এশিয়ায় বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষকের বেতন সর্বনিম্ন

প্রাথমিক শিক্ষকের বেতন ও সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

শিক্ষাকে কার্যকর ও মানসম্মত করার বুনিয়াদ প্রাথমিক শিক্ষা। একটি শিশুর আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় হাতেখড়ি হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বিশ্বের উন্নত দেশে প্রাথমিক শিক্ষকের বেতন ও মর্যাদা তাই সবচেয়ে বেশি। শিক্ষকদের রাষ্ট্রীয় সম্মানের পাশাপাশি বেতনও দেয়া হয় উচ্চতর স্কেলে। এছাড়া অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। সেই তুলনায় বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ও মর্যাদা এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। বণিক বার্তার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতনের পরিমাণের দিক থেকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৫তম আর দক্ষিণ এশিয়ায় সপ্তম। এ দেশের প্রাথমিকের শিক্ষকদের গড় বেতন ১৭০ ডলার ২ সেন্ট, যা দেশের মাথাপিছু গড় মাসিক আয়ের তুলনায় প্রায় ৬২ ডলার কম।

দেশে সাক্ষরতার হার বাড়লেও শিক্ষার মান বাড়েনি। প্রাথমিকের ১১ বছরে বাংলাদেশের শিশুরা যা শেখে, তা অন্য দেশের শিশুরা শিখছে সাড়ে ছয় বছরে। শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের বিকল্প নেই। মানহীন শিক্ষা শিক্ষকের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠায়। গত বছর প্রকাশিত জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির (নেপ) এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় মোট শিক্ষকের সংখ্যা ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫। এর মধ্যে ৩১ দশমিক ৩ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি ও এইচএসসি পর্যন্ত। নিয়মিত ক্লাস নিলেও এ শিক্ষকদের একটি বড় অংশই নিজেদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান নিয়ে সন্তুষ্ট নন। নিজেদের জ্ঞানের বিষয়ে তাদের আত্মবিশ্বাস নেই। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে ভালো শিক্ষা থেকে। বলা বাহুল্য, প্রাথমিকে ভালো শিক্ষক না থাকায় মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে না। এখানে অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি চলে আসে—কেন প্রাথমিকে ভালো শিক্ষক নেই? এর পেছনে অন্যতম কারণ দেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের নিম্ন বেতন কাঠমো এবং সামাজিক মর্যাদার অভাব। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা প্রসঙ্গে ভার্কি ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় বলা হয়, এশিয়ার দেশগুলোর সমাজ কাঠামোয় বিশেষ করে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরে শিক্ষকদের বৃহৎ সম্মানের চোখে দেখা হয়। অপর্যাপ্ত বেতন, সামাজিক মর্যাদা ও অন্যান্য পেশার তুলনায় কম সুযোগ-সুবিধা থাকায় প্রাথমিক শিক্ষক পেশাটিকে আকর্ষণীয় মনে হয় না মেধাবী ও উচ্চ শিক্ষিতদের কাছে। ফলে শিক্ষক সংকট তো থাকছেই, শিক্ষার মানও নিশ্চিত হচ্ছে না। প্রাথমিক শিক্ষায় এসব সংকট দূর করতে হলে শিক্ষকের বেতন ও মর্যাদা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে। তবেই যোগ্যতাসম্পন্নরা এ পেশায় আসতে ও থেকে যেতে আগ্রহী হবেন। 

বর্তমানে দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা ১৩তম গ্রেডে বেতন পান। এ গ্রেড অনুযায়ী তাদের মূল বেতন ১১ হাজার টাকা এবং বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ সর্বসাকল্যে পান সাড়ে ১৯ হাজার টাকার মতো। শিক্ষককে যদি পর্যাপ্ত বেতন ও সঠিক মর্যাদা দেয়া না হয় তাহলে শিক্ষাদান তার কাছে কেবলই অন্তঃসারশূন্য দায়িত্ব মনে হতে পারে। এক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত যথার্থ বিনিয়োগ ছাড়া সুফল পাওয়া যায় না। একজন দায়িত্বশীল শিক্ষক শিক্ষার্থী, সমাজ ও দেশকে পরিবর্তন করার সামর্থ্য রাখেন। আর দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি করতে হলে শিক্ষকদের চাহিদা পূরণ বাঞ্ছনীয়। মেধাবীদের এ পেশার প্রতি আকৃষ্ট করতে বা ধরে রাখতে হলে সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে হবে; দেশ-বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণের সুযোগ দিতে হবে যাতে তারা নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষ হয়ে উঠতে পারে ও আত্মবিশ্বাসী হয়।

লুক্সেমবার্গ, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এবং বেশি বেতনের চাকরিগুলোর একটি। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউর তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতনের দিক থেকে বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে লুক্সেমবার্গ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জার্মানি। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সুইজারল্যান্ড। দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে সিঙ্গাপুর। এসব দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।

প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে এ স্তরে যোগ্য শিক্ষক আবশ্যক। এজন্য বেতন ও সামাজিক মর্যাদা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো নেই। দীর্ঘদিন ধরে তারা আন্দোলনও করছেন। গত কয়েক বছরে চীন, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়াসহ এশিয়ার অধিকাংশ দেশই প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতনসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রায় দ্বিগুণ করেছে। সেখানে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য কোনো নজির নেই। তাদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো নিশ্চিতের মাধ্যমে বেতন বাড়ানো এখন সময়ের দাবি বলা যায়। এমন শিক্ষার মান নিয়ে উন্নত বিশ্বে রূপান্তর হওয়া অনেকটা অলীক কল্পনার মতো শোনাবে। পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগও তৈরি করতে হবে। শিক্ষকতার পেশা থেকে পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। তারা যেন অধিদপ্তরে যেতে পারে—সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবেই প্রশিক্ষিত ও দক্ষদের এ পেশায় আকৃষ্ট করা যাবে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ মানসম্মত শিক্ষা ও শিক্ষক। এজন্য আমাদের বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। ইউনেস্কোর তথ্যমতে, একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। ২০২১-২২ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল মোট জিডিপির ২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। পরের অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশে। ২০২২ সালে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) উপস্থাপিত হিসাবমতে, ২০১৬-২২ সময়ে বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে গড় ব্যয় ছিল ৪১টি স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে পঞ্চম সর্বনিম্ন। জিডিপির শতাংশীয় হিসেবে বাংলাদেশের গড় শিক্ষা ব্যয় আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার চেয়ে কম। অর্থাৎ আসন্ন বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন।

মানসম্মত শিক্ষার অন্যতম উপাদান হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষক। এ কারণে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত জরুরি। যোগ্যতা ও অবদান অনুযায়ী শিক্ষকদেরও মূল্যায়ন হওয়া উচিত। নয়তো কেবল বেতন বৃদ্ধিতেই এ সমস্যার সুরাহা হবে না। প্রাথমিক শিক্ষার মান বাড়াতে শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়ানোর ব্যাপারেও মনোযোগী হতে হবে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন