ঈদুল আজহা

উৎসব পালনের যাত্রা হোক স্বাচ্ছন্দ্যময়

ছবি : বণিক বার্তা

ঈদুল আজহার ছুটি শুরু হয়েছে। সড়ক, নৌ ও রেলপথে বেড়েছে ঘরমুখী মানুষের ভিড়। একই সঙ্গে বেড়েছে যাত্রাপথে ভোগান্তি। অবশ্য এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে প্রতি বছরই। উৎসব পালনে ঘরে ফেরার যাত্রায় ভোগান্তি আমাদের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। বণিক বার্তার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে টোল প্লাজায় দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া দূরপাল্লার বাসগুলোর বিরুদ্ধেও উঠেছে আকস্মিক ভাড়া বাড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ। কমলাপুর রেলস্টেশনে টিকিট কালোবাজারির অভিযোগে কয়েকজনকে আটকও করা হয়। 

টিকিট পাওয়া নিয়ে ভোগান্তি, টিকিটের বাড়তি দাম, চাহিদার তুলনায় পরিবহন সংকট ও পথের যানজটের সঙ্গে যুক্ত হয় সড়ক দুর্ঘটনা। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের দেয়া তথ্যমতে, চলতি বছর ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে ৪ এপ্রিল থেকে ১৮ এপ্রিলের মধ্যে ১৫ দিনে দেশে ৩৫৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৬৭ জন নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে দেড় হাজারের বেশি। গত বছর ঈদুল আজহায় যাতায়াতে দেশের সড়ক মহাসড়কে ২৭৭টি দুর্ঘটনায় ২৯৯ জন নিহত ও ৫৪৪ জন আহত হয়েছে। সড়ক, রেল ও নৌপথে সম্মিলিতভাবে ৩১২টি দুর্ঘটনায় ৩৪০ নিহত ও ৫৬৯ জন আহত হয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি এ চিত্র তুলে ধরে। এসব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঈদের সময় দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে।

নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় ঈদযাত্রা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। আনন্দ উৎসব পথের হয়রানি-ভোগান্তিতে ম্লান হবে কিংবা সড়ক দুর্ঘটনায় বেদনায় পর্যবসিত হবে—এমনটি মোটেও কাম্য নয়। আমরা বাজার সিন্ডিকেটের কথা বলি, সরকার বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নামিয়েছিল (যদিও তেমন সফল হয়নি) কিন্তু পরিবহন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা জোরদার করা হবে কবে! যাত্রী হয়রানির অবসান করতে সরকারের আরো তৎপরতা বাড়ানো উচিত। যেখানে স্মার্ট, উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখা হচ্ছে, সড়ক অনিরাপদ রেখে কি তা আদৌ সম্ভব! এ কথা সর্বজনবিদিত যে উন্নতির জন্য বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ। আর বিনিয়োগ আকর্ষণের অন্যতম হাতিয়ার উন্নত ও নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা। ঈদযাত্রা স্বাচ্ছন্দ্যময় করার মাধ্যমে আমাদের যাতায়াত ব্যবস্থার পরিবর্তনের শুরু হতে পারে।

মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব ঈদুল আজহা। এর মূল চেতনা আনন্দোৎসবে সবার অংশগ্রহণ। আর তাই হাদিসে বিধান রয়েছে উৎসর্গকৃত পশুর মাংসকে তিন ভাগ করার। যার এক ভাগ পরিবারের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও আরেক ভাগ দরিদ্র মানুষের জন্য। সমাজে ধনী-গরিব ও পরিবার-প্রতিবেশীদের মাঝে আনন্দ ভাগাভাগি করে সামাজিক সংহতিকে সুদৃঢ় করাই কোরবানির দীক্ষা। আর তাই ঈদ উপলক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সবাই আনন্দ ভাগাভাগি করতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে যায় শেকড়ের কাছে।

তবে গত বছরের মতো এ বছরও এমন এক সময়ে সবাই ঈদ উদযাপন করতে যাচ্ছে, যখন স্মরণকালের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য দিনাতিপাত কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে ঈদ যেন সবার অংশগ্রহণে উৎসবমুখর হয়, সেদিকে নজর দেয়া জরুরি। বস্তুত দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে প্রাণিজ প্রোটিনের উৎস মাংস কেনা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কঠিন হয়ে গেছে। এ সময়ে সমাজে প্রান্তিক আয়ের মানুষের জন্য একটু ভালো খাবারের উপলক্ষ হয়ে উঠবে এ ঈদ। তাই শুধু সামর্থ্যবানদের মধ্যে ঈদের আনন্দ যেন সীমাবদ্ধ না থাকে, সেটি স্মরণে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় যে বিধান রয়েছে, সেটি অনুশীলন প্রয়োজন। কোরবানি যেন শুধু ধনীদের ভোজনোৎসব না হয়, কারণ নির্ধনীদেরও স্রষ্টাপ্রদত্ত অধিকার আছে এ আনন্দোৎসবে ভাগীদার হওয়ার।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ বছরও জানিয়েছে, চাহিদার তুলনায় বাজারে পশুর সরবরাহ বেশি থাকবে। মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, এ বছর কোরবানির বাজারে চাহিদার তুলনায় প্রায় ২৩ লাখ পশু বেশি সরবরাহ হবে। যদিও অভিযোগ আছে, বাজারে কোরবানির পশুর দাম চড়া বলে না কিনেই ফিরে যাচ্ছেন ক্রেতারা। এ বিষয়ে বিক্রেতাদের দাবি, পশুখাদ্যের বাড়তি দাম পশুর দাম নির্ধারণে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। এক্ষেত্রে ভবিষ্যতে কোরবানির পশুর দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনা আবশ্যক। কেননা পশুর দাম বাড়লে বিক্রি কমে যাবে এবং এমনটি হলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে পশু পালনকারী ও খামারিরা নিরুৎসাহিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

কোরবানির ঈদে প্রশাসনকে আরেকটা বিষয় নিয়ে সজাগ থাকতে হবে, তা হলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এটি সময়মতো করতে পারলে নগরীর পরিবেশ স্বাস্থ্যকর থাকবে। এজন্য সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে ডেঙ্গু যেভাবে বিস্তার লাভ করেছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বর্জ্য নির্দিষ্ট সময়েই পরিষ্কার করা দরকার। 

কোরবানির ঈদে একটি বড় ইস্যু হলো কাঁচা চামড়ার বেচাকেনা। এ উৎসবে জবাই করা পশুর চামড়ার ওপর আমাদের ট্যানারি শিল্পগুলো অনেকখানিই নির্ভরশীল। একটা বিষয় লক্ষ রাখতে হবে, এ চামড়ার মূল্যের প্রকৃত ভাগীদার অসহায় গরিব মানুষ। তাদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে চামড়ার ন্যায্যমূল্য যেন নির্ধারিত হয় সেটি লক্ষ রাখতে হবে।

দেশে বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকটগুলো প্রকট, বিশেষ করে আয়বৈষম্য। এমন সময়ে ঈদ উদযাপন যেন বৈষম্যের মাত্রায় নতুন সংযোজন না হয়, ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর ঈদুল আজহা যেন সবার অংশগ্রহণে উৎসবমুখর হয় সেটিই আমাদের প্রত্যাশা। যাপিত জীবনে ঈদ বয়ে আনুক সীমাহীন আনন্দ ও অপার্থিব আনন্দের ছোঁয়া। সবাইকে জানাই ঈদ মোবারক।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন