আলোকপাত

রেমিট্যান্সের বড় উৎস হতে পারে প্রশিক্ষিত কেয়ারগিভার

মো. তৌহিদ হোসেন

ছবি : বণিক বার্তা

আমরা অনেক ভাই-বোন, তার মাঝে সবার বড় বোনের বয়স ৭৮। তার স্বামী গত হয়েছেন অনেক বছর। বসুন্ধরার যে বাড়িটিতে আমার চার ভাই থাকেন, তারই একটি ফ্ল্যাটে একাই থাকেন আমার বোন। একজন খণ্ডকালীন গৃহকর্মী বাসায় কাজ করে দিয়ে যায়। বাসার আরেকজন সদস্য হচ্ছে একটি অল্প বয়সী মেয়ে যে সৎমা দ্বারা নিগৃহীত হওয়ার পর তার সঙ্গে থাকছে। আপার দেখভাল করার পাশাপাশি একটি কারিগরি কোর্সে পড়াশোনা করে। প্রায়ই অবশ্য আমরা দেখতাম যে আমাদের বোনই মেয়েটার দেখভাল করেন। হাঁটায় যদিও একটু সমস্যা আছে তার, তবু নিজেই এসে দরজা খুলে দেন যাতে মেয়েটার লেখাপড়ার ব্যাঘাত না ঘটে।

দুই সপ্তাহ আগে আমার বোনের একটা স্ট্রোক হয়। হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ১০ দিন থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরেন। হাসপাতালে মেয়েটা তার সঙ্গে ছিল। স্ট্রোকের রোগীর যেসব সহায়তা দরকার তার একার পক্ষে তা সামলানো সম্ভব ছিল না। আর আমাদের দেশের বেশির ভাগ হাসপাতালে এ ধরনের রোগীর যত্ন নেয়ার জন্য স্বয়ংক্রিয় কোনো ব্যবস্থা নেই। রোগীর পক্ষ থেকে নিয়োগ করা একজন কেয়ারগিভার লাগে। বোন যখন হাসপাতালে ছিলেন তখন এমন একজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। বাসায় ফেরার পর থেকেও একজন আছেন সার্বক্ষণিক। আপার সঙ্গে থাকে যে তরুণী সে তো আছেই। 

আমার জানার মধ্যেই আরো অনেক জ্যেষ্ঠ নাগরিক আছেন যাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক কেয়ারগিভার আছে। এটা যে শুধু উচ্চবিত্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ তা নয়, মধ্যবিত্তরাও তাদের সামর্থ্যের উল্লেখযোগ্য অংক ব্যয় করে কেয়ারগিভার রাখছেন প্রয়োজনের নিরিখে। 

আমার বোনের যেহেতু অনেক ভাই-বোন, সবাই তার দেখভালের দায়িত্ব ভাগাভাগি করছে। কিন্তু অনিবার্যভাবেই এই সুবিধা শেষ হয়ে যাবে খুব দ্রুত। বাংলাদেশে প্রজননের গড় (একজন নারী তার জীবৎকালে মোট যতজন সন্তান জন্ম দেন) ১৯৭০ সালে ছিল ৬ দশমিক ৯ জন। ১৯৯০ সালেও এ হার ছিল ৪ দশমিক ৪৮, যা ২০২৪ সালে নেমে এসেছে ১ দশমিক ৯১-এ। বয়োজ্যেষ্ঠদের পারিবারিকভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক যত্ন নেয়া তাই ক্রমহ্রাসমান হতে বাধ্য। এ অবস্থায় পেশাদার কেয়ারগিভারের চাহিদা দিন দিন বাড়তেই থাকবে এবং তাদের ওপর নির্ভরতাও বাড়বে।

ইউএন এসক্যাপের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৬৫ বছর বা বেশি বয়স্ক মানুষ ১৯৯০ সালে ছিল মোট জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২২ সালে তা ৬ শতাংশে পৌঁছেছে। ২০৩০ সালে তা দাঁড়াবে ৭ দশমিক ৯ ও ২০৫০ সালে ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১১ সালে ৬৫ বা তদূর্ধ্বদের মোট সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২ লাখ, ২০২২ সালেই তা দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৫৩ লাখে। অর্থাৎ ১১ বছরে এ সংখ্যা হয়ে গেছে দেড় গুণের বেশি। আগামী দিনগুলোয় এ সংখ্যা শুধু বাড়তেই থাকবে, সেই সঙ্গে বাড়বে কেয়ারগিভারের চাহিদাও। 

যে কেয়ারগিভার নারীকে আমরা নিয়োগ দিয়েছি তিনি আমার বোনের বাসায় সার্বক্ষণিক অবস্থান করেন, বেতন ১৫ হাজার টাকা, সঙ্গে তিন বেলা খাবার। এটা খুব বেশি নয়, তবে অর্থনীতির অনেক সেক্টরেই বেতন এ রকমই, বিশেষ করে যাদের তেমন কোনো স্কিল নেই। এই নারীর খানিকটা অভিজ্ঞতা আছে, তবে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রশিক্ষণ নেই। যাদের প্রশিক্ষণ বা স্কিল আছে তারা বেতন পান আরো বেশি। আরেকটু বেশি বয়স যাদের, সার্বক্ষণিক কেয়ারের জন্য তারা অনেকে দুজন প্রশিক্ষিত কেয়ারগিভার রাখেন।

সংখ্যাগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে প্রশিক্ষিত কেয়ারগিভারের একটা শ্রমবাজার গড়ে উঠছে দেশে। এটা যে দিন দিন বাড়বে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। এ বিষয়ে সচেতনতা যে নেই তা নয়। তিন থেকে ছয় মাস মেয়াদি কেয়ারগিভার প্রশিক্ষণের জন্য বেশকিছু প্রশিক্ষণ সংস্থাও গড়ে উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। তবে বাজার যত বড় হচ্ছে সে তুলনায় প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার ব্যাপ্তি যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে না। সরকারের যেসব কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র কম ব্যবহার হচ্ছে, সেগুলোয় কেয়ারগিভার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিলে একদিকে যেমন এ কেন্দ্রগুলোর ব্যবহার বাড়ত, অন্যদিকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কেয়ারগিভারের অপ্রতুলতাও দূর হতো।

আরেকটি বিষয় নিয়েও বিভিন্ন সময় অনেক আলোচনা হয়, তা হচ্ছে উন্নত বিশ্বে প্রশিক্ষিত কেয়ারগিভারের ব্যাপক চাহিদা। আমাদের শ্রমশক্তির মূল গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়া। দুটিতেই আমরা প্রধানত অদক্ষ শ্রমিক বা গৃহকর্মী পাঠাই অত্যন্ত অল্প বেতনে এবং বেশি অভিবাসন ব্যয়ে। উন্নত বিশ্বে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কেয়ারগিভারের বেতন অনেক বেশি। ইউরোপীয় ইউনিয়নে ৬৫ বছরের বেশি বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ২১ দশমিক ৩ শতাংশ। এমনকি ৭৫ বছরের বেশি বয়সীদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ (ইতালিতে ১২ শতাংশ)। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জাপান বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক মানুষের দেশ। ইতালি ও ফিনল্যান্ড রয়েছে এ তালিকার দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে। গত বছর জাপানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রণালয় (ইন্টার্নাল অ্যাফেয়ার্স মিনিস্ট্রি) থেকে বলা হয়, ৮০ বছরের বেশি বয়সী জনগোষ্ঠী দেশটির মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৬২ লাখ ৩০ হাজার, যা মোট জনসংখ্যার ২৯ দশমিক ১ শতাংশ। জাপানের দ্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন অ্যান্ড সোশ্যাল সিকিউরিট রিসার্চের পূর্বাভাস, ২০৪০ সাল নাগাদ ৬৫ বা তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়াবে মোট জনসংখ্যার ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ। স্পষ্টত জাপানে কেয়ারগিভারের ব্যাপক বাজার সৃষ্টি হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোয় একক পরিবারের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সেখানেও ক্রমবর্ধমান বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য সহায়ক কিংবা কেয়ারগিভারের চাহিদা থাকলেও সরবরাহে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশে যে তিন মাস বা ছয় মাসের প্রশিক্ষণ হয় তা দিয়ে ইউরোপে চাকরি পাওয়া যাবে না। প্রয়োজন হবে ইউরোপীয় মানের প্রশিক্ষণ আর সে সঙ্গে ভাষায় দক্ষতা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে যথাযথ প্রশিক্ষণ কোর্স প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের দেশ থেকে কেয়ারগিভাররা চাকরি নিয়ে বৈধভাবে ইউরোপে যেতে পারবেন, ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরার ঝুঁকি নিতে হবে না। পাশাপাশি লেখাপড়ার যে চরম দুরবস্থা, তা থেকেও মুক্তি মিলবে। কিছুই না শিখিয়ে ডিগ্রি দেয়া বন্ধ করতে হবে, যাতে কারিগরি কাজের প্রতি সম্মানবোধ বাড়ে। কাজটি সহজ নয়, তবে সম্ভব। সাফল্যের তো কোনো সহজ বা সংক্ষিপ্ত পথ নেই। 

মো. তৌহিদ হোসেন: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন