বাজেট প্রতিক্রিয়া

স্মার্ট বাংলাদেশের দর্শন আছে কিন্তু দর্পণটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না

মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী

ছবি : বণিক বার্তা

নতুন সরকার গঠনের পর এটি প্রথম অর্থবছর। সেই হিসেবে প্রস্তাবিত বাজেটে কাঠামোগত সংস্কার হবে বলে আশা ছিল। এর মধ্যে একটিই ইতিবাচক কাঠামোগত সংস্কার লক্ষ করা যাচ্ছে। সেটি হলো, সরকারি কর্মকর্তাদের সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় আনা হচ্ছে। আর বাজেটের আকার আগের বাজেটের তুলনায় খুব বেশি বড় নয়। কিন্তু বক্তব্যের মধ্যে সরকারের যে পরিকল্পনা ফুটে উঠেছে ডিজিটাল বাংলাদেশ বা স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন, দুর্নীতি দমন, টেকসই উন্নয়ন প্রভৃতি কার্য সম্পাদনের জন্য শক্ত ও সাহসী পদক্ষেপ দরকার ছিল। এসব ক্ষেত্রে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। এর মধ্যে অন্যতম হলো খেলাপি ঋণ যা আরো ৩০ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা বেড়েছে। পাশাপাশি নীতি শিথিল করে ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে ডাউন পেমেন্ট ২ শতাংশ করা হলো। সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ দাঁড়াল ৪ লাখ কোটি টাকা, কেউ কেউ বলছেন ৫ লাখ কোটি টাকা। নতুন সরকারের নতুন বছর হিসেবে এক্ষেত্রে কাঠামোভিত্তিক নীতি গ্রহণের প্রয়োজন ছিল, যা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। বক্তব্যে বলা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু কাঠামোগত সংস্কারের কোনো পরিকল্পনা পলিসিতে স্পষ্ট নয়।

শিক্ষা খাতের বরাদ্দ যদি বিশ্লেষণ করি, শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য কোনো বরাদ্দ নেই। বরং গত বছরের তুলনায় কমেছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে নতুন সিলেবাস সংযোজন করা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে শিক্ষকের প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে প্রযুক্তি ব্যবহারে বিশেষ বরাদ্দ দেখা যাচ্ছে না। যেগুলো দেখা যাচ্ছে, সেগুলো অবকাঠামো ও শিক্ষক সংখ্যা বাড়ানোর জন্য। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন আনা হচ্ছে। তাই বরাদ্দ বাড়ানো ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে শুরু করে ভোকেশনাল ও প্রযুক্তিগত শিক্ষায় যে পরিবর্তন আসা দরকার তার জন্য বাজেটে যে ছাপ থাকা দরকার ছিল তা নেই। শিক্ষার ক্ষেত্রে স্মার্ট বাংলাদেশের দর্শন দর্পণে রূপান্তরিত হয়নি। বলা যায়, স্মার্ট বাংলাদেশের দর্শন আছে কিন্তু দর্পণটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে, কারিগরি শিক্ষায় খাপছাড়াভাবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় কোনো নীতি বা বিনিয়োগ এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে না। শিক্ষায় যে বড় ধরনের উল্লম্ফন দরকার ছিল সে ধরনের কোনো পরিকল্পনার ছাপ দেখা যাচ্ছে না বাজেটে। 

স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই রকম। স্বাস্থ্য খাতে উন্নততর প্রযুক্তি ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি চালানোর মতো অভিজ্ঞ চিকিৎসক, দক্ষ জনশক্তি লাগবে। আমরা উন্নত যন্ত্রপাতি কিনলেও তা চালানোর মতো প্রশিক্ষিত কর্মী পাচ্ছি না। দক্ষ চিকিৎসক ও প্রশিক্ষিত কর্মী তৈরিতে এ খাতেও আরো বরাদ্দ প্রয়োজন ছিল। শিক্ষার মতোই স্বাস্থ্য খাতে আমাদের দর্শন আছে কিন্তু দর্শনের সঙ্গে মিল রেখে পলিসি তৈরি করতে হবে। সেসব পলিসিই দর্শনকে দর্পণে রূপান্তরিত করবে। এক্ষেত্রে পলিসিগুলো বাস্তবায়ন করতে ব্যয় বরাদ্দ করতে হবে এবং তা বাজেটে উল্লেখ করা প্রয়োজন। 

সরকারের আয় বা রাজস্বের বড় একটা অংশ আসছে কর থেকে। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে সরকার রাজস্বের জন্য মোটা দাগে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। মোট করের দুই-তৃতীয়াংশই পরোক্ষ কর এবং তা দেশে ন্যায্যতা সৃষ্টি করে না। আমরা এখনো পরোক্ষ করের দিকেই চেয়ে আছি কিন্তু প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধিতে মনোযোগ নেই। যারা প্রত্যক্ষ কর দিচ্ছি তাদের করহার এদিক-সেদিক করে চালিয়ে নিচ্ছি। প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য যে কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার ছিল তা করছি না। 

গত বাজেটের সঙ্গে এ বাজেটে কাঠামোগত পার্থক্য কম। কোনো জায়গায় বরাদ্দের হার বাড়ানো ও কোনো জায়গায় কমানো হয়েছে। তবে এবারের বাজেটে একটি ক্ষেত্রে সরকার বেশ সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। এমপিদের গাড়ি কেনার শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। এমপিদের কর অবকাশ সুবিধা দেয়া উচিত নয়, সরকার সেটি বুঝতে পেরেছে এবং এ পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ। 

যদিও প্রশাসনের বরাদ্দ অর্থাৎ ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রশাসন বা মন্ত্রণালয় কোনটা রাখা দরকার বা কোনটা দরকার নয় কিংবা কোনগুলো এক করে ফেলা যায় তা যাচাই করা উচিত। অনেক প্রশাসনিক বিভাগ আছে যার তেমন কোনো প্রযোজনয়ীতা নেই। এর পরও সেখানে নিয়োগ দেয়া হয়, প্রমোশনের ব্যবস্থা আছে। প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন যদি করা হতো তাহলে তারা রিভিউ করে দেখতে পারত, কোন বিভাগের আকার কেমন হওয়া উচিত, কোন বিভাগে খরচ বাড়ানো উচিত, কোন তিনটা প্রশাসন বা মন্ত্রণালয়কে একত্রিত করা উচিত? এখন এটি যদি করা না হয় তাহলে প্রশাসনিক ব্যয় তো বছর বছর স্বাভাবিক নিয়মেই বাড়বে। যাদের রাখা হয়েছে তাদের প্রমোশন থেকে শুরু করে অন্যান্য কাজের জন্য ব্যয় বাড়বে। প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনের এগুলো যাচাই-বাছাই না করা গেলে ব্যয় কমানো যাবে না। বিভিন্ন সরকারি দপ্তর কোনটা কতটুকু প্রয়োজন এবং কোনটা অপ্রয়োজনীয় তা নির্ধারণ করার জন্য প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন গঠন করা প্রয়োজন ছিল। 

সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সঙ্গে সঙ্গে রাজস্বনীতি সুসংহতকরণ দরকার। অপচয় কমানো, ব্যয়ের আকার কম রাখা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় অনেকগুলো প্রকল্প রয়েছে যেগুলো সময়সীমা পেরিয়ে গেছে এবং একই সঙ্গে ব্যয়সীমাও বেড়েছে। এ মুহূর্তে মেগা প্রজেক্টের বিনিয়োগগুলোও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে নিয়ে আসা দরকার। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে কিন্তু অধিকাংশ কর্মসূচিতেই চার বছর ধরে ভাতার হার অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। যেমন বয়স্ক ভাতা। গত কয়েক বছরের গড় মূল্যস্ফীতি যদি ৭ শতাংশ ধরা হয় তাহলে ৫০০ টাকার সঙ্গে আরো ৩০০ টাকা যুক্ত হওয়ার কথা ছিল। এখন দরকার সুবিধাভোগীর সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রতি ভাতার পরিমাণও বাড়ানো। মুদ্রানীতির সংকোচন ও রাজস্বনীতির সমন্বয় যদি একই সঙ্গে না হয় তাহলে মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে মুদ্রানীতি দিয়ে আসলে মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো যাবে না। এটা আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যের মতো অর্থনীতিতে হয়। বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হয়তো সেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। কিন্তু আমাদের মতো দেশে এ টুলসগুলো পুরোপুরি কাজ করে না। 

সরবরাহ প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখতে বাজেটে কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। বর্তমানে বাজার যে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে এটা সবার সামনেই স্পষ্ট। বাজারকে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার জন্য যে রেগুলেটরি পদক্ষেপ দরকার—সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা পাওয়া গেল না। মোটাদাগে যেটা বোঝা যাচ্ছে, মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেয়া হয়েছে। রাজস্ব বাজেটের আকার একটু ছোট করা হয়েছে। কিন্তু সরবরাহ চ্যানেলে সিন্ডিকেটের যে সমস্যা রয়েছে সেই সিন্ডিকেটের জন্য কী করা হবে সেই বিষয়ে পরিষ্কার কোনো বার্তা পাওয়া যায়নি। কাজেই সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি কতটুকু নিয়ন্ত্রণে আসবে তা বলা যাচ্ছে না। 

চাল ও গমের প্রকিউরমেন্টে বাজেট কমলেও তা নিয়ে উদ্বেগের কিছু দেখছি না। তবে বেসরকারি প্রকিউরমেন্ট রেগুলেটরি পরিবেশে রেখে সিন্ডিকেশন না করে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। গুটিকয়েক সিন্ডিকেটের হাতে না রেখে আমদানিকারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বাজারের সঙ্গে সংযোগ রাখবে এবং রেগুলেটরি একটি পরিবেশ তৈরি হবে। এভাবেই ভালো মনে করি। সরকারি প্রকিউরমেন্টে সবসময় অপচয় (সিস্টেম লস) হয়। বাজেটে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে আমি কোনো নির্দেশনা দেখছি না। 

আমাদের পরিচালন ব্যয়ের বাজেটের সক্ষমতা সবসময় স্বাভাবিক থাকে। কারণ পরিচালন ব্যয়ের বাজেটে বেতন-ভাতা, পেনশন ও সাপ্লাই সার্ভিস স্বাভাবিকভাবেই হয়ে যায়। যখন কোনো প্রকল্প নেয়া হয় তখন সেই প্রকল্পের বাস্তবায়নযোগ্যতা যাচাই করা হয়। বাস্তবায়নযোগ্যতা যাচাইয়ের সময়ে ব্যয় নির্ধারণ ও প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়। মোট ব্যয় নির্ধারণ করে তা বাজেটে রাখার বিষয়ে প্রক্রিয়াগত বিষয় সম্পর্কিত থাকে। এ প্রক্রিয়াগত সম্পর্কের সময়ে একটি ব্যবধান থাকে। এ ব্যবধান যদি না কমানো হয় তাহলে সময় ও ব্যয় বেশি হবে। তখন বিনিয়োগ ও অর্থ ব্যয়ের তুলনায় অর্থনীতিতে কম প্রভাব পড়বে। এ ব্যবধান যতদিন থাকবে ততদিন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে তেমন কোনো প্রভাব রাখবে না।

আমাদের বাজেটের আরেকটা দিক মিসিং হচ্ছে, এভিডেন্স বেজড ইভালুয়েশন (প্রমাণ সাপেক্ষ মূল্যায়ন)। যেমন ফ্যামিলি কার্ড ও কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করা হয়েছে কিন্তু সেগুলো কেমন ফল দিচ্ছে তা পর্যালোচনা দরকার। অনেক দরিদ্র পরিবারকে সরকার প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল দিচ্ছে। দারিদ্র্য বিমোচন ও সেবা বিস্তারের ক্ষেত্রে এগুলো নিঃসন্দেহে খুব ভালো উদ্যোগ। কিন্তু প্রতিটি উদ্যোগের সঙ্গেই প্রমাণ সাপেক্ষ আলোচনা দরকার। এগুলো যাদের দেয়া হচ্ছে তাদের কাছে পৌঁছছে কিনা, তাদের জীবনযাত্রার পরিবর্তন হচ্ছে কিনা—এসবের জন্য নিয়মতান্ত্রিক এভিডেন্স বেজড ফিডব্যাক দরকার। কিন্তু এই ফিডব্যাক বা পর্যালোচনা আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত। এই ফিডব্যাক থাকলে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়ে ভবিষ্যতে কর্মসূচিগুলো নতুন করে সাজানো যায়। কমিউনিটি ক্লিনিক, ফ্যামিলি কার্ডের কথাই যদি বলি সেগুলো আসলে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে কী প্রভাব পড়ছে সেই বিষয়ে আমাদের প্রমাণ সাপেক্ষে মূল্যায়ন দরকার। এই ফিডব্যাক নিয়ে পলিসিকে নতুন করে সাজানোর সংস্কৃতি নেই আমাদের। এ জায়গাটা নিয়ে আমাদের ভাবনা-চিন্তা দরকার। প্রতি বছরই আমরা গতানুগতিক বাজেট করছি। দেখা গেছে, বছর শেষে বাজেটের বরাদ্দ খরচ হচ্ছে না। প্রতি বছরই আমাদের বাজেটে প্রায় ৫ শতাংশ ঘাটতি হচ্ছে। যে উদ্দেশ্যে বাজেট করা হয়েছিল সেই উদ্দেশ্য সম্পাদন করে যদি বাজেট ঘাটতি কমে তাহলে সেটা ভালো। কিন্তু আমি এটা ব্যয়ই করতে পারলাম না, এ কারণে ঘাটতি কমল তাহলে কিন্তু তা অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। 

সরকারের ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রত্যাশা ২৭ শতাংশ। বর্তমানে তা ২৩ শতাংশ আছে। বেসরকারি বিনিয়োগ ৪ শতাংশ বাড়ানোর জন্য ফিক্সড ফাইন্যান্সিং লাগবে। এ বছর বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৯ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় কম। তাহলে এটি সঠিকভাবে মেলানো যাচ্ছে না। ৪ শতাংশ যদি বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো হয়, তাহলে ঋণের প্রবৃদ্ধিও (ক্রেডিট গ্রোথ) লাগবে। অথচ ব্যাংক খাত থেকে সবচেয়ে বড় ঋণ গ্রহীতা এখন সরকার। কারণ অভ্যন্তরীণ ঋণের অধিকাংশ ঋণই কিন্তু ব্যাংক খাত থেকে এসেছে। ব্যাংক খাত থেকে যদি সরকার ঋণ নেয় এবং ওই দিক থেকে যদি ২৭ শতাংশ বেসরকারি বিনিয়োগ এবং ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয় এবং এখন বলা হচ্ছে ঋণের প্রবৃদ্ধি হবে ৯ শতাংশ, সেক্ষেত্রে তো হিসাব মিলছে না। কাজেই ক্রাউডিং-আউট-ইফেক্টস হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ক্রাউডিং-আউট-ইফেক্টস হলে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৩ শতাংশ ধরে রাখা মুশকিল হবে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হলো বেসরকারি খাত। কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা ধরেই ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হচ্ছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না বাড়লে তো কর্মসংস্থান স্বাভাবিকভাবেই হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ সরকারি খাত তো এত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারবে না। 

প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে যারা করজালের বাইরে ছিল তাদের যুক্ত করা দরকার ছিল। প্রদর্শিত আয়ের চেয়ে অপ্রদর্শিত আয়ের কর যদি কম হয় তাহলে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হবে। সরকার এতে তেমন লাভবান হবে না। অতীতেও দেখা গেছে, এ পথে সবাই ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করবে এমনটা হয়নি। বরং এ সুযোগের কারণে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হবে। তাই আমার কাছে মনে হয়নি এটি অর্থনৈতিকভাবে ভালো কাজ হয়েছে। 

বাজেটে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণেও প্রয়োজনীয় প্রণোদনা নেই। সরকারের প্রত্যাশা, নতুন অর্থবছরে ৩ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ বাড়বে। কিন্তু কীভাবে বাড়বে যদি চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট সারপ্লাস) না থাকে? রিজার্ভ বৃদ্ধির একমাত্র রাস্তা আর্থিক হিসাব (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট)। এফডিআই না এলে আর্থিক হিসাব শক্তিশালী হবে কী করে? আমরা এফডিআই হিসেবে যা গণ্য করছি তা বেশির ভাগই পুনর্বিনিয়োগ। পোর্টফলিও বিনিয়োগ হিসেবে যা এসেছিল তা তুলে নিয়ে গেছেন বিনিয়োগকারীরা। বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতার কারণে তারা এমনটা করেছে। সব মিলিয়ে একটা ফিগারের সঙ্গে অন্যগুলো মেলানো যাচ্ছে না। আমরা যদি ৩ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ বাড়াতে চাই তাহলে এফডিআই বাড়াতে হবে। কিন্তু এফডিআইয়ের জন্য যে স্থিতিশীলতা দরকার, ব্যবসায় পরিবেশ দরকার সেটা আমাদের নেই। এ পরিস্থিতিতে যতটুকু বিনিয়োগ হচ্ছে সেগুলো পুনর্বিনিয়োগ। আমার মনে হয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেকে না চাইলেও পুনর্বিনিয়োগ করছে। কারণ কিছু নন-ট্যারিফ প্রতিবন্ধকতার কারণে তারা তাদের মুনাফা দেশে নিয়ে যেতে পারছে না। রেমিট্যান্স ও রফতানিতে এক ধরনের শ্লথগতি আছে, তাই রিজার্ভ বৃদ্ধিতে এফডিআই সহায়ক হতে পারত। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আইএমএফের চাপ থাকলেও কীভাবে ৩ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ বৃদ্ধি করা হবে তা স্পষ্ট নয়। 

মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী: সাবেক অর্থ সচিব ও সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন