আইওসির চেয়ে বেশি সফল রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি

অনুসন্ধান ও গ্যাসকূপ খননে ২৩ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ মাত্র ৭ হাজার কোটি টাকা

আবু তাহের

ছবি : বণিক বার্তা

রাষ্ট্রায়ত্ত তিন গ্যাস কোম্পানি ২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত—এ ২৩ বছরে দেশে গ্যাসকূপ খনন করেছে মোট ৫৯টি। এতে বিনিয়োগ হয়েছে ৬ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। সীমিত এ অর্থে খননকৃত অনুসন্ধানমূলক কূপের ৫০ শতাংশেই গ্যাস পাওয়া গেছে। যেখানে তার চেয়ে নয় গুণ বেশি বিনিয়োগ করে বিদেশী তেল-গ্যাস উত্তোলন কোম্পানিগুলোর (আইওসি) সফলতার হার কেবল ২৫ শতাংশ। গ্যাস খাতের উৎপাদন, সরবরাহ পরিস্থিতি, গ্যাসকূপ খনন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে পেট্রোবাংলার তথ্য-উপাত্তে বিষয়টি উঠে এসেছে। 

দেশে গ্যাস উত্তোলন করছে রাষ্ট্রায়ত্ত তিন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স), বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল) ও সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল)। প্রায় দুই যুগে কোম্পানি তিনটির আওতায় (এনওসি) মোট ১৮টি অনুসন্ধানমূলক গ্যাসকূপ খনন করা হয়েছে। এর মধ্যে নয়টিতেই গ্যাস মিলেছে। এক্ষেত্রে সফলতার হার ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে একই সময়ে বিদেশী তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী কোম্পানি দেশে মোট আটটি অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে। এর মধ্যে গ্যাস পেয়েছে কেবল দুটিতে। সে হিসেবে বিদেশী কোম্পানির সফলতার হার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির অর্ধেক, ২৫ শতাংশ। 

জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে গ্যাসের মজুদ ও সরবরাহ বাড়াতে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর পেছনে করা বিনিয়োগ যৎসামান্য। অথচ গত ছয় বছরের বেশি সময়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে ব্যয় করা হয়েছে অন্তত ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ এই এলএনজি আমদানি ব্যয়ের অন্তত অর্ধেক অর্থও দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়াতে ব্যয় করা গেলে ভালো ফল পাওয়া যেত।

পেট্রোবাংলার আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রিগ্যাসিফিকেশন চার্জসহ সংস্থাটির এলএনজি আমদানি বাবদ ব্যয় হয় ১১ হাজার ৮১২ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে মোট ৬৬টি কার্গো আমদানি করে পেট্রোবাংলা। এলএনজিবাহী এসব কার্গো আমদানি করতে সংস্থাটিকে গুনতে হয় ১৭ হাজার ৫০২ কোটি ৬২ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে দীর্ঘমেয়াদি ৭২টি কার্গো আমদানির বিপরীতে পেট্রোবাংলার খরচ হয় সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে জ্বালানি পণ্যটি আমদানিতে পেট্রোবাংলার ব্যয় প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যটি আমদানি করতে ব্যয় হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকার মতো। 

রাষ্ট্রায়ত্ত তিন কোম্পানির আওতায় গত ২৩ বছরে খনন করা হয়েছে মোট ৫৯টি গ্যাসকূপ। এ পরিমাণ কূপ খননে পেট্রোবাংলা তথা জ্বালানি বিভাগ বিনিয়োগ করে ৬ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। আর কূপ খনন করে যে গ্যাস পাওয়া গেছে তা বিক্রি বাবদ আয় হয়েছে মোট ৩৩ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। এ খাতে ৩৮৭ শতাংশ মুনাফা করেছে উত্তোলনকারী কোম্পানিগুলো, এমনটিই উঠে এসেছে পেট্রোবাংলার ওই তথ্য-উপাত্তে। অন্যদিকে একই সময়ে আইওসি ৫৬ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে মোট ৫৪টি গ্যাসকূপ খনন করেছে। সেখান থেকে পাওয়া গ্যাস বিক্রি করে সংশ্লিষ্ট সময়ে আয় করেছে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা। 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাস খাতে আমদানিনির্ভরতা না বাড়িয়ে গ্যাস অনুসন্ধানে বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বহু আগে থেকে বলে আসছি আমরা। দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে যতটুকু বিনিয়োগ করা হয়েছে, সে হারে সফলতাও মিলেছে। তবে গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে গ্যাস খাতের সরবরাহ বাড়াতে পর্যাপ্ত কূপ খনন করা হয়নি। সেটি করা গেলে গ্যাসের আরো বড় মজুদ আবিষ্কারের জোরালো সম্ভাবনা ছিল। গ্যাস অনুসন্ধানে এখন যে তৎপরতা ও পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে, এটা আরো অনেক আগেই করার প্রয়োজন ছিল।’

গত দুই দশকের বেশি সময়ে গ্যাস খাতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে, তার সফলতাও যে মিলেছে তা উঠে এসেছে পেট্রোবাংলার তথ্য-উপাত্তে। সংশ্লিষ্ট সময়ে দেশে মোট সাতটি গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কৃত হয়, যার মধ্যে ছয়টিই আবিষ্কার করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্স। বাকি একটি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করে বিদেশী কোম্পানি তাল্লো। এসব গ্যাস ক্ষেত্রে মোট ১ হাজার ৮৫৪ বিসিএফ গ্যাসের মজুদ পাওয়া গেছে। বাপেক্সের আবিষ্কৃত গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে সুন্দলপুরের সন্ধান মেলে ২০১১ সালে, যেখানে পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী ৩৫ বিলিয়ন কিউবিক ফুট (বিসিএফ) গ্যাসের মজুদ পাওয়া যায়। ২০১২ সালে আবিষ্কৃত হয় শ্রীকাইল গ্যাস ক্ষেত্র, যেখানে গ্যাসের মজুদ পাওয়া যায় ১৬১ বিসিএফ; ভোলা নর্থ-১ আবিষ্কৃত হয় ২০১৮ সালে, গ্যাসের মজুদ পাওয়া যায় ৪৩৫ বিসিএফ; জকিগঞ্জে গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কৃত হয় ২০২১ সালে, গ্যাস পাওয়া যায় ৫৩ বিসিএফ। সর্বশেষ গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে আবিষ্কৃত হয় ইলিশা গ্যাস ফিল্ড, যেখানে গ্যাসের মজুদ পাওয়া যায় ১৪০ বিসিএফ। এছাড়া বিদেশী কোম্পানি তাল্লো আবিষ্কার করে বাঙ্গুরা গ্যাস ক্ষেত্র, যেখানে ৭১৪ বিসিএফ গ্যাসের মজুদ প্রাক্কলন করা হয়েছে।

স্থানীয় গ্যাস উত্তোলন কোম্পানিগুলোর আওতায় বেশির ভাগ কূপ খনন করেছে বাপেক্স। তবে সরকারি এ সংস্থাটিকে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না দেয়া, কারিগরি ও দক্ষ জনবল সংকটের অজুহাত দেখিয়ে বসিয়ে রাখা এবং স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলন না করে এলএনজি আমদানি নিয়ে সমালোচনা বহুদিনের।   

জানতে চাইলে বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মর্তুজা আহমদ ফারুক চিশতী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধানে সরকার বড় একটি সময় অনুসন্ধানবিমুখ ছিল এটি সত্য। তবে এর পেছনে অনেক কারণও রয়েছে। একটা সময় গ্যাসকূপ খননে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট ছিল। বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থের ওপর তখন নির্ভর করতে হতো। এছাড়া বাপেক্সের কারিগরি সক্ষমতা পর্যাপ্ত ছিল না। একই সঙ্গে কূপ খনন প্রকল্পে বরাদ্দ কম থাকায় গ্যাস উত্তোলন কোম্পানিগুলোর দক্ষ জনবল রাখা চ্যালেঞ্জ ছিল।’ 

বাপেক্সের সাবেক এ ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরো বলেন, ‘শুধু বিনিয়োগ করলেই হবে না, স্থলভাগ ছাড়া বাপেক্সের দুর্গম ও সাগরে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এছাড়া বাপেক্সের তৎপরতায় গ্যাসকূপে সফলতা বেশি হলেও গ্যাসের মজুদ পাওয়া গেছে কম। এ বাস্তবতাও মানতে হবে। পাশাপাশি এলএনজি আমদানি দিয়ে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখার চেষ্টাও ছিল। যে কারণে গ্যাস আমদানি করতে অর্থ সংকটে পর্যাপ্ত কূপ খননে টাকাও পাওয়া ছিল চ্যালেঞ্জ।’

দেশে গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে স্থানীয় কোম্পানি বাপেক্সকে দিয়ে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে পেট্রোবাংলা। বর্তমানে ৪৬টি কূপ খননের কাজ করছে। বাকি আরো ১০০ কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি। এ ১০০ কূপ খনন আগামী ২০২৮ সালের মধ্যে করবে পেট্রোবাংলা। তবে বর্তমানে যেসব কূপ খনন করা হচ্ছে এবং আগামীতে যেসব কূপ খনন করা হবে, সেখানেও বাপেক্সের পাশাপাশি বিদেশী কোম্পানি কাজ করবে। বর্তমানে স্থলভাগে স্থানীয় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বিদেশী কোম্পানিগুলো যুক্ত হয়ে কাজ করবে। এরই মধ্যে বিভিন্ন অনশোরে বিভিন্ন কূপ খননে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়ায় বিদেশী কোম্পানিগুলো।

গ্যাসকূপ খননে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কিনা, এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে পেট্রোবাংলার শীর্ষ এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে গ্যাসকূপ খননে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাপেক্সকে সর্বোচ্চ কাজে লাগানো হচ্ছে। এর পাশাপাশি বিদেশী সংস্থাগুলোও কূপ খননে কাজ করবে। কারণ গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে যে পরিমাণ ঘাটতি তাতে দ্রুত সরবরাহ বাড়ানো দরকার। কূপ খননে বাপেক্সকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে হয়তো কম-বেশি হয়েছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন