রফতানিমুখী চামড়া শিল্পে পরিবর্তন আসবে কবে?

ওবায়দুল্লাহ সনি

ছবি : বণিক বার্তা

ঈদের দিন কোরবানি শেষে একটি ষাঁড়ের চামড়া নিয়ে রিকশায় করে ঘুরছিলেন নওগাঁ সদর উপজেলার তিলকপুর গ্রামের সাদ আহমেদ। মূলত তার উদ্দেশ্য সরকার নির্ধারিত মূল্যে সেটি বিক্রি করা। তবে ঘণ্টাখানেক ঘুরেও সে দামে বিক্রি করতে ব্যর্থ হন। পরে বাধ্য হয়েই মাত্র ৪০০ টাকায় স্থানীয় এক চামড়া ব্যবসায়ীর কাছে সেটি বিক্রি করেন। সাদ আহমেদ আক্ষেপ করে বলেন, ‘৯১ হাজার টাকা দিয়ে ষাঁড়টি কিনে কোরবানি দিয়েছি। এ চামড়া মাত্র ৪০০ টাকায় বিক্রি করতে হলো। চামড়ার টাকা তো গরিব-মিসকিনদের হক। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে সেই হক মেরে খাচ্ছে।’ (১৮ জুন, ২০২৪: বণিক বার্তা অনলাইন)

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত চামড়া শিল্প। রফতানিতে এ খাতের অবদান ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। দেশের জিডিপিতে অবদান শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ। কর্মসংস্থান প্রায় ৩৫ লাখ। সবাই এক বাক্যে স্বীকারও করেন যে চামড়া শিল্পের সম্ভাবনা অপরিসীম। এর রফতানি আয় তৈরি পোশাকের কাছে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। দীর্ঘদিন এ নিয়ে নানা পরিকল্পনা হয়েছে, প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, নানা ধরনের টাস্কফোর্স হয়েছে, কমিটি হয়েছে। সম্ভাবনাময় খাতটিকে সহায়তার জন্য বিভিন্ন সময় দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানও এগিয়ে এসেছে। সবশেষে যোগফল এক প্রকার শূন্য, কোনো কিছুকেই সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেনি বা পারছে না সরকার। উল্টো যেন শিল্পের পুরোটাই দখলে নিয়েছে ‘অদৃশ্য’ সিন্ডেকেট। 

চামড়া সংগ্রহের সবচেয়ে বড় মৌসুম কোরবানির ঈদ। প্রতি বছর চামড়ার বার্ষিক চাহিদার সিংহভাগই জোগান আসে কোরবানি দেয়া পশু থেকে। ফলে এ শিল্পের জন্য উন্নতমানের চামড়া কিনতে ব্যবসায়ীরাও এ সময় সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন। এবারো পশু কোরবানির পর রাজধানীসহ সারা দেশে শুরু হয় চামড়া বেচাকেনার কাজ। কয়েক বছর ধরে এর চাহিদা ও দাম কমার কারণে এ বছর থেকে লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। যদিও ব্যবসায়ীরা কাঁচা চামড়া কিনছেন আগের কম মূল্যেই। 

প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, এবারের ঈদুল আজহায় সারা দেশে প্রায় ১ কোটি ৪ লাখের বেশি পশু জবাই হয়েছে। এর মধ্যে ৪৮ লাখ ৫০ হাজারের মতো গরু-মহিষ এবং বাকিগুলো খাসি, বকরি, ভেড়াসহ অন্যান্য পশু। কোরবানি হওয়া পশুর এ সংখ্যা গত বছরের চেয়ে ৩ লাখ ৬৭ হাজার ১০৬টি বা ৩ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালে সারা দেশে ১ কোটি ৪২ হাজারের মতো গবাদিপশু কোরবানি দেয়া হয়েছিল। তার আগের বছর এ সংখ্যা ছিল সাড়ে ৯৯ লাখের মতো। তবে এসব পশুর চামড়ার ন্যূনতম দাম পাননি বলে দেশের অনেক অঞ্চলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা তা সড়কে ফেলে দেন, কেউবা মাটিতে পুঁতে ফেলেন বলে খবর এসেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। এবার যাতে এর পুনরাবৃত্তি না হয়, সেজন্য সংশ্লিষ্ট সব মহলকেই যথেষ্ট তৎপর থাকতে দেখা যায়। বেশ কিছুদিন ধরেই শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘন ঘন সভার আয়োজন করে। বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও আসে এসব বৈঠক থেকে। এর মধ্যে ছিল চামড়ার মূল্য নির্ধারণ, পরিবহন, সংরক্ষণ, মজুদ, পাচার রোধ, বাইরে থেকে পশু আসা ঠেকানো, লবণের বাজার নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি। যদিও এত কিছুর পরও কাঁচা চামড়ার দরপতন ঠেকানো যায়নি।  

চামড়ার বাজার কয়েক বছর ধরে এতটাই নিম্নমুখী যে চামড়া বিক্রির প্রবণতাই কমে গেছে। এখন কেউ পশু কোরবানি করলে চামড়া বিক্রি না করে দাতব্য প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা বা এতিমখানায় কিংবা গরিব কাউকে দিয়ে দেন। কেননা চামড়ার দাম এতটাই কম যে সেটি বহন করে বিক্রেতা পর্যন্ত পৌঁছাতে যে খরচ পড়ে, তাতে উল্টো পকেট থেকে ভরতে হয়। এবারো তার ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। অথচ এ বছর দাম বাড়িয়ে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হয় ৫৫-৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০-৫৫ টাকা। ঢাকার বাইরে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয় ৫০-৫৫ টাকা, গত বছর যা ছিল ৪৫-৪৮ টাকা। এছাড়া খাসির চামড়ার মূল্য ২০-২৫ টাকা এবং বকরির ১৮-২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

মৌসুমি ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থাকেন কোরবানির চামড়া থেকে যেন কিছু আর্থিক সুবিধা তারা নিতে পারেন। বাড়তি দাম দেখে লাভের আশায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে এবার চামড়াও সংগ্রহ করেছিলেন অন্যান্যবারের চেয়ে কিছুটা বেশি। কিন্তু বাজারে নিয়ে দেখেন ন্যূনতম দামও পাচ্ছেন না। চামড়া ব্যবসায়ীদের যুক্তি, কাঁচা চামড়া কেনার পর সেটি প্রক্রিয়াজাতের পেছনে তাদের খরচ হচ্ছে ২৭০ থেকে ৩২০ টাকা পর্যন্ত। সে কারণেই গত বারের চেয়ে বাড়তি দাম দিতে পারছেন না। 

তাদের এ যুক্তি মেনে নিয়েই একটা সহজ হিসাব করা যাক—সাধারণত একটা মাঝারি আকারের গরুর চমড়া ২৫ বর্গফুটের মতো হয়। লবণযুক্ত এ চামড়াটির দাম হওয়ার কথা ১ হাজার ৩৭৫ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। সে হিসাব থেকে লবণ, মজুরি ও অন্যান্য খরচ বাদ দিলে এর আনুমানিক মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ১২৫ থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকার মতো। কিন্তু ব্যবসায়ীরা কত টাকায় কিনছেন? মাত্র ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায়! তাও আবার ফুট-ইঞ্চির বালাই নেই, চোখের আন্দাজে আড়তদাররা চামড়া কেনেন আর লবণ মেশান।  

এটা ঠিক যে কাঁচা চামড়ার মূল্য অতীতে এমন ছিল না। ২০১৩ সালেও গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুট ৮৫-৯৫ টাকা এবং ছাগলের চামড়া ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হতো। এর পর থেকে বিভিন্ন কারণে ধারাবাহিকভাবেই চামড়ার দাম কমতে থাকে। সবচেয়ে বেশি কদর কমে ২০১৭ সালের পর থেকে। ২০১৯ সালে কোরবানির পশুর চামড়ার দামে বড় ধরনের ধস নামে। ওই বছর প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার মূল্য দাঁড়ায় ৫০-৫৫ টাকায়, ঢাকার বাইরে ৪০-৪৫ টাকা। ছাগলের চামড়া নামে ২০-২২ টাকায়। ব্যবসায়ীরা আবার তার চেয়েও কম দাম হাঁকান।  

সবচেয়ে শঙ্কার বিষয়টি হচ্ছে সংরক্ষণ ব্যবস্থার ঘাটতিসহ নানা কারণে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ কাঁচা চামড়া নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চামড়া প্রক্রিয়াজাত প্রক্রিয়ায় পরিবেশ দূষণমুক্ত হতে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ থাকলেও সেখানে রয়েছে ব্যর্থতা। সাভারে পরিকল্পনামতো চামড়া শিল্প নগরী গড়ে উঠলেও ইটিপি পরিচালন অব্যবস্থাপনায় সেটা কার্যকারিতা হারিয়েছে। ফলে দেশের অভ্যন্তরে সহজপ্রাপ্যতায়ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে মিলছে না আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। নিজস্ব কাঁচামাল ব্যবহার করে তাই রফতানি পণ্য ও বাজার সম্প্রসারণও সম্ভব হচ্ছে না। এরই ধারাবাহিকতায় এ পণ্যের রফতানি প্রবৃদ্ধি এখন নেতিবাচক। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানিকারকরা ১২২ কোটি ৩৬ লাখ ২০ হাজার ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিশ্ববাজারে রফতানি করেছেন। অথচ তার আগের অর্থবছরেই রফতানি আয় ১২৪ কোটি ডলারের বেশি ছিল।

দেশের ট্যানারিগুলোয় ওয়েট ব্লু, ক্রাশড ও ফিনিশড চামড়া উৎপাদন হয়। কিন্তু উৎপাদিত চামড়া আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এলডব্লিউজি সনদ অর্জন করতে না পারায় তা ইউরোপ-আমেরিকায় রফতানি বা নামি কোনো ব্র্যান্ডের কাছে বিক্রি করতে পারছে না। খুব কম মূল্যে চীন বা অন্য দেশের ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে দেশী চামড়ার পর্যাপ্ত জোগান থাকা সত্ত্বেও রফতানিমুখী চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী দেশীয় শিল্প-কারখানাগুলোকে প্রতি বছর প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার এলডব্লিউজি সনদধারী ফিনিশড লেদার আমদানি করতে হয়। 

অথচ খাতসংশ্লিষ্টরা সবসময়ই বলে আসছেন, দেশের পশুর চামড়ার মান অনেক ভালো। আনুমানিক ২২ বর্গফুট আকারের একটি চামড়া দিয়ে উন্নত মানের ১০ জোড়া জুতা তৈরি করা সম্ভব হয়, যার বাজারমূল্য দাঁড়ায় অন্তত ৫০ হাজার টাকা। ট্যানারি প্রতিষ্ঠানগুলো এলডব্লিউজি সনদ পেলে চামড়া রফতানিতে আরো ভালো করবে বাংলাদেশ। তাই সংশ্লিষ্ট সবার উচিত সুযোগটি যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে এ শিল্পকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া। সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে কাঁচা চামড়ার ব্যবসাকে প্রসারিত করা।  


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন