মতোই আচরণ করে এবং তাই পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমও এক ধরনের পণ্য হিসেবে পরিগণিত। চাহিদা ও সরবরাহ তার প্রধান নিয়ামক। বাজার অর্থনীতির দর্শন হচ্ছে বেতন বা মজুরি নির্ধারিত হবে এ দুইয়ের মহামিলনে—কোনো মহব্বতে নয়। ঘরদোর মোছা কিংবা রান্নাবান্না করাও একটা কাজ—তেমনি কৃষি শ্রম—তবে তার মজুরি সম্ভবত সবচেয়ে কম থাকে এবং এ কাজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের প্রয়োজন পড়ে না। হ্যাঁ, হয়তো আছে পাঁচতারকা হোটেলে, যেখানে প্রশিক্ষণের জন্য একই কাজে প্রিমিয়াম হিসেবে পারিশ্রমিক অপেক্ষাকৃত বেশি। অন্যদিকে বাসাবাড়িতে যারা ঘরদোর মোছে, রান্নাবান্না করে শিক্ষা বা প্রশিক্ষণে তাদের বিনিয়োগ বলতে কিছু নেই। অথচ পাঁচ তারকা হোটেল বা বিলাসবহুল বাড়িতে একই কাজে বিনিয়োগ লাগে। আমরা তাই দেখছি, লেখাপড়া আর আয়-ব্যয়ের সম্পর্কটা পজিটিভ এবং তাই বোধ হয় শিশু বয়সে শেখানো প্রণোদনামূলক উক্তি স্মরণে আসে—‘লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে’। বাবা-মা সন্তানের শিক্ষায় বিনিয়োগ করে এ আশায় যে বিনিয়োগের রিটার্ন সে ঘরে তুলবে—সে ঘোড়ায় চড়বে গাড়িতে ঘুরবে। সমাজও তাই মনে করে। অবশ্য এ রকম ভাবনা কতটুকু সংগত কিংবা আদৌ এমন ভাবনা শিশুর মনে সেঁটে দেয়া সঠিক কিনা তা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আছে। তবে আজকের আলোচনার আলোকে আপাতত শিক্ষার ইন্ট্রিনসিক বা অন্তর্নিহিত মূল্য বিবেচনার বাইরে রাখা হলো।

চার 

রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওয়েম্যানরা লাইন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, লাইনের অ্যালাইনমেন্ট খারাপ থাকলে সেটাকে ঠিক করা, কোথাও কাদা-মাটি জমে গেলে সেটাকে পরিষ্কার করার কাজগুলো করে থাকেন। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত তাদের কাজ করতে হয়। কাজগুলো করতে হয় হেঁটে। সঙ্গে রাখতে হয় গাঁইতি, শাবল, কোদালের মতো উপকরণ।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা বিভাগের এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌ওয়েম্যান পদে আগে শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল এইট পাস। এখন এটা এসএসসি করা আছে। যোগ্যতাসম্পন্ন যে কেউ আবেদন করতে পারে। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ধাপ পেরিয়ে চূড়ান্ত নিয়োগ পান প্রার্থীরা। ওয়েম্যানের কাজটাই হলো পরিশ্রমের। এবার যারা নিয়োগ পেয়েছেন সবাই মাস্টার্স করা। উচ্চ শিক্ষিত অনেক তরুণ এ পদে মানিয়ে নিতে পারছেন না। অনেকে চাকরিও ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।’ তিনি বলেন, ‘এটা মূলত লেবার (শ্রমিক) শ্রেণীর পদ। মাস্টার্স পাস ওয়েম্যান তো আমাদের দরকার নেই। আমাদের দরকার কাজের লোক।’

পাঁচ

বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতার প্রতিফলন এ ঘটনা। মনে পড়ে, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত এক সেমিনারে শুনেছিলাম যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলো থেকে অনার্স-মাস্টার্স পাস করা ছাত্রদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ তিন বছরের মধ্যে কোনো চাকরি পায়নি অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বেকারত্বের হার ৩০ শতাংশ। শ্রম শক্তি জরিপ ২০২২ (এলএফএস ২০২২) জানায়, ২০২২ সালে উচ্চ শিক্ষাপ্রাপ্তদের বেকারত্বের হার ১২ শতাংশ এবং ২০১৬-১৭ সালের চেয়ে বেশি। গত পাঁচ বছরে বেকার গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা ২০১৭ অর্থবছরের চার লাখ থেকে দ্বিগুণ দাঁড়িয়েছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রিজওয়ানুল ইসলাম মনে করেন, শিক্ষিতজনের মধ্যে সবখানেই হারটা বেশি এবং বাংলাদেশ ব্যাতিক্রম নয় কিন্তু অর্থবছর ২০১৭ ও ২০২২ ভিন্ন গল্প বলছে। যেমন ২০১৭ সালে সবচেয়ে বেশি বেকার ছিল উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা সমমানের শিক্ষালাভকারী কিন্তু ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি বেকার ছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ছাত্র। এখানে শ্রমবাজারের নিরিখে সংগত যে প্রশ্নটি উঠছে তা হলো শিক্ষা ব্যবস্থা এমন গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছে, যাদের যোগ্যতা চাকরিপ্রাপ্তিতে কোনোভাবে কাজে আসছে না। বাংলাদেশের কি উচিত হবে উপকারিতা ও কার্যকারিতায় মনোযোগ না দিয়ে এমন শিক্ষায় বিনিয়োগ অব্যাহত রাখা? আবার এমনও আছে যে কিছু গ্র্যাজুয়েটের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ বলে তারা চাকরি নিচ্ছে না।

‌অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ‌দেশে প্রচুরসংখ্যক তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছেন। কিন্তু তাদের জন্য মানসম্মত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। আবার অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, চাহিদা থাকলেও দক্ষতার অভাবে শিক্ষিত তরুণদের নিয়োগ দেয়া যাচ্ছে না। উচ্চ শিক্ষিত হয়েও তুলনামূলক কম শিক্ষাগত যোগ্যতার চাকরিতে যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই। রেলের ওয়েম্যান নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এসব সমস্যারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন মন্তব্যটি যথাযথ বলে মনে করি, ‘শুধু রেলে নয়, যেকোনো চাকরিতেই এখন দেখা যাচ্ছে, যে শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়, তার চেয়ে বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতাধারী প্রার্থীরা আবেদন করে। দেশে চাকরির ভয়াবহ অভাব। আমাদের গড় বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ২ শতাংশ হলে কী হবে? যুব বেকারত্বের হার তো ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশে চাকরির যে অভাব রয়েছে, রেলের ওয়েম্যান পদে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ পাওয়ার বিষয়টি তারই প্রতিফলন।’

ছয়

এমন ‘দুরবস্থার’ কার্যকারণ নিয়ে বিস্তারিত আলাপের জায়গা এটা নয়। তবে আপাতত এতটুকুই বলা চলে যে আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার খোলনলচে বদল করে আরো প্রায়োগিক ও গুণগত মানে সমৃদ্ধ করা উচিত। পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে এবং সরকারকে তার সামষ্টিক, রাজস্ব ও মুদ্রানীতি দিয়ে শ্রমঘন কর্মকাণ্ড উৎসাহিত করতে হবে। 

অভিজাত পরিবারের এমএ পাস ছেলে বিদেশে গিয়ে ক্যাব চালায় বা ওয়েটার হয়, দেশে হলে দোষ কী? কেন সবাইকে এমএ পাস করতে হবে?  

আব্দুল বায়েস: সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন