দেশের ব্যাংক ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২,৩৩৫ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড

হাছান আদনান

ছবি : বণিক বার্তা

দেশের ব্যাংক খাতের ইতিহাসে সর্বোচ্চ নিট মুনাফা করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড। ২০২৩ সালে ব্যাংকটির বাংলাদেশ অফিসের নিট মুনাফার পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এর আগের বছর করেছিল ১ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত বছর ব্যাংকটির নিট মুনাফা বেড়েছে ৪১ শতাংশেরও বেশি। ২০২১ সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ৭৫৮ কোটি টাকার নিট মুনাফায় ছিল।

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড মাত্র ১৮টি শাখা ও একটি ইসলামিক ব্যাংকিং উইন্ডো নিয়ে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ২০২৩ সাল শেষে ব্যাংকটির মোট সম্পদ ও দায়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। বিতরণকৃত ঋণস্থিতি ৩০ হাজার কোটি টাকারও কম। এ পরিমাণ পোর্টফোলিও নিয়েও দেশের সবচেয়ে বেশি নিট মুনাফা করে আসছে ব্যাংকটি। 

দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির সম্পদ ও দায়ের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এত বৃহৎ কার্যক্রম নিয়েও ব্যাংকটির নিট মুনাফা ৬০০ কোটি টাকার গণ্ডি পেরোতে পারেনি। দেশী ব্যাংকগুলোর মধ্যে এটি ২০২২ সালে সর্বোচ্চ নিট মুনাফা করলেও তার পরিমাণ ছিল মাত্র ৬১৬ কোটি টাকা। একই বছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬১২ কোটি টাকা নিট মুনাফায় ছিল ব্র্যাক ব্যাংক। আর ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ৫৬৬ কোটি টাকা নিট মুনাফা করে তৃতীয় স্থানে ছিল।

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের বাংলাদেশ অফিস গতকাল ২০২৩ সালের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, সুদ খাত থেকে ব্যাংকটির আয় আগের বছরের তুলনায় গত বছর বেড়েছে ৫৮ শতাংশ। ২০২২ সালে এ খাত থেকে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের নিট আয় ছিল ১ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। গত বছর তা ২ হাজার ১৮ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ থেকেও ব্যাংকটির আয় বেশ বেড়েছে। ২০২২ সালে এ খাত থেকে ৭৩৫ কোটি টাকা আয় করলেও গত বছর তা ১ হাজার ২২৪ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। তবে গত বছর কমিশন, এক্সচেঞ্জ ও ব্রোকারেজ থেকে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের আয় কিছুটা কমেছে। ২০২২ সালে এ খাত থেকে ১ হাজার ৩৭ কোটি টাকা আয় করলেও গত বছর তা ১ হাজার ২৪ কোটি টাকায় নেমে আসে। সব মিলিয়ে ২০২৩ সালে ৪ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা পরিচালন আয় করেছে ব্যাংকটি। এর আগের বছর স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের পরিচালন আয় ছিল ৩ হাজার ৫০ কোটি টাকা।

পরিচালন আয় অস্বাভাবিক হারে বাড়লেও ব্যয় নিয়ন্ত্রিত রাখতে পেরেছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড। ২০২২ সালে ব্যাংকটির পরিচালন ব্যয় ছিল ৭৯২ কোটি টাকা। গত বছর এ খাতে ব্যয় করেছে ৮৩০ কোটি টাকা। আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে ব্যাংকটি ৩ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা পায়। এ থেকে সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ ও কর পরিশোধের পর নিট মুনাফা করেছে ২ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। 

বহুজাতিক ব্যাংকটির বিনিয়োগের বিপরীতে গত বছর আয়ের (আরওআই) অনুপাত ছিল ২০ দশমিক ৯১ শতাংশ। আর সম্পদের বিপরীতে আয় (আরওএ) হয়েছে ৪ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। যদিও দেশের ব্যাংকগুলো গুরুত্বপূর্ণ এ দুই সূচকে খুবই নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে। দেশের সবচেয়ে ভালো বেসরকারি ব্যাংকের আরওআই ৬ শতাংশেরও নিচে। আরওএর ক্ষেত্রে এ হার সর্বোচ্চ ২ শতাংশের ঘরে।

এ বিষয়ে দেশের ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি আনিস এ খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো স্বল্প সুদের আমানত। ধনিক শ্রেণীর ব্যক্তিরা লাভের প্রত্যাশা ছাড়াই ব্যাংকটিতে টাকা ফেলে রাখে। এক্ষেত্রে ব্যাংকটির সুনামই হলো সবচেয়ে বড় সম্পদ। গ্রাহকরা মনে করেন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডে টাকা রাখলে নিশ্চিন্তে থাকা যাবে। ধনিক শ্রেণী ছাড়াও বিদেশী ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকটির গ্রাহক। এ কারণে তাদের আমানতের সুদহার সর্বনিম্ন। সর্বোচ্চ স্প্রেডে ব্যাংকটি গ্রাহকদের ঋণ দিতে পারে।’ 

দেশে সরকারি বিল-বন্ডের সুদহার এখন সর্বোচ্চ মাত্রায় রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড। ব্যাংকটি তাদের সর্বনিম্ন সুদের তহবিল দিয়ে সর্বোচ্চ সুদের সরকারি সিকিউরিটিজ কিনছে। এতে বিনিয়োগ খাতের আয়ও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। তাছাড়া খেলাপি ঋণ কম হওয়ায় সঞ্চিতি সংরক্ষণের তেমন কোনো চাপও নেই।’

এ ব্যাংকারের বক্তব্যের সত্যতা দেখা যাচ্ছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের আর্থিক প্রতিবেদনেও। বহুজাতিক ব্যাংকটির আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস সুদ খাত। গত বছর এ খাত থেকে ২ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা আয় করেছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড। বিপরীতে আমানতকারীদের সুদ পরিশোধ করেছে মাত্র ৩৪৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে এ খাত থেকে ব্যাংকটির নিট সুদ আয় দাঁড়ায় ২ হাজার ১৮ কোটি টাকায়। মূলত গ্রাহকদের জমাকৃত আমানতের বিপরীতে নামমাত্র সুদ পরিশোধ করে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সঞ্চয়ী হিসাবের বিপরীতে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড দশমিক শূন্য ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ পর্যন্ত সুদ পরিশোধ করে। আর তিন মাস মেয়াদি আমানতের ক্ষেত্রে ব্যাংকটির সুদহার ১ থেকে ৩ শতাংশ। আমানতের মেয়াদ বেশি হলে এ সুদহার আরো কমে যায়, যেখানে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো তিন মাস মেয়াদি আমানতের ক্ষেত্রে পরিশোধ করছে ১০ শতাংশের বেশি সুদ। মেয়াদ বাড়লে আরো বেশি সুদ গুনতে হচ্ছে।

দেশে ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্প্রেড (আমানত ও ঋণের সুদহারের ব্যবধান) স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের। বর্তমানে ব্যাংকটির স্প্রেড ৮ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। আমানতের গড় সুদহার শূন্য দশমিক ৫২ শতাংশ হলেও বিতরণকৃত ঋণের গড় সুদ ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ। 

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর শেষে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ২৯ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৮ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা ছিল ঋণ, ক্যাশ ক্রেডিট ও ওভারড্রাফট। আর বিল ক্রয় ও ডিসকাউন্ট ছিল ১০ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা। সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড। গত বছর শেষে এ ধরনের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বহুজাতিক ব্যাংকটির বাংলাদেশ অফিসের সম্পদের পরিমাণ ৬০ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। ব্যাংকটিতে গ্রাহকদের আমানত জমা রয়েছে ৪১ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। গত বছর পর্যন্ত স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের ক্রমপুঞ্জীভূত মুনাফার পরিমাণ ১০ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। এ অর্থ ইকুইটি হিসেবে বিনিয়োগ করেছে ব্যাংকটি।

জানতে চাইলে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নাসের এজাজ বিজয় বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০২৩ সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের আর্থিক ফলাফলের স্তম্ভ হলো ক্লায়েন্টদের সাফল্য, সুশাসন এবং উন্নত আর্থিক সমাধান। বিচক্ষণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, তারল্যতার সুব্যবহার, উন্নত অর্থায়ন, গ্রাহক, সহকর্মী, নিয়ন্ত্রক এবং অন্য স্টেকহোল্ডারদের সমর্থনে একটি চ্যালেঞ্জিং বছরে ভালো ফলাফল অর্জনে সাহায্য করেছে। গত বছর আমাদের ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার আমানত ও ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ বেড়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের ক্যাপিটাল বেইস আর্থিক খাতে সর্বোচ্চ (১১ হাজার কোটি টাকার বেশি) এবং মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত (সিআরএআর) নিয়ন্ত্রক প্রয়োজনীয়তা এবং আর্থিক খাতের গড়ের চেয়ে তিন গুণ বেশি। আমাদের মজবুত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ফলে খেলাপি ঋণ (এনপিএল) অনুপাত কমেছে। আগামীতে সামাজিক দায়িত্বে আমাদের বিনিয়োগ কার্যক্রম আরো সুদূরপ্রসারিত হবে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থা, কৃষি উদ্ভাবন, খেলাধুলার  মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা এগিয়ে যাব।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন