বড় করপোরেটদের ভাঙন উদ্বেগে ব্যাংকাররা

বদরুল আলম

ছবি : বণিক বার্তা

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের বিভিন্ন বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের ভাঙন ঘটেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, প্রথম প্রজন্মের গড়ে তোলা পারিবারিক ব্যবসা দ্বিতীয় প্রজন্মে এসে অংশীদারদের দ্বন্দ্বে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। কখনো কখনো তা আদালতেও গড়াচ্ছে। প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তার উত্তরাধিকারীরা একে অন্যের বিরুদ্ধে মামলা করছেন। দ্বন্দ্বের মুখে পুরনো প্রতিষ্ঠান ভেঙে তৈরি হচ্ছে ভিন্ন প্রতিষ্ঠান। আবার কিছু ক্ষেত্রে বিভক্তির আগেই গোটা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় অংশীদারদের দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়ছে। হুমকিতে পড়ছে প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক সক্ষমতা।

বৃহৎ এসব প্রতিষ্ঠান দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের বড় গ্রাহক হিসেবে ব্যবসা চালিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। কোনো কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানের নানা ব্যবসায় ব্যাংকগুলোর বড় অংকের ঋণ অর্থায়নও রয়েছে। ব্যাংকাররা বলছেন, ভাঙনে কোম্পানিগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক সক্ষমতা হুমকির মুখে পড়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছেন তারা।

বাংলাদেশে তৃতীয় প্রজন্মের হাতে ব্যবসা পরিচালনার ভার যাওয়ার ঘটনা খুব বেশি না। এ ধরনের ব্যবসার একটি বড় উদাহরণ পঞ্চাশের দশকের শেষ ভাগে স্যামসন এইচ চৌধুরীর উদ্যোগে যাত্রা শুরু করা স্কয়ার। ওষুধ, বস্ত্র খাত, টয়লেট্রিজ পণ্য উৎপাদন, গণমাধ্যমসহ স্কয়ারের বিনিয়োগের গণ্ডি এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়েছে। ২০১২ সালে প্রয়াণ হয় স্যামসন এইচ চৌধুরীর। এরপর গত এক দশকে স্কয়ার গ্রুপের ব্যবসার আকার বেড়েছে বহু গুণ। কর্মী সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৬৫ হাজার। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে স্কয়ার গ্রুপের বার্ষিক টার্নওভার ছিল প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে সম্প্রসারণের পর প্রতিষ্ঠানটিতে এখন তৃতীয় প্রজন্ম যুক্ত হয়েছে।

এ বিষয়ে স্কয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠান স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেসব কোম্পানি কাঠামোর মধ্যে আসতে পারেনি, পেশাদারদের দিয়ে ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলেনি; সেসব কোম্পানির ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ পরিস্থিতি অনস্বীকার্য। যতই পারিবারিক ব্যবসা হোক, একটা পর্যায়ে এসে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলতে হয়। মালিকের সন্তান হলেই প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে আসার বিশেষত্ব থাকবে এমনটা ধরে নেয়ার কোনো কারণ নেই। যথাযথ যোগ্যতার সঙ্গে অভিজ্ঞতাটাও জরুরি। আমাদের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে; যারা এখানেই পেশাদার হিসেবে বেড়ে উঠেছেন, তাদের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের গ্রুপের ভিন্ন খাতের সব প্রতিষ্ঠানই পেশাদারদের দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গেও তারা গভীরভাবে সম্পৃক্ত। কাঠামোটি এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যে গুরুত্বপূর্ণ ওই পেশাদারদের অবর্তমানেও প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া যথাযথভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। এখন তাদের কাছ থেকে আমাদের পরিবারের সন্তানরা শিখছে, একসঙ্গে কাজ করছে। পরিবারের জ্যেষ্ঠদের থেকে শেখার সুযোগ থাকলেও তারা প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন শিখছে পেশাদারের কাছ থেকে। এটা আমাদের একটা বড় শক্তির ক্ষেত্র।’

দ্বিতীয় প্রজন্মের বিরোধ বা দ্বন্দ্বের মধ্যেও প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার সম্ভাব্য পদক্ষেপ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‌এক্ষেত্রে বিষয়টি এক ধরনের বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পন্ন করার সুযোগ রয়েছে, যাকে বলা হয় ফ্যামিলি ল অফিস। এদের মাধ্যমে কিছু যোগ্যতা নিশ্চিত করা ছাড়া পরিবারের সদস্যরা পারিবারিক ব্যবসায় যুক্ত হতে পারেন না। তারা হয়তো শেয়ারহোল্ডার, কিন্তু যোগ্যতা না থাকলে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট হতে দেয়া হয় না।’ 

দেশের বৃহৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সিংহভাগই পারিবারিক ব্যবসা। এ ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় সবই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যু বা অবসর গ্রহণের পর এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরের সময় নানা জটিলতা তৈরি করে দিচ্ছে। ঐক্য ধরে রেখে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারছেন না উত্তরাধিকারীরা। 

দেশের বৃহৎ শিল্প গ্রুপ আকিজ গ্রুপ ব্যবসা পরিচালনা করছে ৭৫ বছরের বেশি সময় ধরে। দ্বিতীয় প্রজন্মে এসে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসার কর্তৃত্ব নিয়ে ভাইদের মধ্যে কয়েক বছর আগে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এর এক পর্যায়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব মীমাংসার লক্ষ্যে ব্যবসার সম্পদ মূল্যায়ন করেন তারা। নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব ও বিভিন্ন ব্যবসার কর্তৃত্ব বণ্টন করে নেন। যে ব্যবসায় নগদ অর্থপ্রবাহ সবচেয়ে বেশি ছিল, সেটিই বিক্রি করে দিয়েছেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির নির্মাণসামগ্রী, দুগ্ধপণ্য, পানীয়, কাগজ, এলপিজিসহ নানা খাতে ব্যবসা রয়েছে। পাশাপাশি সম্ভাবনাময় খাতে নতুন বিনিয়োগও করেছে তারা।

দেশের অন্যতম প্রভাবশালী পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ট্রান্সকম গ্রুপের ব্যবসা শুরু হয়েছিল চা দিয়ে। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি নতুন রূপে যাত্রা শুরু করে। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন পণ্য বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় ব্যবসা। বর্তমানে বাংলাদেশে হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্যের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এটি। ওষুধ পণ্য উৎপাদনে বিশ্ববাজারেও স্বীকৃতি পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বিনিয়োগ সম্প্রসারণ হয়েছিল গণমাধ্যমেও। ট্রান্সকমের প্রতিষ্ঠাতার প্রয়াণ ঘটে ২০২০ সালে। তিনি মারা যাওয়ার তিন বছরের মধ্যেই দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে জটিলতার গুঞ্জন ওঠে। অতিসম্প্রতি তা মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছে। 

ইউনাইটেড গ্রুপ ১৯৭৮ সালে যাত্রা করে এখন দেশের অন্যতম প্রধান শিল্পগোষ্ঠী। শুরুতে প্রতিষ্ঠানের মূল কার্যক্রম ছিল ট্রেডিং ব্যবসা। শুরুতে চার, পরে আরো দুই বন্ধুর অংশীদারত্বে ব্যবসা ধীরে ধীরে বড় হয়েছে। বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎ খাতের অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপ। প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তা বন্ধুরা যতদিন ব্যবসা পরিচালনায় নিয়োজিত ছিলেন ততদিন গ্রুপটিতে বড় কোনো জটিলতা ছিল না। 

জটিলতা দেখা দেয় ব্যবসা পরিচালনার ভার মূল অংশীদারদের উত্তরসূরিদের হাতে যাওয়ার পর। গ্রুপটিতে যুক্ত ছিলেন ছয় বন্ধুর ১০ সন্তান। দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে ব্যবসা পরিচালনা নিয়ে রয়েছে ভিন্ন মত। বিষয়টি সম্প্রতি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। 

দুই অংশীদারের উদ্যোগে ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠা হয় এনভয় গ্রুপের পোশাক কারখানা। কালক্রমে এ ব্যবসা সম্প্রসারণ হয়েছে বস্ত্র ও পোশাক, আবাসনসহ বিভিন্ন খাতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রুপটির ব্যবসা বেড়েছে। দুই কাণ্ডারির প্রচেষ্টায় গ্রুপের বার্ষিক টার্নওভার এক সময় ৪০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়।

ব্যাপ্তি বাড়ার এক পর্যায়ে প্রধান দুই কর্ণধারের সন্তানরা ব্যবসায় যুক্ত হন। দ্বিতীয় প্রজন্ম যুক্ত হওয়ার পর ব্যবসার বৈচিত্র্যও বাড়তে শুরু করে। এক পর্যায়ে প্রথম প্রজন্ম দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে ব্যবসার মূল নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয়ার প্রক্রিয়াও শুরু করে দেয়। কিন্তু দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে ব্যবসার কর্তৃত্ব ও ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে তা এক পর্যায়ে আদালত পর্যন্ত গড়ায়। 

এক যুগের বেশি সময় ধরে সিকদার পরিবারের একচ্ছত্র কর্তৃত্বে পরিচালিত হয়েছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড। কিন্তু জয়নুল হক সিকদারের মৃত্যুর পর সে কর্তৃত্ব ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। 

জয়নুল হক সিকদার সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। ওই সময় পর্যন্ত প্রায় এক যুগ ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। এর পর ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন তার স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার। মূলত এ দম্পতির সন্তানদের বিরোধের কারণেই মনোয়ারা সিকদার ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তবে মনোয়ারা সিকদার চেয়ারম্যান হলেও ব্যাংক পরিচালনায় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদারের হাতে। এ নিয়ে ভাইদের সঙ্গে বিরোধে জড়ান পারভীন হক সিকদার। শেষ পর্যন্ত এ বিরোধ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। গত বছরের শেষের দিকে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈশ্বিক ও স্থানীয় দুই প্রেক্ষাপটেই এখন পারিবারিক ব্যবসায় নেতৃত্ব হস্তান্তর, উত্তরাধিকার পরিকল্পনা, সম্পদ ব্যবস্থাপনা, পারিবারিক সম্পর্ক ও পেশাজীবীদের ভূমিকার মতো বিষয়গুলো বড় প্রভাবক হয়ে উঠেছে। এ ধরনের ব্যবসা দ্বিতীয় প্রজন্মে এসে টেকসই না হওয়ার পেছনে এসব বিষয়ের বাইরে আরো কিছু প্রভাবক দেখা যাচ্ছে। যেমন প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তার জীবনাবসান ছাড়াও উত্তরাধিকারদের এক অংশের অনাগ্রহ ও পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যদের ব্যবসার সঙ্গে বিভিন্ন মাত্রার সংশ্লিষ্টতাও এগুলোয় ভাঙন ধরার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। 

পারিবারিক ব্যবসা বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ বলেন, ‘‌দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছে যখন ব্যবসার কর্তৃত্ব যায়, তার বাবা যেভাবে ব্যবসা গড়ে তুলেছিল, সেগুলো না জানার কারণে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যায়। আবার তারা কিছুসংখ্যক লোকের ওপর নির্ভরশীলও হয়ে পড়ে। এসব কারণে পর্ষদ যদি শক্তিশালী করা না যায়, পর্ষদে যদি পেশাদার অন্তর্ভুক্ত করা না হয়, তাহলে পারিবারিক ব্যবসা হোক বা অন্যান্য ব্যবসা; সুশাসন পরিস্থিতি কোনোদিন উন্নত হবে না।’

দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে এসে বৃহৎ করপোরেটগুলোর ব্যবসায় ভাঙনের প্রবণতা এখন উদ্বিগ্ন করে তুলছে ব্যাংকারদের। তাদের ভাষ্যমতে, বড় গ্রুপগুলোয় ব্যাংকগুলোর বড় অর্থায়ন রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ঋণ অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকারদের সবচেয়ে বড় বিবেচ্য বিষয় হলো ‘‌ম্যান বাহাইন্ড দ্য মেশিন’ বা ‘‌যন্ত্রের আড়ালের বা পেছনের মানুষ’। এক্ষেত্রে যন্ত্র (প্রতিষ্ঠান) যতই ভালো হোক পেছনের মানুষগুলোর (উদ্যোক্তা) মধ্যে কোনো সমস্যা দেখা দিলে প্রতিষ্ঠান শেষ পর্যন্ত অনুৎপাদনশীল হয়ে পড়ে। এতে করে ব্যাংকাররা উদ্বেগের মধ্যে পড়ে যায়। তাদের মধ্যে ব্যাংকের বিনিয়োগ ও গ্রাহক—দুটো বিষয় নিয়েই উৎকণ্ঠা তৈরি হয়। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকারদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের দেশের কোম্পানিগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক। আমরা দেখেছি যখন এক প্রজন্ম ব্যবসা পরিচালনার পর যখন পরবর্তী প্রজন্ম আসে তখনই সমস্যার সৃষ্টি হয়। এজন্য আমরা পরামর্শ দেই করপোরেটাইজ করে ফেলার। এভাবে পেশাদার লোক দিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হলে বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবেলা সহজ হয়। পরিবারের সদস্য দিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হলে এবং পরবর্তী প্রজন্মের কর্তৃত্ব নিয়ে জটিলতার সমাধান বন্ধুত্বপূর্ণ না হলে সমস্যা তীব্র হয়। এর প্রভাব কেমন তার একটি বড় উদাহরণ হলো দুই বোনের মধ্যে মালিকানা নিয়ে একটি বিরোধ এখন আইনি সমস্যায় রূপ নিয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সংশয়ে পড়ে কোম্পানি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে শুরু করে। এভাবে যখন প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনে প্রভাব পড়ে তখন সমস্যা আরো গভীর হয়ে ওঠে। ব্যাংকসংশ্লিষ্ট কাজগুলো সময়মতো হয় না। ঋণপত্র খোলা থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় নথি সই পর্যন্ত অনেক কিছু বিলম্বিত হয়। সার্বিকভাবে অংশীদারত্ব নিয়ে যখন প্রশ্ন ওঠে তখন আর কোম্পানির গ্রহণযোগ্যতা থাকে না।’  

শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, ব্যবসাগুলো তৃতীয় প্রজন্মের হাতে গড়ানোর সুযোগ পেলেই শুধু এগুলোর টেকসই কাঠামো গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হয়। দেশে বেশির ভাগ পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এখন দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে রয়েছে। আর তাদের মধ্যে বিরোধ ও দ্বন্দ্বের সূত্রপাতের পেছনে অনেক ক্ষেত্রে প্রথম প্রজন্মের নানা সিদ্ধান্ত ভূমিকা রেখেছে। ফলে এখন এমন অনেক প্রতিষ্ঠানেরই ব্যবসা টিকিয়ে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে, যা ব্যাংকারদেরও উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। 

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এবং হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ এমপি এখন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশের সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌বেশ কয়েকটি গ্রুপে বিরোধ ও দ্বন্দ্বের ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কিছু নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে, যারা পারিবারিক ব্যবসা কীভাবে চলে সেসব বিষয়ে কাজ করে। বাংলাদেশে প্রথম প্রজন্মের ব্যবসায়ীরা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে নজর দিতে পারেননি। সে হিসেবে বলা যায়, বর্তমানে যে ঘটনাগুলো ঘটছে সেগুলো আমাদের দোষের কারণেই। আমরা যদি কাঠামো গড়ে তুলতে পারতাম বা এ-সংক্রান্ত সঠিক নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে পারতাম তাহলে বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সহজ হতো। প্রতিষ্ঠান কীভাবে চলবে, কার কী ক্ষমতা, কে কত পাবে, কারো অবর্তমানে চুক্তি কীভাবে হবে—এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সব বিষয় একটি সঠিক ব্যবস্থা ও নীতিমালার মধ্য দিয়ে পরিচালিত করতে পারলে বিরোধ এড়ানো সম্ভব।’

দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে অগ্রগামীরা বলছেন, দ্বিতীয় প্রজন্মের বিরোধে পারিবারিক ব্যবসার ভঙ্গুর দশা হয়ে পড়ার বিষয়টি দুঃখজনক হলেও অস্বাভাবিক নয়। স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যবসার উদ্যোগ ও উদ্যোক্তার প্রসারের ইতিহাসটি খুব বেশিদিনের নয়। আর শুরুতে উদ্যোক্তারা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে গুছিয়ে এগোতে পারেনি। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী হয়নি। নিজেরা ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে পেশাদারদের দিয়ে ব্যবসা পরিচালনার চর্চাও তেমন একটা দেখা যায়নি। এ ধরনের ক্ষেত্রে কর্তৃত্ববাদও পেশাদারত্বের সঙ্গে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। 

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌একটা বেশ প্রচলিত কথা রয়েছে, তিনটি প্রজন্ম না গেলে কোনো কিছুই পরিপক্ব হয়ে ওঠে না। প্রথম প্রজন্ম আয় করে, দ্বিতীয় প্রজন্ম সাধারণত খরচ করে। খুব কম ক্ষেত্রে তৃতীয় প্রজন্ম পর্যন্ত ব্যবসা ধরে রাখতে পারে। যদিও তৃতীয় প্রজন্ম থেকেই পরিপক্বতার দিকে ধাবিত হতে পারে প্রতিষ্ঠান। আমাদের দেশে খুব কম পারিবারিক ব্যবসার ক্ষেত্রে তৃতীয় প্রজন্ম পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ ঘটেছে। তৃতীয় প্রজন্ম পর্যন্ত যাওয়ার আগে ব্যবসা টেকসই হওয়ার অনুপাত খুবই কম। ইতিহাস সেটাই বলে।’ 

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরাজমান বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করে দেশে বৃহৎ কনগ্লোমারেটগুলোর মূল উদ্যোক্তারাও এখন বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছেন। অনেকেই ভবিষ্যৎ দ্বন্দ্ব এড়াতে দীর্ঘদিন ধরে কাজও করছেন। এমনই একজন মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা কামাল। 

বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এজন্য আমি একটি ট্রাস্ট গড়ে তোলার বিষয়ে গত সাত-আট বছর ধরে কাজ করছি। পরে প্রাইসওয়াটারহাউজকুপারস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের সঙ্গেও এ নিয়ে কাজ করেছি। কিন্তু একটা পর্যায়ে এগিয়েও আমরা এ ট্রাস্ট গড়ে তুলতে পারিনি। তবে আমরা অলিখিতভাবে কিছু নিয়ম তৈরি করেছি। অতীতের প্রভাবশালী অনেকেরই; যেমন পাকিস্তান আমলের সেই ২২ পরিবার; কারোরই কিন্তু আর অস্তিত্ব নেই। এগুলো আমাকে তাড়িত করে। যার জন্য আমরা নিয়মকানুন তৈরি করছি, এ বিষয়ে ছেলে-মেয়ের সম্মতি নেব। এটি হলো আমাদের পরবর্তী জেনারেশনে ৩০ বছরের নিচে কেউ পরিচালক হতে পারবে না। যোগ্যকে যোগ্য জায়গায় বসাতে হবে। এতে যদি তারা কোনো ঐকমত্যে আসতে না পারে তাহলে কোম্পানিতে বোর্ড বসবে, প্রফেশনালরা চালাবে।’ 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন