সুইজারল্যান্ড থেকে অর্থ সরিয়ে নিচ্ছেন বাংলাদেশীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : সংগৃহীত

সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংক বা সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমা আমানতের পরিমাণ ২০২৩ সাল শেষে নেমে এসেছে ১ কোটি ৭৭ লাখ ১২ হাজার সুইস ফ্রাঁয়। দেশটির ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশীদের জমা আমানত ২০২২ সালের তুলনায় কমেছে প্রায় ৬৮ শতাংশ। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) গতকাল প্রকাশিত বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ধনাঢ্য বাংলাদেশী ও অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের মালিকদের মধ্যে সুইজারল্যান্ডসহ পশ্চিমা দেশগুলোয় পাচারকৃত অর্থ সরিয়ে আনার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এর পরিবর্তে দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বা পূর্ব ইউরোপের মতো দেশগুলোয় অর্থের নিরাপদ গন্তব্যের সন্ধান করছেন তারা। 

এসএনবির প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমাকৃত আমানতের পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৫২ লাখ ১১ হাজার সুইস ফ্রাঁ। এর আগে ২০২১ সালে জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ ১১ হাজার সুইস ফ্রাঁ। সে অনুযায়ী ২০২২ সালে দেশটিতে বাংলাদেশীদের জমাকৃত অর্থ আগের বছরের তুলনায় কমেছিল প্রায় ৯৪ শতাংশ। এ ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আমানতের পরিমাণ কমেছে ২০২৩ সালেও। 

প্রতিবেদনে সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, যদি কোনো বাংলাদেশী তার নাগরিকত্ব গোপন করে এখানকার ব্যাংকগুলোয় অর্থ জমা রেখে থাকেন, তবে তা এ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। প্রতিবেদনে আমানতের তথ্য প্রকাশ করা হলেও সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের গচ্ছিত রাখা স্বর্ণ বা মূল্যবান সামগ্রীর আর্থিক মূল্যমান প্রকাশ করা হয়নি। এছাড়া আমানতকারীদের তালিকাও প্রকাশ করা হয়নি।

সারা বিশ্বের ধনীদের অর্থ গোপনে গচ্ছিত রাখার জন্য বহুদিনের খ্যাতি সুইজারল্যান্ডের। রীতিমতো আইনের বলে গ্রাহকদের নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্ত কঠোরভাবে পালন করে সুইস ব্যাংকগুলো। এ কারণে এক সময় গোটা বিশ্বেই অপ্রদর্শিত ও পাচারকৃত অর্থ গচ্ছিত রাখার নিরাপদ গন্তব্য হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল সুইস ব্যাংকগুলো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশটিতে নিরাপদে ও গোপনে অর্থ রাখার সুযোগ থাকলেও তা বিনিয়োগ করে সম্পদ বাড়ানোর সুযোগ নেই, যেটি অন্যান্য গন্তব্যে পাওয়া যায়। এ অবস্থায় বাংলাদেশীদের অনেকেই এখন আর দেশটিতে টাকা রাখতে চাইছেন না। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সুইস ব্যাংকগুলোয় আমানত কমার তথ্যের অর্থ এই নয় যে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার কমেছে। বাংলাদেশীদের পাচারকৃত অর্থের প্রচলিত একটি গন্তব্য হলো সুইস ব্যাংক। বিভিন্ন দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের প্রবাহ আকর্ষণে গন্তব্যগুলোর মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা রয়েছে। এ প্রতিযোগিতায় সুইজারল্যান্ডের আকর্ষণ ক্রমেই কমছে। এর একটি কারণ হলো দেশটির দেয়া সুযোগ-সুবিধা। আন্তর্জাতিক অর্থ পাচার প্রতিরোধমূলক জোটের কর্মকাণ্ড ও সক্রিয়তা বাড়ায় সুইজারল্যান্ডে আগের তুলনায় কড়াকড়িটা বেড়েছে। তার চেয়ে বড় কথা দেশটির ব্যাংকে শুধু অর্থ লগ্নি করা যায়, সম্পদ গড়ে তোলা খুবই কঠিন বা প্রায় অসম্ভবের মতো। অথচ অন্যান্য গন্তব্যে পাচারকৃত অর্থের ওপর নির্ভর করে সম্পদ বাড়ানোর বিষয়টি তুলনামূলকভাবে সহজ হয়ে এসেছে, যা ক্রমেই আরো সহজ করা হচ্ছে। জায়গাগুলোও অর্থ পাচারের জন্য ক্রমেই আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। এসব কারণে যারা অর্থ পাচার করেন, তারা সুইজারল্যান্ডের বাইরে অন্য গন্তব্যগুলোর দিকে ঝুঁকছেন।’

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশীদের সবচেয়ে বেশি আমানত ছিল সুইস ব্যাংকে। ২০০২ সালে আমানত ছিল মাত্র ৩ কোটি ১০ লাখ সুইস ফ্রাঁ। দুই দশকের মধ্যে তা প্রায় ৩০ গুণ বেড়ে যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছিল ২০২১ সালে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসএনবি সাধারণত দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদের বাধ্যবাধকতা মেনে এ তথ্য প্রকাশ করে থাকে। তবে দেশটিতে রীতিমতো আইন করে ব্যাংকে আমানতকারী বা অর্থসম্পদ গচ্ছিত রাখা ব্যক্তিদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা রক্ষা করা হয়। এ কারণে এসএনবির প্রতিবেদনে গ্রাহকদের জাতীয়তা সম্পর্কে সাধারণ একটি ধারণা পাওয়া গেলেও তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হয় না। 

প্রতিবেদনে দেখা যায়, সুইস ব্যাংক থেকে শুধু বাংলাদেশী না, ভারতীয় ও পাকিস্তানি আমানতকারীরাও তাদের অর্থ সরিয়ে নিচ্ছেন। ২০২০ সাল শেষে দেশটির ব্যাংকগুলোয় ভারতীয়দের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ২৫৫ কোটি ২৬ লাখ সুইস ফ্রাঁ। ২০২১ সালে তা ৫০ শতাংশ বেড়ে ৩৮২ কোটি ৮৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ হয়। ২০২২ সালে জমা করা অর্থের পরিমাণ ২০১৯ সালে ছিল ৩৪০ কোটি ২ লাখ ৬১ হাজার সুইস ফ্রাঁ। আর গত বছর শেষে তা দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি কমে নেমে আসে ১০২ কোটি ৯৮ লাখ ৪৪ হাজার সুইস ফ্রাঁয়। 

ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে পাকিস্তানের নাগরিকদের আমানতও। ২০২০ সালে সুইস ব্যাংকগুলোয় পাকিস্তানিদের জমা করা আমানতের পরিমাণ ছিল ৬৪ কোটি ২২ লাখ সুইস ফ্রাঁ। ২০২১ সাল শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ কোটি ৫৯ লাখ ফ্রাঁ। এর ২০২২ সালে তা নেমে আসে অর্ধেকের কিছু বেশিতে; ৩৮ কোটি ৮৬ লাখ ৫০ হাজার সুইস ফ্রাঁ। এরপর গত বছর শেষে তা আরো কমে দাঁড়িয়েছে ২৮ কোটি ৫৭ লাখ ৬৬ হাজার সুইস ফ্রাঁয়। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন