ইউনিসেফ ও এইচইআই: বছরে ১৯ হাজার শিশুমৃত্যুর কারণ বায়ুদূষণ

শিশুমৃত্যু ঠেকাতে প্রয়োজন বায়ুর মান উন্নয়ন ও দূষণ রোধ

ছবি : বণিক বার্তা

দিন যত যাচ্ছে, দেশে বায়ুদূষণের মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বাতাসে নানা দূষিত বস্তুকণা, অতিভারী ধাতু, ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি বায়ুর মান নষ্ট করছে। এসব দূষিত অতিক্ষুদ্র কণা সহজেই মানুষের চোখ-নাক-মুখ দিয়ে ঢুকে রক্তের সঙ্গে মিশে যায় এবং ফুসফুস, হার্ট, কিডনি ও লিভার আক্রান্ত করে। বিশ্বব্যাপী অধিকাংশ অসংক্রামক রোগের জন্য দায়ী বায়ুদূষণ। এমনকি বায়ুদূষণজনিত রোগেই সিংহভাগ মানুষ মারা যায়। তবে এতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীরা। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রজনন স্বাস্থ্য। গর্ভপাত, জন্মগত ত্রুটি, শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে বায়ুদূষণ বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে শিশুর বুদ্ধিমত্তা লোপ পায়। এছাড়া বর্তমানে শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে বায়ুদূষণ। সম্প্রতি জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) এবং হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউটের (এইচইআই) যৌথ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে, লোয়ার-রেসপিরেটরি-ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা নিম্ন শ্বাসনালির সংক্রমণে পাঁচ বছরের কম বয়সী যত শিশুর মৃত্যু হয়, তার ৪০ শতাংশের জন্যই বায়ুদূষণ দায়ী। আর দেশে বায়ুদূষণজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগে ২০২১ সালে ২ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর সংখ্যা ১৯ হাজারের বেশি। আর বিশ্বব্যাপী এই বয়স শ্রেণীর সাত লাখের বেশি শিশুর মৃত্যু হয় বায়ুদূষণের কারণে।

প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা বায়ুদূষণজনিত রোগের বেশি শিকার হয়। এর প্রভাবে অপরিণত ও কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ, হাঁপানি ও ফুসফুসের রোগসহ নানা স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়। অর্থাৎ বায়ুদূষণ কেবল শিশুর প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে তা নয়, এটি একই সঙ্গে শিশুর অসুস্থতাও বাড়াচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন স্বাস্থ্য ব্যয় বাড়ছে, তেমনি ভবিষ্যতে এসব শিশুর কর্মক্ষমতা হ্রাসের আশঙ্কাও রয়েছে। বায়ুদূষণের ফলে শিশুমৃত্যু বা স্বাস্থ্যব্যয় বেড়ে যাওয়া কিংবা কর্মক্ষমতাহীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতির জন্য কখনই সুখকর হতে পারে না। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা তাই আবশ্যক। এজন্য প্রয়োজন বায়ুর গুণগত মান উন্নয়ন এবং দূষণ রোধ। 

দীর্ঘায়ু ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে সবচেয়ে অপরিহার্য পরিবেশগত উপাদান হলো বিশুদ্ধ বায়ু। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে বায়ুদূষণের মাত্রা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। ২০২২ সালে বেসরকারি ইউনিভার্সিটি স্ট্যামফোর্ডের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) কর্তৃক প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেশে ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪টি জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি অতিরিক্ত দূষিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয় দেশের ১৮টি জেলাকে। ২০২৩ সালেও বায়ুদূষণের মাত্রায় কোনো হেরফের হয়নি। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের ‘বৈশ্বিক বায়ুমান প্রতিবেদন ২০২৩’ থেকে জানা যায়, সর্বোচ্চ বায়ুদূষণের তালিকায় ২০২৩ সালে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। যেখানে ২০২২ সালের প্রতিবেদনে সর্বোচ্চ বায়ুদূষণের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল পঞ্চম। অর্থাৎ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে বায়ুদূষণ ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। 

বায়ুদূষণের অন্যতম উপাদান পিএম ২ দশমিক ৫ বা অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি হিসাব করেই মূলত বায়ুমান নির্ণয় করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে এ অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ ৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু আইকিউএয়ারের তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি ছিল ৭৯ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, গত বছর বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি ছিল আদর্শ মানদণ্ডের প্রায় ১৬ গুণ বেশি।

প্রাকৃতিকভাবে ও মানবসৃষ্ট উভয় কারণেই বায়ু দূষিত হয়। তবে মানবসৃষ্ট কারণে বর্তমানে বায়ুদূষণ এ পর্যায়ে পৌঁছেছে বলা যায়। অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ, যত্রতত্র গড়ে ওঠা সেকেলে ঘরানার ইটভাটা, ছোট-বড় শিল্প-কারখানা, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং ময়লা-আবর্জনা পোড়ানো ইত্যাদি কারণে দূষণ বেড়েই চলেছে। তবে দেশে বায়ুদূষণ বেশি ঘটে শিল্প-কারখানা ও ইটভাটার কারণে।

বায়ুদূষণ হ্রাস করার লক্ষ্যে ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৯)’ শীর্ষক আইন প্রণয়ন করা হয়। ক্যাপসের গবেষণা অনুযায়ী, কেবল ঢাকার আশপাশের প্রায় ১ হাজার ২০০টি ইটভাটা, ছোট-বড় কয়েক হাজার শিল্প-কারখানা আছে। বায়ুদূষণ রোধ, নিয়ন্ত্রণ এবং বায়ুমানের উন্নতি, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের সুরক্ষায় ‘নির্মল বায়ু আইন-২০২৯’ গৃহীত হয়। যদিও বাতাসের বর্তমান অবস্থা জানান দিচ্ছে যে দেশে আইনের কোনো কার্যকর প্রয়োগ নেই। সুতরাং দূষণ রোধে শুরুতেই আইন কার্যকর করা আবশ্যক। অবৈধ ইটভাটা নিষ্ক্রিয় এবং প্রয়োজনে আধুনিকায়ন; শিল্প-কারখানার মালিকদের বাধ্য করতে হবে বায়ুদূষণ রোধে যথাযথ উদ্যোগ নিতে। মোটকথা, বায়ুদূষণে দায়ী খাতগুলোকে আইনের আওতায় আনতে হবে। তা না হলে এ দূষণ কখনই নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না।

দেশে বায়ুর মান নিয়ে গবেষণা জোরদার করাও জরুরি। দূষণের মাত্রা আগের চেয়ে বেড়েছে না কমেছে সে সম্পর্কে নিয়মিতভাবে অবগত থেকে সে মোতাবেক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর, আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত পদক্ষেপ কাম্য। তবে ব্যক্তি পর্যায়েও এ বিষয়ে সচেতনতা জরুরি।

শিল্প-কারখানা ও ইটভাটা ছাড়াও গ্রামীণ এলাকায় জমিতে ছিটানো কীটনাশক, রান্নাঘরের জ্বালানির ধোঁয়া থেকেও বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। পাশাপাশি অপরিকল্পিত নগরায়ণ বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ রাজধানী ঢাকা। আইকিউএয়ারের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে দূষিত রাজধানীর তালিকায় ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। বায়ুদূষণ এভাবে চলতে থাকলে মানুষের আয়ুষ্কাল কমে আসবে এবং সুস্থ জীবন হুমকির সম্মুখীন হবে। এরই মধ্যে শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত এক এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সে উল্লেখ করা হয়, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। ঢাকায় কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস।

ব্যক্তি পর্যায়ে ছাদবাগান, সবুজায়ন ও জলাধার সংরক্ষণে উৎসাহিত করতে হবে। ঘরের বাইরে চলাফেরার সময় মাস্ক পরিধান করে নিজেকে বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষায় স্বল্পমেয়াদি হিসেবে ভালো পদক্ষেপ হতে পারে। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে দূষিত শহরগুলোয় ২-৩ ঘণ্টা পরপর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা, নির্মাণকাজের সময় নির্মাণ স্থান ঢেকে রাখা, নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নেয়া, রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাক ব্যবহার, ব্যক্তিগত গাড়ি ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির চলাচল নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। এক কথায় বললে, সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া বায়ুর মান উন্নয়ন ও দূষণ রোধ আদৌ সম্ভব নয়। 


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন