বাজেট প্রতিক্রিয়া

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক বাজেট

ড. মনসুর আলম খান

ছবি : বণিক বার্তা

জাতীয় সংসদে উত্থাপন হয়েছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী আগামী অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন। প্রস্তাবিত বাজেটের শিরোনাম দেয়া হয়েছে ‘টেকসই উন্নয়নের পরিক্রমায় স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা।’ সংসদে উপস্থাপিত বাজেট নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। আমাদের নায়েমের গলির পান-সিগারেটের দোকানদার খয়বর চাচা থেকে শুরু করে তারকা তারকা হোটেলে গোলটেবিলের বক্তা সম্মানীত অর্থনীতিবিদ সবাই বাজেট নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত রেখে যাচ্ছেন। কিন্তু আমরা যারা অ-অর্থনীতিবিদ বুঝতে চাইব ব্যয় সংকোচনমূলক বাজেট কেমন করে কমাতে পারে মূল্যস্ফীতির বোঝা। 

মোটা দাগে বাজেটের তিনটি অংশ—আয়, ব্যয় ও অর্থায়ন। বাজেটের প্রথম ভাগে থাকে আয়ের হিসাব। ‘রাজস্ব প্রাপ্তি ও বৈদেশিক অনুদান’  শিরোনামে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারের সম্ভাব্য আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সরকারের আয়ের আবার তিনটি উৎস ১. জনগণের প্রদেয় কর (এনবিআর কর্তৃক আদায় এবং অন্যান্য সংস্থা কর্তৃক আদায়) ৪ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা, ২. করবহির্ভূত আয় (ফি, লভ্যাংশ, অর্থদণ্ড, জরিমানা ইত্যাদি) ৪৬ হাজার কোটি টাকা এবং ৩. বৈদেশিক অনুদান ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বিগত দিনে কর আহরণে আমাদের রাজস্ব বিভাগ আশানুরূপ দক্ষতা দেখাতে পারেনি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল কর্তৃক প্রকাশিত আর্টিকেল-৪ মোতাবেক ২০২৩-২৪ অর্থবছর বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত ছিল মাত্র ৮ দশমিক ২ শতাংশ। যেখানে ২০২৩ সালে জাপান, ভারত ও চীন রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত ছিল যথাক্রমে ১৯ দশমিক ৮, ১৯ দশমিক ৪ ও ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ। উন্নত দেশে এ হার আরো বেশি। Revenue Statistics 2023 Tax Revenue Buoyancy in OECD Countries শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লিখিত উন্নত দেশগুলোর সংস্থা ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোয় ২০২২ সালে কর-জিডিপি অনুপাতের গড় মান ছিল ৩৪ দশমিক শূন্য শতাংশ। আইএমএফের ভাষায়, বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বিশ্বের নিম্নতমের একটি এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তা আরো কমেছে। উন্নত দেশে কর ব্যবস্থা হয় প্রগতিশীল, যার আয় বেশি তার করও বেশি। সমাজের উচ্চ আয়ের ব্যক্তি থেকে আদায়কৃত অর্থ বণ্টন করা হয় নিম্ন আয়ের সামাজিক সুরক্ষা খাতে। এভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠা পায় ন্যায্যতা। বিপরীতে পশ্চাৎমুখী কর ব্যবস্থা ‘তেলা মাথায় ঢালো তেল’ নীতি ধারণ করে। উচ্চবিত্তরা নীতি সুবিধা নিয়ে ফুলেফেঁপে ওঠেন। ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’ নীতিতে পিষ্ট হয় নিয়মিত কর প্রদানে আন্তরিক নাগরিক। এমন প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল গত ২৪ এপ্রিল-৮ মে অনুষ্ঠিত ধারাবাহিক সভায় রাজস্ব বোর্ডের কাছে রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশের কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছে।

সরকারি আয়ের দ্বিতীয় উৎস কর-বহির্ভূত আয়। সরকার কর্তৃক সেবা প্রদানের বিপরীতে আদায়কৃত ফি, সরকারি সংস্থা অথবা আদালত কর্তৃক আদায়কৃত জরিমানা, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ, রাষ্ট্র কর্তৃক দেশী-বিদেশী বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ থেকে সরকার এ আয় করে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি বছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা (৪৯ হাজার কোটি টাকা) থেকেও কম। এরূপ ঋণাত্মক লক্ষ্য নির্ধারণ এক দিকে মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় ফি/জরিমানা আদায়ে সরকারের নমনীয় নীতি, বিপরীত দিকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর অদক্ষতা প্রকাশ করে। বাজেটে আয়ের তৃতীয় খাত বৈদেশিক অনুদান। প্রস্তাবিত বাজেটে অনুদান প্রাপ্তির হিসাব ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের মাত্র দশমিক ৫৫ শতাংশ। অতীতে বাংলাদেশের বাজেটের সিংহভাগ জোগান দিত বৈদেশিক অনুদান হিসাবে। ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরের ৩৫ হাজার ৯১৪ কোটি টাকার সংশোধিত বাজেটে অনুদান প্রাপ্তি ছিল ৩৬০৯ কোটি টাকা, প্রায় ১০ দশমিক শন্য ৫ শতাংশ। অতীতের অনুদান নির্ভরশীলতা থেকে বের হয়ে আসছে বর্তমানের বাংলাদেশ। 

বাজেটের দ্বিতীয় ভাগে থাকে সরকারের সম্ভাব্য ব্যয়ের হিসাব। প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী অর্থবছর মোট সম্ভাব্য ব্যয়ের পরিমাণ ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। সম্ভাব্য ব্যয় আবার চারটি ভিন্ন খাতে বিভক্ত করা হয়। আগামী বছরের জন্য ১. পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা, ২. খাদ্য হিসাবে ১১৯ কোটি, ৩. ঋণ ও অগ্রিম প্রাপ্তি বাবদ খরচ ৮ হাজার ৪৫৭ কোটি এবং ৪. উন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা হবে মর্মে প্রস্তাব করা হয়েছে। আমার মতো অ-অর্থনীতিবিদদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে সরকারের অত্যধিক পরিচালন ব্যয়ের জন্য প্রশাসন কাঠামো দায়ী। বাস্তবতা হলো পরিচালন ব্যয় থেকে রাষ্ট্রীয় কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিদের বেতন-ভাতা-সম্মানী প্রদানে খরচ হয় সামান্যই। সামাজিক সুরক্ষা, সার ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি, দেশী-বিদেশী উৎস থেকে বিগত দিনে গৃহীত ঋণের সুদের কিস্তি প্রদান এসব ব্যয় অন্তর্ভুক্ত হয় পরিচালন ব্যয় হিসাবে। পরিচালন ব্যয় খুব বেশি কাটছাঁটের সুযোগ থাকে না। একান্ত না হলেই নয় এমন খরচই থাকে পরিচালন খাতে। প্রস্তাবিত বাজেটে বাড়ানো হয়েছে সামাজিক সুরক্ষা খাতের ব্যয়। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা থেকে পাই, ‘সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১ লাখ ৩৬ হাজার ২৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা ছিল।’ ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় বেড়েছে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৮৮(ঘ) মোতাবেক সময়মতো ঋণ পরিশোধ সরকারের ওপর সাংবিধানিক দায়। চলমান অর্থবছর এ খাতে প্রাথমিক বরাদ্দ ছিল ১২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা, সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে হয়েছে ১৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গৃহীত ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দকৃত ৯৩ হাজার কোটি টাকা চলমান অর্থবছরের (৮২ হাজার কোটি টাকা) তুলনায় কিছুটা বেশি। বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির বর্তমান নিম্নমুখী ধারা এবং ডলারের বর্তমান দাম স্থিতিশীল থাকলে আমদানিনির্ভর সব খাতে সরকারের পরিচালন ব্যয় কমে আসার সম্ভাবনা আছে। মূল্যস্ফীতির প্রভাব মোকাবেলায় সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রদান মানবিক সরকারের পরিচায়ক। বাজেটে ব্যয়ের ‘খাদ্য হিসাবে’ বরাদ্দ এখন আর তেমন রাখা হয় না। ২০০০-০১ অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৯৫ কোটি টাকা, মোট বাজেটের (৩৮ হাজার ৫২৪ কোটি টাকার) ১ দশমিক শূন্য ২৫ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে আপৎকালীন বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানির জন্য খাদ্য হিসাবে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ১১৯ কোটি টাকা, মোট বাজেটের প্রায় দশমিক শূন্য ১৫ শতাংশ। এ বরাদ্দ বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনেরই প্রমাণক। আগামী অর্থবছর কৃচ্ছ্রতা সাধন করা হবে মূলত উন্নয়ন খাতে। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকার উন্নয়ন ব্যয়ের। চলমান অর্থবছরের (২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা) তুলনায় উন্নয়ন ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ দশমিক ৩৯ শতাংশ। যেখানে ২০২২-২৩ (২ লাখ ৫৯ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা) ও ২০২১-২২ (২ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮ কোটি টাকা) অর্থবছরে তুলনায় পরের অর্থবছর উন্নয়ন ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যথাক্রমে প্রায় ৬ দশমিক ৯২ ও ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের রাশ টানার ফলে বেকারত্ব বেড়ে যেতে পারে। তথাপি মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় বাজারে টাকার প্রবাহ কমানোর লক্ষ্যে সংকোচনমূলক বাজেট প্রণয়ন সময়ের দাবি পূরণ করা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। 

বাজেটের তৃতীয় ভাগে ‘অর্থ সংস্থান’ অংশে থাকে সম্ভাব্য ঋণের হিসাব। বাজেটে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে বাজেটকে বলা হয় ‘ঘাটতি বাজেট’। ঘাটতি বাজেটের অর্থ সংস্থান করা হয় দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণ করে। প্রস্তাবিত বাজেটের তৃতীয় ভাগে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য সম্ভাব্য ঋণের পরিমাণ ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে নিট বৈদেশিক ঋণ ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ঋণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ‘ঘাটতি বাজেট’ নেতিবাচক শোনালেও এটা নেতিবাচক কোনো বিষয় নয় বরং উন্নয়ন সহায়ক। আইএমএফের তথ্যমতে কাতার, লুক্সেমবার্গ, উজবেকিস্তান ইত্যাদি পেট্রো-ডলারে সমৃদ্ধ হাতেগোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব দেশের বাজেটই ‘ঘাটতি বাজেট’। যুক্তরাষ্ট্রের Office of Management and Budget কর্তৃক প্রকাশিত Budget of the US Government Fiscal Year মোতাবেক ২০২৪ অর্থবছরে তাদের মোট ৬ দশমিক ৮৯ ট্রিলিয়ন ডলারের বাজেটে ঘাটতি ছিল ১ দশমিক ৮৫ ট্রিলিয়ন ডলার (বাজেট ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৬ দশমিক ৮ শতাংশ)। বাংলাদেশের প্রস্তাবিত বাজেট ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির (৫৬ ট্রিলিয়ন টাকা) ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটের লক্ষণীয় বিষয় হলো বৈদেশিক উৎস থেকে নিট ঋণপ্রাপ্তির নিম্নগামী ধারা। চলমান অর্থবছর বৈদেশিক ঋণ ছিল ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা, প্রস্তাবিত বাজেটে যার পরিমাণ ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর অন্যতম কারণ ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। বৈদেশিক ঋণের সঙ্গে প্রবাহ ঘটে বৈদেশিক মুদ্রার, বিশেষজ্ঞ জ্ঞান। তাছাড়া বৈদেশিক ঋণের সুদহার থাকে কম, মেয়াদ হয় দীর্ঘ। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণের মাত্রা বেশি হলে বেসরকারি বিনিয়োগ হ্রাস পায়। সে বিবেচনায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মতৎপরতা বাড়িয়ে উৎপাদনমুখী প্রকল্পের বিপরীতে বৈদেশিক ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধি করা দরকার মর্মে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।  

এবার আসা যাক প্রস্তাবিত বাজেটের প্রকৃতি বিশ্লেষণে। সাধারণত ব্যয়ের ধরন দেখে বাজেটকে বিশেষায়িত করা হয়। এবারের বাজেটকে যেমন বিশেষায়িত করা হচ্ছে ‘ব্যয় সংকোচনের’ বাজেট হিসেবে। সহজ ভাষায় বলা যায়, প্রস্তাবিত বাজেটের প্রধানতম লক্ষ্য মূল্যস্ফীতির বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা এবং বৈদেশিক মুদ্রার সংকট থেকে উত্তরণ। মূল্যস্ফীতির বিরূপ প্রভাব মোকাবেলার জন্য বার্ষিক বাজেটকে কাজে লাগানো একটা স্বতঃসিদ্ধ রীতি। তার মাঝে মূল্যস্ফীতির ধকল কাটিয়ে ওঠার জন্য বিভিন্ন খাতে পরিপোষণ (Indexation) আকারে সহায়তা প্রদান কার্যকর পন্থা। আইএমএফ কর্তৃক বিশ্বের ১৯২টি দেশের ওপর গবেষণার ভিত্তিতে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত ‘Inflation Indexation in Public Finances’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি পেনশন, সামাজিক সুরক্ষা খাত, ব্যক্তি শ্রেণীর আয়করের ধাপ, সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ইত্যাদি খাতে পরিপোষণ করা হলে বেসামরিক কর্মচারী, অবসরপ্রাপ্ত এবং নিম্ন আয়ের পরিবারের ক্রয়ক্ষমতা স্থির থাকে। রাজনৈতিক সরকারের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য পরিপোষণ বহুল চর্চিত রেওয়াজ। পরিপোষণের নেতিবাচক প্রভাবও আছে। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে বাজারে চাহিদা বাড়ে যা সম্ভাব্য মুদ্রাস্ফীতিকে আরো দীর্ঘায়িত করে। এক্ষেত্রে সরকার আর্থিক সহায়তা প্রদানের পরিবর্তে পণ্যের দাম ও সরবরাহ স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করে। বর্তমান বাজেটে সরকার পেনশন ও সরকারি কর্মচারীদের বেতন না বাড়িয়ে সামাজিক সুরক্ষাবলয় ও বৃদ্ধি এবং ব্যক্তি শ্রেণীর নিম্ন করসীমা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা স্থিতিশীল রাখার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের রাশ টেনে ধারার প্রচেষ্টা স্পষ্টতর। আইএমএফ কর্তৃক প্রকাশিত Inflation and disinflation: What role for fiscal policy মোতাবেক কোনো অর্থবছরে জিডিপির ১ শতাংশ পরিমাণ ব্যয় কমানো হলে পরবর্তী আট প্রান্তিকে ২ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পায়। উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ কম থাকলে ইতিবাচক-নেতিবাচক উভয় দিকই আছে। দেশীয় উৎস থেকে সরকারি বিনিয়োগ অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক খাত পুনর্বিন্যাস, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি ইত্যাদিতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। শিল্প খাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বিনিয়োগ বিদেশী বিনিয়োগকে ইতিবাচকভাবে উৎসাহিত করে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বেগবান হলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়, অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচক ইতিবাচক ধারায় প্রবাহিত হয়। বিপরীত দিকে মূল্যস্ফীতি রোধ এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার জন্য সংকোচনমূলক বাজেট অপরিহার্য। 

প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যয় সমন্বয় আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ব্যতিক্রম, সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জিং। করোনা মহামারী এবং পরবর্তী সময়ে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে খাদ্য ও জ্বালানির দাম বেড়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের সংরক্ষণশীল নীতি থেকে বের হয়ে এসে সীমিত বাজারভিত্তিক ক্রলিং পেগ মুদ্রানীতি গ্রহণ করায় টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। ফলে আগের ডলারে গৃহীত ঋণ ও অগ্রিম বাবদ পরিশোধ খরচ বাড়বে আগামী বছর। আইএমএফের ভাষ্যে, মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখার মূল চালিকাশক্তি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি। রাজস্ব নীতির আওতায় বাজেট বরাদ্দ কেবল সহযোগী ভূমিকা রাখতে পারে। মুদ্রানীতি হোক অথবা রাজস্ব নীতি প্রতিটি গৃহীত পদক্ষেপেরই রয়েছে বিপরীতমুখী প্রভাব। এসব বিবেচনায় নিয়ে নীতিনির্ধারকদেরই খুঁজে নিতে হয় সময়োপযোগী কার্যকর নীতি। 

ড. মনসুর আলম খান: পরিচালক (যুগ্ম সচিব)

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন