১৮ জেলার ২৫ শতাংশের বেশি এখনো সাক্ষরজ্ঞানহীন

বিপুলসংখ্যক মানুষকে নিরক্ষর রেখে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়

ছবি : বণিক বার্তা

স্বাধীনতার পর থেকে দেশে সাক্ষরতার হার বেড়েছে। তবে শতভাগ সাক্ষরতা নিশ্চিতের দৌড়ে দেশ এখনো পিছিয়ে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিসংখ্যানমতে, দেশে সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৮। যদিও সাক্ষরতার প্রকৃত অর্থ বিচার করলে এ সংখ্যাকে অত্যুক্তি বলে মনে হওয়ার কথা। অর্থাৎ পড়তে, বুঝতে, লিখতে ও গণনা করতে পারে এমন মানুষের সংখ্যা আরো কম। বিবিএসের গত বছরের প্রায়োগিক সাক্ষরতা জরিপ অনুযায়ী, সাত বছর বা এর চেয়ে বেশি বয়সী এমন মানুষের হার ৬২ দশমিক ৯২। সম্প্রতি তাদের আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ ২০২৩-এ উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের ১৮টি জেলায় এখনো ২৫ শতাংশের বেশি মানুষ লিখতে বা পড়তে পারে না।

তথ্য-উপাত্ত এবং বণিক বার্তার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এ ২৫ শতাংশের সিংহভাগের নিরক্ষতার পেছনে দায়ী দারিদ্র্য। পাশাপাশি রয়েছে অবকাঠামো ও জনবল ঘাটতি, মাঠপর্যায়ের দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতা। এ অবস্থায় সাক্ষরতার হার বাড়াতে শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। 

দেশে নিরক্ষরতার হারের দিক থেকে শীর্ষে পার্বত্য জেলা বান্দরবান। আবার দারিদ্র্যের হারের দিক থেকেও শীর্ষে থাকা জেলাগুলোর অন্যতম বান্দরবান। বান্দরবানের পর নিরক্ষরতার হারে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে ময়মনসিংহ বিভাগের দারিদ্র্যপ্রবণ জেলা জামালপুর, শেরপুর ও নেত্রকোনা এবং উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্যপ্রবণ জেলা কুড়িগ্রাম। দারিদ্র্যের কারণে দেখা যায়, অভিভাবকরা সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে কর্মে নিয়োজন করেন। এতে একদিকে অসচ্ছল পরিবারগুলোকে শিক্ষায় ব্যয় করতে হয় না, অন্যদিকে উপার্জন আসে। 

দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকাগুলোয় সাক্ষরতার হার বাড়াতে সরকারি উপবৃত্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষার্থীদের যে পরিমাণ উপবৃত্তি দেয়া হয়, দেশে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান মূল্যস্ফীতি ও শিক্ষার্থীদের পরিবারগুলোর আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় তা যৎসামান্য। উপবৃত্তির অর্থের পরিমাণ বাড়ানো উচিত। সম্প্রতি গণসাক্ষরতা অভিযানের উদ্যোগে আয়োজিত এক সম্মেলনেও এ বিষয়ে সুপারিশ করা হয়। দারিদ্র্যের কারণে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ফেরাতেও উপবৃত্তির টাকা বাড়ানো সহায়ক হতে পারে। এ পদক্ষেপ শিক্ষার্থীদের আর্থসামাজিক অবস্থারও উত্তরণ ঘটাতে ভূমিকা রাখবে। উপবৃত্তির টাকা বাড়ানোর পাশাপাশি ‘মিড ডে মিল’ ব্যবস্থা পুরোদমে চালু হলে সেটি ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরিয়ে আনতে পারে। এছাড়া যেসব ‍শিশু কাজে নিয়োজিত তাদের শিক্ষার আওতায় আনতে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। 

গণসাক্ষরতা অভিযানের তথ্যানুসারে, প্রাথমিকে যত শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, তাদের মধ্যে প্রায় ১৪ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই ঝরে পড়ে। মাধ্যমিকে গিয়ে এ হার বেড়ে হয় ৩৬ শতাংশ। বিবিএসের হিসাবে দেশে ৫ থেকে ২৪ বছর বয়সের মোট জনসংখ্যা ৬ কোটি ৩৭ লাখ, যাদের ৫৯ দশমিক ২৮ শতাংশ শিক্ষায় আছে। এদিকে ২০৩০ সালের মধ্যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে হলে দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করা বাধ্যতামূলক। এছাড়া ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের যে লক্ষ্য বর্তমান সরকারের রয়েছে, বিপুলসংখ্যক মানুষকে নিরক্ষর রেখে সেটিও কি সম্ভব! সম্ভব নয়। কেননা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রথম স্তম্ভ হচ্ছে স্মার্ট নাগরিক যাদের জ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে নিজেদের এবং সমাজের সবার জীবন ও জীবিকার মান বদলে দেবার কথা। সরকারকে এ বিষয়ে বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। 

নিরক্ষর মানুষের এই পরিসংখ্যান স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের উদ্রেক ঘটায় সাক্ষরতা বাড়াতে গৃহীত প্রকল্পগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে। দেশে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধির জন্য যেসব প্রকল্প নেয়া হয়েছে সেগুলোর মেয়াদ শেষে তেমন কার্যকর ফলাফল পাওয়া যায়নি। আবার দেখা গেছে প্রকল্পগুলোর ধারাবাহিকতা নেই, উল্টো রয়েছে সমন্বয়হীনতা। সাক্ষরতার হার বৃদ্ধির জন্য স্থায়ী ও বৃহৎ কর্মসূচি দরকার। বর্তমানে প্রাইমারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের অধীনে দেশের ৬২টি জেলায় আউট অব স্কুল চিলড্রেন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ কার্যক্রমের অধীনে স্কুলের বাইরে থাকা ৮-১৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরিয়ে আনতে শতাধিক এনজিও কাজ করছে। তবে এরই মধ্যে এ প্রকল্প পুরোপুরি বাস্তবায়ন হওয়া নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি সংশয় প্রকাশ করেছে। প্রকল্পগুলো খাপছাড়াভাবে গ্রহণ না করে সমন্বিতভাবে নেয়া উচিত। কোথায় জনবল ও অবকাঠামোর ঘাটতি আছে, কোথায় দরিদ্রতা মূল কারণ ইত্যাদি বিবেচনায় এলাকাভিত্তিক প্রকল্প চালু করা যেতে পারে। এজন্য শিক্ষায় জিডিপির বিপরীতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা যেমন রয়েছে, তেমনি অর্থের সঠিক ব্যয় নিশ্চিত করা আবশ্যক। সবচেয়ে জরুরি হলো শিক্ষার মান নিশ্চিত করা। নয়তো প্রকৃত সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা বাড়বে না। 

সরকারি সংজ্ঞা অনুযায়ী, সাক্ষরতা বলতে এখন শুধু অক্ষরজ্ঞান বা স্বাক্ষর করতে পারা বোঝানো হয় না। সাক্ষরতা বলতে বাংলা পড়তে পারা, মৌখিকভাবে ও লিখিতভাবে বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যা করতে পারা, যোগাযোগ স্থাপন করতে পারা এবং গণনা করতে পারা বোঝায়। তবে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) এক গবেষণা বলছে, অনেক শিক্ষার্থী স্কুলগামী হলেও তারা সঠিকভাবে পড়তে ও গণনা করতে শিখছে না। পাঠ্যক্রম অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থীর প্রাক-প্রাথমিকেই বাংলা বর্ণমালা ও গণিতের ১ থেকে ২০ পর্যন্ত শিখে ফেলার কথা। প্রতিবেদন অনুযায়ী, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া অনেক শিক্ষার্থীরই বাংলা বর্ণ ও গণিতের সংখ্যা চিনতে সমস্যা হয়। অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ তৈরিতে শিক্ষার মানোন্নয়নের বিকল্প নেই। সব শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি ও শিক্ষার মান বাড়ানোর পাশাপাশি নিরক্ষর বয়স্কদেরও সাক্ষরতা জ্ঞান প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। 

এরই মধ্যে সরকার নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোকে ঢেলে সাজানো এবং পিইডিপি-৫-এ আরো বৃহৎ কর্মসূচির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। প্রায়োগিক সাক্ষরতার হার বাড়াতে এরই মধ্যে কক্সবাজারে একটি পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চলছে, যেটি সফল হলে দেশব্যাপী এ ধরনের কার্যক্রম শুরু হবে। এছাড়া দেশের প্রত্যেক উপজেলায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার অধীনে লার্নিং সেন্টার নির্মাণ করা হচ্ছে। অর্থাৎ বলা যায়, বরাবরের মতো শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজন দক্ষ ও নৈতিকতা সম্পন্ন ব্যবস্থাপক। প্রকল্প বা কর্মসূচি পরিচালকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। পরিকল্পনার কার্যকর প্রয়োগ ছাড়া কখনই সত্যিকার অর্থে শতভাগ সাক্ষরতার লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভবপর নয়। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন